সম্পাদকের কলাম

মান্নান সৈয়দের মন ও মেজাজ
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

আবদুল মান্নান সৈয়দ কখন কি ভাবে যে ‘মান্নান ভাই’ হয়ে গেলেন, তা বলা মুশকিল। আশি দশকের শুরুতে আমরা ‘লিটল ম্যাগে’র প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ছোটকাগজ’ হিসেবে চালু করার সিদ্ধান্ত নেই। সেই প্রেক্ষিতে আরো অনেক পরে আমি, ফরিদ কবির এবং মাহমুদ মান্নান ‘ছোটকাগজ’ সম্পাদনা করি। ছোটকাগজ থেকে প্রথম কবিদের স্বকন্ঠে কবিতার ক্যাসেট বের করি। রাত বারোটা এক মিনিটে প্রতি ২০/২১ ফেরুয়ারি টিএসসির সড়কদ্বীপে কবিতা পাঠের আয়োজন করি। এভাবে আমরা ‘ছোটকাগজ’ নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখি। মান্নান ভাই আমাদের সাথে সরাসরি যুক্ত না হলেও নেপথ্য থেকে  প্রেরণা ও পরামর্শ দিতেন, লিখতেন।
বর্তমানে মুদ্রণ যত সহজ, সেই সময় আমরা হ্যান্ড কম্পোজ, গেলি প্রুফ, কাঠের ব্লক, লেটার প্রেসে বহু কষ্ট করে, ধৈর্য ধরে রাতদিন পরিশ্রম করে কখনো পরনো ঢাকায় বুলবুল চৌধুরীর প্রেসে বা তাহেরবাগ লেনে কিংবা হাতিরপুরের গলি অথবা আজিমপুরের ছাপড়া মসজিদের কাছাকাছি কোথাও পত্রিকার কাজ করতাম।
এভাবেই সত্তর দশকের আনওয়ার আহমদ, হারুন হাবীব, আবিদ আজাদ, ফারুক মাহমুদ, শহিদুজ্জামান ফিরোজ, আশরাফ আহমদ, হালিম আজাদ, সলিমুল্লাহ খান, তুষার-লালন-মুজাহিদ-সেলিম, আবু সাইদ জুবেরী, আহমদ বশীর, হারুন রশিদ, তসলিমা নাসরিনেরা শিল্পতরু, নতুন কবিতা, স্বকাল, প্রাক্সিস জার্নাল, তারুণ্য, সিম্ফনী, ঢেউ, রূপম-কিছুধ্বনি সম্পাদনা করতেন। তাঁদের অনেকেই ‘চারিত্র’র সম্পাদক মান্নান সৈয়দকে ঘিরে গ্রীনরোডে প্রতি শুক্রবার সকাল থেকে মধ্য দুপুর পর্যন্ত আড্ডা যোগ দিতেন। প্রথমে মান্নান সৈয়দকে তাঁর বড় ভাইয়ের ওষুধের দোকানে, পরে ভোজনবিলাস চায়ের দোকানে আমাদের দীর্ঘ আড্ডা চলতো। তাঁর করতলে মহাদেশ, তাঁর হাতে শুদ্ধতম কবি, তিনি দশ দিগন্তের দ্রষ্টা । আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়তাম আর আড্ডায় শোনতাম- কলকাতার কথা, অপ্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের গল্প, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা। কিংবা পাকিস্তান আমলে অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে আইয়ূব সরকার সমকামের অভিযোগে কি ভাবে নিষিদ্ধ হলো- তাঁর গল্পগ্রন্থ-  ‘সত্যের মত বদমাশ’।
আমাদের সেই স্মৃতিময় আড্ডার সময় লিখছেন- ‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’। ভিন্ন মেজাজের মজার মজার কবিতা। তরতাজা কবিতাগুলো আড্ডায় পড়ে শোনাতেন। তাঁর এক বইয়ের কবিতা থেকে আরেক বইয়ের কবিতার সম্পূর্ণ পৃথক। ফলে ‘জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা’, ‘ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ’, ‘ কবিতাগুচ্ছ’, ‘মাছ সিরিজ’, ‘পরাবাস্তব কবিতা’র ধারায় কোনো মিল নেই। গবেষণায় নিমগ্ন মান্নান সৈয়দের কবিতাও ছিলো স্বতন্ত্র স্বাদ। আমি তাঁর ‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’ নিয়ে একটি আলোচনা লিখলাম আমার সম্পাদনায় ‘প্রচ্ছদে’। লেখাটি পড়ে ‘পরাবাস্তব কবিতা’ নিয়ে লেখার জন্য একটি বই দিয়ে বললেন, রিভিউটা লিখে আমাকে দিবেন।
