শর্ত ][ ফিউরী খন্দকার
তুমি
বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসো
আমি
তোমাকে ভালবাসবো।
আমি এবং আমার মুজিব ][ আইভি রহমান
আমি
তখন ছোট, বুঝিনা
কিছুই, কাকে
বলে-
রাজনীতি, কূটনীতি বা যুদ্ধনীতি
শুধু
বুঝি, বুকের
ভেতর একটাই নাম
উচ্ছল্যে
সদা বহমান
চোখের
বারান্দায় কাজলের সমান
এক
শিখা জ্বলে অবিরাম- ‘শেখ মুজিবর রহমান’
উদ্ধত
শির যার পর্বত-প্রমাণ মহীয়ান
তিনি
একাই সাত আসমান।
সেই
দিনের এক ঘুম ভাঙ্গা ভোরে
আমি
জানলাম-
আমার
বহমান নদী আচানক থেমে গেছে
জানোয়ার
জন্তুর ঘৃণ্য চরে
পড়ে
আছে কি নিষ্ঠুর
মুখ
থুবড়ে!
আমি
জানলাম
আমার
পর্বত সমান সেই নাম
লুটিয়েছে
রক্ত গঙ্গায় নিঃশেষ করে প্রাণ-তবুও
লুন্টিত
হতে দেয়নি তার
অর্জিত
অহংকারী সম্মান।
আমি
জানলাম
আমার
সেই ছোট্ট চোখের কোণে
নেমেছিল
কি করুণ প্রবল ঢল
আমি
জানলাম
আমার
ছোট্ট বুক পাঁজর মুচড়ে দুর্বল
বন্ধ
হয়েছিল ধুকপুক হৃদ করতল।
আমি
জেনেছিলাম
খাবার
নামেনি কণ্ঠনালি ভেদ করে
আকাশ
বাতাস কাঁপিয়ে বুক চিরে
এসেছিল
অভিশাপ ঘৃণ্য তাদের তরে।।
আজ
বহু বহু দিন পর- আমার যখন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর
বুঝে
নিয়েছি রাজনীতি কূটনীতি আর যুদ্ধনীতির দর – তখন,
মাঝে
মাঝে অবাক হয়ে দেখি, নির্জন নিরবে
আজও
বসে থাকি সেই ছোট্ট আমার হাত ধরে
আজও
পনেরই অগাস্ট কাঁদে
আমার
স্মরণের তপ্ত বালুচরে।
এখনও
এই দিনে আমি স্থবির মুঢ় মৌণ থাকি দিনমাণ
আমি
শুধু জানি কি করে দাফন করি
বুক
জমিনের অতল তলে সেই একটি নাম
আমি
শুধু জানি কি ব্যথায় ঢেকে রাখি
আমার
কান্না প্রাসাদ- আকাশ সমান অভিশাপের হাত
আমি
শুধু জানি কতটা লজ্জায় ঢাকি আঁখিপাত
আমি
শুধু জানি আমার ক্ষতের সুপ্ত অভিসম্পাত
কতটা
কালো করে দেয় আমার এই যৌবন ধারাপাত।
আমি
কারো কাছে যাইনি
কোন
ক্ষণে
কেঁদেছি
একা গোপনে সঙ্গোপনে
আমি
কারো কাছে যাইনি
বন্ধ
করেছি মন কপাট
জেনেছি
এটাই নীতি রাজ্যপাট।
কি
কূট কৌশলে চলে এখানে বাণিজ্য সবার
কি
অবলীলায় চেপে ধরে গহীন অন্ধকার
অলক্ষ্যে
লক্ষ্যে চলে চালায় ধান্দা যার যার
কে
করে কার বিচার!
বড়
হতে হতে দেখে নিয়েছি আমি
জেনে
নিয়েছি ভাগ্য আমাদের সবার
উঠে
দাঁড়াতে দেয়নি যারা তাঁকে
আমরা
শিকার তাদেরই বারংবার!
তবুও
আমাদের নেই লাজ-লজ্জা তিরস্কার
সময়
নেই যেন ছুঁড়ে দেবার ঘৃণ্য ধিক্কার
চেয়ে
চিন্তে চলি করি তাদের সাথেই আঁতাত
আমাদের
সমগ্রতাতে তাদেরই পক্ষপাত!