পরের সাপ্তাহিক আড্ডায় আলোচনাটা দিলাম। তিনি চায়ে চুমুক দিতে দিয়েই পড়ে শেষ করে হো হো করে হাসলেন। হাসির অর্থ থেকে বোঝা গেলো লেখাটি পছন্দ করেছেন। কিন্তু খুবই একটি ‘অপছন্দের’ কাজ করে বসলেন মান্নান ভাই। লেখাটি ছাপতে দিলেন তাঁর প্রিয় ছাত্র সাজ্জাদ হোসাইন খানের কাছে, দৈনিক সংগ্রামে! যার জন্য আমি সারা জীবনের জন্য বিব্রত হয়ে আছি। কারণ, অই কাগজটিতে জীবনে আমার একটি লেখাই ছাপা হয়েছে- ‘মান্নান সৈয়দের সুরলিজম কবিতা’।
এই নিয়ে মান্নান ভাইয়ের সাথে অনেক দিন কথা বন্ধ ছিলো। শুধু একবার নয়, অনেক বার তাঁর সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে, কথা বন্ধ হয়েছে। আর এ সব মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে নয়; সম্পূর্ণ সাহিত্য সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। আজ তার রগ চটা আচরণের কয়েকটি চিত্র উপস্থাপন করতে চাই।
সিনে সাপ্তাহিক চিত্রালী আর সাপ্তাহিক পূর্বানীতে দু’টো লেখা জন্য মান্নান ভাই আমার সাথে বেশ কয়েক বছর কথা বলেন নি। ফারুখ ফয়সলের অনুরোধে শামসুর রাহমানের ‘অধুনা’ এবং মান্নান সৈয়দের ‘চারিত্র’ নিয়ে লিখলাম। ম্যাকাপের সময় ফারুখ ফয়সল খুঁজে পাননি মান্নান ভাইয়ের ছবি। তাই ‘অধুনা’র প্রচ্ছদের পাশে রাহমান ভাইয়ের ছবি ছাপা হলেও ‘চারিত্রে’র পাশের বক্সে সেখানে তাঁর ছবি যাবার কথা ছিলো, সেটা কালোকালির ব্রাশ টেনে দিয়েছিলেন!
আর পূর্বাণীতে শেখ আব্দুর রহমান ছাপলেন- মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত ‘মান্নান সৈয়দের শ্রেষ্ঠ কবিতা’র আলোচনা। বইটির সবুজ রঙের প্রচ্ছদে মান্নান ভাইয়ের নাম জিংকের ব্লকে ভুল ছিলো, আব্দুল মন্নান সৈয়দ। আর বইয়ের শেষে তাঁর পরিচিতিতেও ছিলো এক অদ্ভূত মুদ্রণ প্রমাদ। যা অর্থের আকাশ-পাতাল বদলিয়ে দিয়েছিলো। সত্যের মত বদমাশ, হয়েছিলো- ‘সত্যের মাতা বদমাশ’! এই মুদ্রণত্রুটি তুলে ধরার জন্য এমন খ্যাপা খ্যাপলেন যে, ক’বছর পর পুরানা পল্টনস্থ তৎকালীন ভোরের কাগজের অফিসে সাহিত্য সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের কক্ষে দেখা। আমরা দু’জন বসে আছি। দু’তিন বার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন মান্নান ভাই?’ অনেক্কখণ পর বললেন, আরো পাঁচ বছর পর আপনার সাথে কথা হবে। কারণ, আপনারা শামসুর রাহমানের ছবি ছাপবেন আর মান্নান সৈয়দকে ব্ল্যাক করে ‘ব্ল্যাক লিষ্ট’ করবেন। তা তো হতে পারেনা!
পরে আবার আমাদের সম্পর্ক ভালো হলে প্রায়ই আজিজ সুপার মার্কেটে ‘পাঠক সমাবেশে’ এলেই মাঝে মাঝে আমার কার্যালয়ে আসতেন, আড্ডা দিতেন। পরে কুমিল্লা থেকে প্রদত্ত ২০০২ সালে অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার দিলে তিনি খুশি হয়ে বললেন, আমি কলকাতা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও যাইনি। আপনার তো আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে, আমাকে একবার লন্ডন নিউ ইয়্যূর্ক পাঠানোর ব্যবস্থা করেন, ঘুরে আসি।
২০০৪ সালে আমি লন্ডনে গিয়ে ‘নজরুল পরিষদে’র সাথে আলাপ করে পরবর্তী ১১ জ্যৈষ্ঠের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে মান্নান ভাইকে ঠিক করে নিমন্ত্রণ, নজরুলের ছবি সম্বলিত টিশার্ট, পুরনো ব্রুশিয়ার  নিয়ে আসি। মান্নান ভাই তখল নজরুল ইনিষ্ট্রিটিউটের নির্বাহী পরিচালক। খবরটা পেয়ে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু নিজের কারণে আর যেতে পারেননি। কারণ, কিছু দিন পর ‘নজরুল পরিষদের’ পক্ষে লন্ডন থেকে আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ নিয়ে এসে মান্নান ভাইয়ের অফিস এবং বাসায় বার বার ফোন করেছিলেন। অফিসে ফোন ধরেন নি, ব্যস্ততা আর অচেনা ব্যক্তি হিসেবে আর বাসায় ফোন করলে তিনি কখনো লিখছেন, কখনো ঘুমুচ্ছেন। পরে ‘নজরুল পরিষদের’ সেই ব্যক্তি রাগ করে তাঁকে বাদ দিয়ে সম্ভবত আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে যান।
অনেকদিন পর মান্নান ভাইকে এই ঘটনা বললে, তিনি খুব হতাশ হন!
পরে মান্নান ভাইয়ের সাথে এতো খাতির হয় যে, সর্বশেষ প্রেমে পরা মেয়েটিকে নিয়ে লেখা খড়সা কবিতা পড়ে শোনাতেন, তার গল্প করতেন আর প্রাণ খুলে খুব সুখের হাসি হাসতেন। তখন আমি ঢাকায়। আমার ‘নীড়ে নিরুদ্দেশে’ দ্বিতীয় মুদণ হবে শোনে বললেন- ‘দাঁড়ান, আমি একটা ভূমিকা লিখে দিচ্ছি’। পাঠক সমাবেশের দোতলা অফিসে বসে লিখে দিলেন দু’পাতার অপূর্ব ভূমিকা। যাতে প্রশংসা করতে বিন্দুমাত্র কর্পণ্য করেননি।
আজ থেকে সাতাশ-আটাশ বছর আগে১৯৮৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নাসিমা সুলতানা আর আমার যৌথ কাব্যগ্রন্থ ‘তবু কেউ কারো নই’এর প্রকাশনা উৎসবে মান্নান ভাই বলেছিলেন-‘সত্তর দশকের শেষ দিকে যে ক’জন কবি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তাদের মধ্যে নাসিমা ও দুলাল অন্যতম। দুলালের কবিতায় সময় ও সমাজের চিত্র চমৎকার। শৈল্পিক নান্দনিকতায় পাঠককে আকৃষ্ঠ করে, মুগ্ধ করে’।
সাহিত্যের ঘোর লাগা মান্নান সৈয়দ আপাদমস্তক একজন নিবেদিত সাহিত্যকর্মী ছিলেন। তবে মোটেও আত্মভোলা ছিলেন না। তিনি নিজের উপর গবেষণা করতেন। বলতেন- ‘নিজের লেখা, নিজের উপর লেখা সব গুছিয়ে যত্ন করে রাখবেন। কাজে লাগবে। আপনি আমাকে নিয়ে যা যা লিখেছেন, তা আমাকে দিবেন। আমি সব সংগ্রহ করছি। জীবননান্দকে নিয়ে আপনার লেখা একটি কবিতায় আমার নাম আছে, সেটিও চাই’।
সূচিপত্রের ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ সংখ্যায় কবিদেরকে দিয়ে নিজের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের উপর আত্মসমালোচনামূলক লেখা ছাপি। বিষয়টি মান্নান ভাই খুব মজা পেয়েছিলে এবং মাছ সিরিজ বইটি নিয়ে লিখেছিলেন- ১৯৮৪ সালে বেরিয়েছিল আমারা শেষ একক কবিতা গ্রন্থ মাছ সিরিজ এক শরতে লিখেছিলাম এই কবিতাগুচ্ছের অধিকাংশআর এক শরতে লিখছি এই কবিতাগুলো সম্পর্কে।… কবিতা আমি কখনো ঠিক একটানা লিখিনি। হঠাৎ আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে একটানা কিছু দিন লিখতে লিখতে স্বপ্নকল্পনার এমন এক জগতে প্রবেশ করি যে নিজেরই ভয় লাগে এ কোথায় যাচ্ছিরাজপথ ছেড়ে গলি থেকে কোনউপ-গলির ভেতর। এদিকে আমার উচ্ছ্বসিত আবেগ কিছুদিন পরেই থিতিয়ে আসে। কবিতা তখন আপনিই ছেড়ে যায়। আমার কবিতাগুলি এরকমভাবেই এক-একটি ঋতুপরিসরে লেখা। হয় কিকবিতা লিখছি না কবিতা লিখছি নাতারপর হঠাৎ একদিন জোয়ারের মতো এসে পড়ে কবিতাআমাকে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ক’টা দিন বা সপ্তা বা মাস কেটে যায় একটা ঘোরের ভেতর। তারপর আবার যে-আমি-সেই’...
এই মান্নান সৈয়দ, সেই মান্নান সৈয়দ- যিনি সাহিত্যের ঘন ঘোরে রাজপথ ছেড়ে গলিউপ-গলি পেরিয়ে হারিয়ে যেতেন অচেনা এক জগতে। আর এখন হারিয়ে গেছেন আরেক অজানার দেশে।
(জঃ আগস্ট ০৩১৯৪৩ ।। মৃঃ সেপ্টেম্বর ০৫২০১০)