আমার
জানা নেই আজও-
জনকের
তরে আমাদের এই ক্রন্দন
কতদিন
ঝরাবে আমাদের রক্ত-স্রোত
হৃদ-স্পন্দন।
কতদিনে
পাবো সম্পূর্ণ বিচারের ফল
কতদিনে
ফুটবে সাফল্যের লাল উৎপল
হাসবে
আমাদের সিক্ত আঁখি টলমল।
আশাবাদী
আমি পথে পথে মেলে দেই
আমার
অশ্রুভেজা সবুজ শামিয়ানা
বিছিয়ে
রাখি সারা আঙ্গিনা জুড়ে পুস্প বিছানা
খুব
সন্তর্পণে বানাই শুধুই তাঁর তরে
নরম
মসলিন মসৃণ পথ যত্নে আদরে।
আমাদের
অক্ষমতা ক্ষমা করে তিনি হাসবেন
আমাদের
ভেতরে তিনি, কেবল
তিনিই
আবার
সেই উত্তাল একাত্তর
আর
একবার আবার জাগাবেন।।
ক্যানবেরা।
১৫ অগাস্ট ২০১৪
বাংলার মানচিত্রে বঙ্গবন্ধু ][ এম আর ফারজানা
নিষ্ঠুরতার
মুখোশ এঁটে বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করল
তারা বুঝতে পারেনি মৃত্যুতে সব নিশ্চিহ্ন হয়ে
যায় না।
বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছে বাংলার মৃত্তিকায়
বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছে কবির কবিতায়
বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছে শিল্পীর তুলিতে
বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছে সাহিত্যের ঝুলিতে।।
মীরজাফর’রা ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে
দিতে চেয়েছিল
তারা
বুঝতে পারেনি বঙ্গবন্ধু মানেই ইতিহাস।
তিনি মিশে আছেন ৭ই মার্চের ভাষণে
তিনি মিশে আছেন শ্রদ্ধার আসনে
তিনি মিশে আছেন স্বাধীনতার সংগ্রামে
তিনি মিশে আছেন কৃষকের ঘামে ।।
বঙ্গবন্ধুর বিজয়গাঁথা গৌরব যারা কবর খুঁড়তে
চেয়েছে
তারা ভাবতে পারেনি বাংলার মানচিত্রে তিনি বেঁচে
থাকবেন।
মানচিত্রে তিনি সূর্যের মত সত্য
মানচিত্রে তিনি নক্ষত্রের মত আলোকিত
মানচিত্রে তিনি লাল সবুজের মাঠ
মানচিত্রে তিনি ইতিহাসের পাঠ ।।
বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করতে
চেয়েছিল সবকিছু
তারা ভুলে গিয়েছিল কৃর্তিমানদের মৃত্যু হয় না।
বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন ইতিহাসের পাতায়
বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন সংগ্রাম স্বাধীনতায়
বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন বাংলার ঘরে ঘরে
বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন মানুষের অন্তরে।
==========================
বঙ্গবন্ধুকে নির্বাচিত পঙক্তিগুচ্ছঃ অন্নদাশঙ্কর রায়, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক, মহাদেব সাহা, শহীদ কাদরী, সিকদার আমিনুল হক, জাহিদুল হক, কাজী রোজী, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, গৌরী প্রসন্ন মজুমদার এবং উর্দূ কবিতা মূলঃ মীর গুল খান নাসির। অনুবাদ: রিজওয়ান উল আলম।
নতুন কবিতাঃ
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, গোলাম কিবরিয়া পিনু, নাজিম শাহরিয়ার, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, আবু মকসুদ, মুজিব ইরম, মাহফুজ পারভেজ, ফারহান ইশরাক, মাসুদ পথিক, পিয়াস মজিদ, হুমায়ূন কবীর ঢালী, শাহীনা কবীর, তাহমিনা শাহেদ আশরাফুল ইসলাম, আবলু রশিদ আহমেদ তালুকদার।
==================
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে ][ অন্নদাশঙ্কর রায়
নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো
করে যদি যারা তাঁর পুত্রসম বিশ্বাসভাজন
জাতির জনক যিনি অতর্কিতে তাঁরেই নিধন।
নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর,
সারা দেশ ভাগী হয় পিতৃঘাতী সে ঘোর পাপের