 =================
কানাডায় প্রথম বাংলা বইমেলার কথা
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল


প্রবাস জীবনে সবচেয়ে বেশি মিস করি বাংলা একাডেমীর ফেব্রুয়ারির বইমেলা। বুকটা হু হু করে উঠে। পরপর বাংলা একাডেমীর দু’টি বইমেলা থেকে বঞ্চিত। ঢাকার লেখক বন্ধুরা বলেন, রিটন-দুলাল ছাড়া বাংলা একাডেমীর বইমেলায় কোথায় যেন সামান্য একটু শূন্যতা থেকে যায়। কারণ, আমি আর লুৎফর রহমান রিটন অনেকটা মানিক জোড়ের মতো প্রাণবন্ত হয়ে ঘুরতাম, আড্ডা দিতাম। আজ রিটনও কানাডায়, আমিও।
প্রতিবছরই অটোয়ায় অনুষ্ঠিত হয় বুক এক্সিবিশন। এ মেলায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একটু অন্যরকম। যারা সেমিনারে অংশ নেয়, শুধু তাদের বইবিক্রির ব্যবস্থা থাকে। ফলে পাঠক ক্রেতা সরাসরি লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। ২০০৬-এ দেখলাম, খুব কম সংখ্যক লোকজনের সমাবেশ ঘটেছে সপ্তাহব্যাপী বইমেলায়। কিন্তু বাংলা একাডেমীর বইমেলার সেই প্রাণ পেলাম না।।
অটোয়া থেকে টরন্টো এলাম, ২০০৬-এর জুনে। যোগ দিলাম সাপ্তাহিক বাংলার রিপোর্টারে। অফিসের কাছাকাছিই একমাত্র বাংলা বই-এর দোকান অন্যমেলা। ঢাকার মাজহার-মাসুমদের অন্যপ্রকাশ, অন্যদিন, অন্যমিডিয়া, অন্যমেলা কানাডায়! বাহ কি চমৎকার!! 
টরন্টোতে অন্যমেলা চালু করেন মাসুম রহমান, পার্টনার ছিলেন সাদী আহমেদ। এখন মাসুম নেই। সাদী আহমেদ একাই চালান। বইপত্র খুব একটা বিক্রি হয় না। তবু তিনি জ্ঞানের প্রদীপ নিয়ে টরন্টোর ‘চিত্তরঞ্জন সাহা’ হয় বসে আছেন। তাকে বললাম, একটা বইমেলা করলে কেমন হয়? বইমেলার কথা শুনে চমকে উঠলেন। চমৎকার প্রস্তাব। অনেক দিন ধরে ভাবছেন তিনি। তার মনের কথা বলায় আরো বেশি উৎসাহী হয়ে উঠলেন। কিন্তু সাহস পাচ্ছেন না। সাহস, সহযোগিতা, সাহায্য সবই প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও সাদী আহমেদ রাজী না। এক পা এগুলে, দু’পা পিছান।
এদিকে ঢাকা থেকে বেশ ক’জন প্রকাশক নিউইর্য়কে আসবেন, ২০০৭ জুনে । তারাও কানাডায় আসতে আগ্রহী। ভিসার জন্য নিমন্ত্রণপত্র দরকার। প্রকাশকদের জন্য পত্রিকার চেয়ে বইয়ের স্টলের নিমন্ত্রণ প্রাসঙ্গিক বেশী। তাই তার শরণাপন্ন হওয়া। কিন্তু সাদী সাহেব সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
বললাম, ‘হল ভাড়া করার দরকার নেই। অন্যমেলার পাশে শক্তি দেবের অফিসের মাঝের খালি জায়গাটা ব্যবহার করতে পারেন। স্থানীয় লেখক-শিল্পীদের দাওয়াত করুন। না হয়, অনেকটা ঘরোয়া পরিবেশেই হলো, ক্ষতি কী? আর আমাদের সাপ্তাহিক রিপোর্টার প্রয়োজনে বইমেলার পার্টনার হবে। সব ধরনের সহযোগিতা পাবেন। এমন কী ঢাকার লেখক-প্রকাশকও সহযোগিতা করবে।
নিউইর্য়কের বইমেলায় যারা আসবেন, তাঁদের হাতে সময় নেই। ভিসা পেতে কম পক্ষে সপ্তাহ খানেক লেগে যায়। অনন্যার মনিরুল হক যোগাযোগ করলেন। কিন্তু সাদীর ‘দোনামোনা’ শেষ হচ্ছে না। তিনি টরন্টোর বাইরে উইন্ডসর গেছেন। ফোন দিলাম। বললাম, কাল শুক্রবার আমাদের কাগজ বের হবে। একটা নিউজ করে দিচ্ছি। প্রকাশকেরা আসতে চাচ্ছেন। আপনি রাজি হন। তিনি হা/না কিছুই বললেন না।
নিউজ ছাপা করে দিলাম। পরদিন বাংলা রিপোর্টার এর শেষ পাতায় ছাপা হলো- ‘টরন্টোতে হতে যাচ্ছে বাংলা বইমেলা।’ তারপর থেকে বাংলা রিপোর্টার এর প্রতিসংখ্যায় সচিত্র সংবাদ, প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার, বিজ্ঞাপন এমনকী বিশেষ সংখ্যাও বের করলো। 
টরন্টোর বইপ্রেমিকদের বিপুল সাড়ার প্রক্ষিতে মেলার স্থান পরিবর্তন করে ওকনোর এবং সেন্ট ক্লেয়ার ইস্টের ইন্টারসেকশনের চার্চ অব সেন্ট কলাম্বাস এন্ড অল হ্যালোজ হল ভাড়া করা হলো ৩০ জুন ২০০৭-এ।
ড. আনিসুজ্জামান আসবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ঢাকায় ফোন দিলাম। বললাম, স্যার আমরা কানাডায় প্রথমবারের মতো বইমেলা করছি। আপনি কী কষ্ট করে আসবেন?
প্রধান অতিথি হয়ে এলেন ড. আনিসুজ্জামান। কিন্তু নানান জটিলতার কারণে প্রথমবার সময় প্রকাশনের ফরিদ আহমেদ ছাড়া আর কোনো প্রকাশকই ভিসা পেলেন না। অবশ্য পরের বার অনন্যার মনিরুল হক যোগ দেন। এবং দ্বিতীয় বইমেলায় প্রথান অতিথি হয়ে টরন্টো আসেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান।
বইমেলা নেপথ্যে যারা সহযোগিতা করেন, তারা হলেন তৎকালীন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মুহম্মদ শাহেদ, বাংলাদেশ দূতাবাসের তৎকালীন ডেপুটি হাইকমিশনা ও বিশিষ্ট লেখক মাসুদ খন্দকার, শিল্পী ও কথাশিল্পী সৈয়দ ইকবাল, বাংলা রিপোর্টার প্রকাশক আশরাফ হাসান এবং আরো অনেকেই। স্থানীয় শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে তৎকালীন ডেপুটি প্রিমিয়র ও মন্ত্রী জর্জ স্মিথারম্যান, এমপি মারিয়া মিন্না, প্রফেসর যশেফ ও কনেল প্রমুখ।
ইতোপূর্বে নিউইর্য়ক, লন্ডন, সিডনি, টোকিওতে দীর্ঘদিন ধরে বাংলা বইমেলা হচ্ছে। সেবার যুক্ত হলো টরন্টো। বইমেলা টরন্টোতে হলেও এতে অটোয়া, মন্ট্রিয়ল থেকেও লেখক পাঠক স্বতস্ফুর্ত ভাবে অংশ নেয়। একদিনের জমজমাট মেলা যেন অতৃপ্তিই থেকে গেলো।
একদিকে বই বিক্রি, অন্য দিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো অংশ নেয়। নৃত্য-শিল্পী অরুণা হায়দারের ‘সুকন্যা’রা নাচে গানে মালা পরিয়ে বরণ করে নিলো প্রধান অতিথিকে। মঞ্চে উঠতেই উদ্বোধনী গান করলো শিল্পী চমন আরা বেগমের সাতসুরের ছেলে-মেয়েরা। লেখক রচিত ছড়া গানটি হলো-