যদি দেয় সাধুবাদ, যদি করে অপরাধ ক্ষমা।
কর্মফল দিনে দিনে বর্ষে বর্ষে হয় এর জমা।
একদা বর্ষণ বজ্ররূপে সে অভিশাপের।
রক্ত ডেকে আনে রক্ত, হানাহানি হয়ে যায় রীত।
পাশবিক শক্তি দিয়ে রোধ করা মিথ্যা মরীচিকা।
পাপ দিয়ে শুরু যার নিজেই সে নিত্য বিভীষিকা।
ছিন্নমস্তা দেবী যেন পান করে আপন শোণিত।
বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! থেকো নাকো নীরব দর্শক
ধিক্কারে মুখর হও হাত ধুয়ে এড়াও নরক।
তিনি এসেছেন ফিরে ][ শামসুর রাহমান
লতাগুল্ম বাঁশঝাড়, বাবুই পাখির বাসা আর
মধুমতি নদীটির বুক থেকে বেদনা বিহবল
ধ্বনি উঠে মেঘমালা ছুঁয়ে
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়।
এখন তো তিনি নেই, তবু সেই ধ্বনি আজ শুধু
তাঁরই কথা বলে;
মেঘনা নদীর মাঝি যখন নদীতে
ভাটিয়ালী সুর তোলে, তার
পালে লাগে দীর্ঘদেহী সেই পুরুষের দীর্ঘশ্বাস,
যখন কৃষক কাস্তে হাতে
ফসলের যৌবনের উদ্ভিন্ন উল্লাস দেখে মাতে,
তখন মহান সেই পুরুষের বিপুল আনন্দধ্বনি ঝরে
ফসলের মাঠে,
যখন কুমোর গড়ে মাটির কলস, ঘটিবাটি,
নানান পুতুল চাকা ঘো্রাতে ঘো্রাতে,
তখন সৃজনশিল্পে তার
জেগে উঠে মহান নেতার স্বপ্নগুলি,
উচ্ছ্বসিত লাউডগা, কচুপাতা, কুয়োতলা, পো্যাতি
কুমো্র বউ।
ওরা তাঁকে হত্যা ক’রে ভেবেছিল তিনি
সহজে হবেন লুপ্ত উর্ণাজাল আর ধোঁয়াশায়,
মাটি তাকে দিবে চাপা বিস্মৃতির জন্মান্ধ পাতালে-
কিন্তু তিনি আজ সগৌ্রবে
এসেছেন ফিরে দেশপ্রেমিকের দীপ্ত উচ্চারণে,
সাধারণ মানুষের প্রখর চৈতন্যে,
শিল্পীর তুলিতে, গায়কের গানে কবির ছন্দের আন্দোলনে,
রৌদ্রঝলসিত পথে মহামিছিলের পুরোভাগে।
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসি নি ][ নির্মলেন্দু গুণ
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল ভালোবাসি
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই সব গোলাপের একট গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি;
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
শহীদ মিনার থেকে খসে পড়া একটি রক্তাক্ত ইঁট গতকাল আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি;
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, সমকাল
পার হয়ে যেতে সদ্য ফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি;
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
শাহবাগ অ্যাভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝর্নাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি;
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমারও স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,
ভালোবাসা আছেÑ শেষরাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি;
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষেরা সাক্ষী থাকুক
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের গোপন
মঞ্জরিগুলি কান পেতে শুনুক
আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক-
আমি আমার পায়ের তলার পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসি নি। আমি আমার
ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।
হন্তারকদের প্রতি ][ শহীদ কাদরী
বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়
না, কোন উপমায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাবেনা।
তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম,