এসো এসো বই পড়ি
স্বপ্ন সুখের জীবন গড়ি।।

বন্ধু বইয়ের তুলনা নেই,
বন্ধ দুয়ার আজ খুলে দেই
নতুন মাত্রা যুক্ত করি।।

বই জীবনের চোখের মণি
বইয়ের ভেতর জাদুর খনি,
আজ শুধু হোক হাতে খড়ি।

ইতোমধ্যে অন্যমেলা ছাড়াও ড্যানফোর্থস্থ বাংলাপাড়ায় আরো দু’টি বইয়ের দোকান চালু হয়েছে। এটিএন মিউজিক এবং বাংলা মিডিয়া, যদিও পুরোটা বই নয়; আংশিক সিডি ক্যাসেট এবং অন্যান্য জিনিস। পরবর্তীতে প্রতি বছরই মেলা হচ্ছে কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এটিএন মিউজিক ও বাংলা মিডিয়া এমন কী বাংলাদেশের প্রকাশনীরাও অংশ নেয়নি। এমন কী, স্থানীয় শীর্ষ স্থানীয় লেখক-সাংবাদিক-সংস্কৃতিক কর্মীদেরও দেখা যায়নি সেখানে। কারণ, এ মেলা সার্বজনীন হতে পারতো; হয়নি। হয়েছে অন্যমেলার একান্ত 'ব্যক্তিগত বইমেলা'।
২০০৭-এ যে প্রদীপ জ্বলে উঠলো, নানান কারণে খুব দ্রুতই কী তার তেল ফুরিয়ে যাচ্ছে? বইমেলার নিভূ নিভূ প্রদীপ সম্মিলিত উদ্যোগে আগামীতে শিখা অনির্বাণ হয়ে জেগে থাকবে, এটাই প্রবাসী বাঙালিদের একান্ত কাম্য।

1 টি মন্তব্য:

  1. কুকুর রে কুকুর
    তুই একটা শুকুর
    দুলাল রে দুলাল
    তুই একটা আবাল
    হারাম জাদারে হারাম জাদা
    তুই আস্ত একটা পাঠা
    দুলাল রে দুলাল
    তোর্ পুটকি লাল
    দুলাল রে দুলাল
    তুই ভোদার বাল

    উত্তরমুছুন