বুট, সৈনিকের টুপি,
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের কথাও হয়েছিল,
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো
বাংলাভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলার মানুষ
এর চেয়ে ভয়াবহ কোন কথা আমি আর শুনবোনা কোনদিন।
বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ][ সৈয়দ শামসুল হক
এই পৃথিবীতে আর আকাশ দেখিনি আমি এতো_ অবনত_
ঘুমন্ত শিশুর মুখে যেন চুমো খাবে পিতা নামিয়েছে_ মুখ;
প্রান্তর এতোটা বড় যেন মাতৃশরীরের ঘ্রাণলাগা শাড়ি;
আদিকবি পয়ারের মতো অন্তমিল নদী এতো শান্তস্বর;
এতোই সজল মাটি কৃষকের পিঠ যেন ঘামে ভিজে আছে;
যদিও বৃষ্টির কাল নয় তবু গাছ এতো ধোয়ানো সবুজ;
দেখিনি এমন করে পাখিদের কাছে ব্যর্থ ব্যাধের ধনুক_
মানুষের কাঁধটিকে বৃক্ষ জেনে বসে তারা এতো স্বাভাবিক;
এ কেমন?_ এমনও কি ভিটে হয় কারো এই পৃথিবীতে যার
বাড়ির গভীরে আছে সকলের বাড়িঘর এতোখানি নিয়ে;
এভাবে ওলান থেকে অবিরল দুধ ঝরে পড়ে যায়_ এতো
শব্দ কোন গ্রামে আমি কোন বিবরণের আর কখনো পাইনি;
কোথাও দেখিনি আর একটি পল্লীতে এতো অপেক্ষায় আছে
রাখালের মতো তার গ্রীবা তুলে মানুষের স্বপ্নের সময়।
এখানে এসেছি যেন পথই টেনে নিয়ে এলো এই পল্লীটিতে।
সকল পথের পথ পল্লীটির দিকে অবিরাম ঘুরে গেছে_
গিয়েছিল_ একদা যখন এই পল্লীটির কালো মাটি থেকে
একটি নতুন শিশু উঠে এসেছিল, আর এই পল্লীটিরই
পাশ দিয়ে মাটির দুধের মতো বহে যাওয়া নদীটিতে নেয়ে
ক্রমে বড় হয়েছিল আর চেতনার কামারশালায় বসে
মানুষের হাতুড়ি নেহাই লোহা প্রযুক্তির পাঠ নিয়েছিল,
সকল পল্লীকে তার আপনার পল্লী করেছিল। সেই তাঁরই
টগবগে দীর্ঘদেহ ছিল, মানুষ দেখেছে_ দেখেছিল তাঁকে_
বাংলার বদ্বীপব্যাপী কংকালের মিছিলের পুরোভাগে, তাঁকে
দেখেছিল চৈত্রের অগি্নতে তারা, আষাঢ়ের বর্ষণের কালে,
মাঘের শীতার্ত রাতে এবং ফাল্গুন ফুল যখন ঝরেছে,
যখন শুকিয়ে গেছে পদ্মা, আর যখন সে বিশাল হয়েছে;
যখন ষাঁড়ের ক্ষুর দেবে গেছে আর মাটি রক্তে ভিজে গেছে,
যখন সময়, আর ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি শুরু হয়ে গেছে
এখানে এসেছি যেন পথই টেনে নিয়ে এলো এই পল্লীটিতে।
টেনে নেবে পথ; যদিও অনেকে আজ পথটিকে ভুলে গেছে,
যদিও এইতো দেখি, কন্টিকারী ফেলে ফেলে পথটিকে কেউ
পথিকের জন্যে বড় দুর্গম করেছে এবং যদিও জানি
কেউ কেউ আমাদের পথের সম্বল সব খাদ্যপাত্রগুলো
মলভাণ্ডরূপে আজ ব্যবহার করে; বিষ্ঠায় পতিত হবে
অচিরে তারাই; আমি করতল থেকে খুঁটে খাবো; সঙ্গ দেবে
আমাদেরই পথের কবিতা; আমাদের প্রধান কবিকে যারা
একদিন হত্যা করে তাঁর জন্মপল্লীটিতে মাটিচাপা দেয়_
কতটুকু জানে তারা, কত ব্যর্থ? জেগে ছিল তাঁর দুটি হাত,
মাটি গভীর থেকে আজো সেই হাত_ পুরানোকথার মতো_
স্মৃতির ভেতর থেকে উচ্চারণমালা, নদীর গভীর থেকে
নৌকোর গলুই, পথিকের পদতল কাঁটায় রক্তাক্ত যদি,
সেই রক্ত শোধ হোক তাঁর কাছে ঋণ; মানব প্রসিদ্ধ কৃষি
খুব ধীরে কাজ করছে; পাখিরা নির্ভয়; আর আমিও পৌছেছি;
আমারই ভেতর-শস্য-টেনে নিয়ে এলো আজ আমারই বাড়িতে।
কফিন কাহিনী ][ মহাদেব সাহা
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন
একজন বললো দেখো ভিতরে রঙিন
রক্তমাখা জামা ছিলো হয়ে গেছে ফুল
চোখ দুটি মেঘে মেঘে ব্যথিত বকুল!
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে এক শবদেহ
একজন বললো দেখো ভিতরে সন্দেহ
যেমন মানুষ ছিলো মানুষটি নাই
মাটির মানচিত্র হয়ে ফুটে আছে তাই!
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি শরীর
একজন বললো দেখো ভিতরে কী স্থির
মৃত নয়, দেহ নয়, দেশ শুয়ে আছে
সমস্ত নদীর উৎস হৃদয়ের কাছে!
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন
একজন বললো দেখো ভিতরে নবীন
হাতের আঙুলগুলি আরক্ত কবরী
রক্তমাখা বুক জুড়ে স্বদেশের ছবি!
হে বাঙালি যিশু ][ মুহম্মদ নূরুল হুদা
চল্লিশ বছর যায়, তোমাকে স্মরণ করে তোমার বাঙালি;
চল্লিশ হাজার যাবে, তোমার শরণ নেবে তোমার বাঙালি।
সতত বহতা তুমি জন্মে-জন্মে বাঙালির
শিরায় শিরায়
সতত তোমার পলি হিমাদ্রি শিখর থেকে
বীর্যের ব্রীড়ায়
দরিয়ায় দ্বীপ হয়ে যায়, যে-দরিয়া বাংলার সীমানা বাড়ায়,
যে-দরিয়া তোমার তরঙ্গ হয়ে কাল থেকে
কালান্তরে যায় :
আজন্ম বাঙালি তুমি, আমৃত্যু বাঙালি,
তুমি নিত্য-বিবর্তিত এই লালসবুজের
জাতিস্মর মায়ায়-ছায়ায়।
সেই কবে নেমেছিলে মধুমতী-তীরে, অনন্তর শৈশবের ঘুরন্ত লাটিম
গঙ্গা-পদ্মা আর জাতিমা-র সুখী-দুখী
নীড়ে; সীমা নয়, চিনেছো অসীম;
যৌবনে গিয়েছো চলে পল্লীমা-র কোল ছেড়ে
দেশমা-র সব আঙিনায়,
তোমার পায়ের চিহ্ন এ বাংলার ঘরে-ঘরে,
সব ধর্ম-বর্ণ-গন্ধ, বাঙালির সব মোহনায়।
না, তুমি আর শরীরী মানুষ
নও সব ক্ষণ-জীবিতের মতো;
না, তুমি আর অশরীরী ছায়া
নও মৃত্যুময় মৌনতার মতো।
তুমি নিত্য প্রমুক্ত চিত্ততা, তুমি নিত্য স্বাধীনতা, শুদ্ধ মানবতা;
ব্যক্তি তুমি, জাতি তুমি,
তামাটে জাতির বুকে মানুষের
অভ্র-অমরতা।
তোমার শরীর এক মাটি-বীজ, শস্য তার বেড়ে যায় জ্যামিতিক হারে;
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ-মাইলের সীমানায়
তোমার দেহের মাপ নেই শুধু আঁকা;
তোমার অনিদ্র আত্মা অনঙ্গ উড়াল-সেতু
মহাজীবনের এপারে-ওপারে,
বিশ্ববাঙালির হাতে দেশে-দেশে
কালে-কালে
তুমি সার্বভৌম বাঙালি পতাকা।
ঘাতকেরা আত্মঘাতী, সময়ের রায়ে তারা নিশ্চিতই নির্বংশ সবাই,
নির্বীর্যের দেশে গত, তারা তো করে না আর বংশের বড়াই ।
বাঙালি বীরের জাতি, তুমি সেই চিরঞ্জীব মানবিক শিখা,
কালের কপোল-তলে তোমার পতাকা আঁকে
বাঙালির চির জয়টীকা।
শিশু তুমি, প্রজন্মের ঘরে-ঘরে আগত-ও-অনাগত শিশু,
যিশু তুমি, তোমার শোণিত-¯্রােতে পাপমুক্ত সন্তানেরা, হে বাঙালি যিশু।
তোমার নিষ্পাপ চোখে প্রজাপতি, শাদা পাল, বিলঝিল, নদী,
হ্রদ-পথ-জনপদ ঘুরন্ত ঘুঙুর হয়ে বেজে
চলে কাল-নিরবধি;
শিশু তুমি যিশু তুমি, তুমি পিতা, বাঙালির জাতিপিতা,
মানবধর্মের শিখা, আদিহীন অন্তহীন ভবিষ্য অবধি।
বাঙালি তোমাকে চায়, তুমি চাও বাঙালির ভালো :
বাঙালি মানুষ হয় বুকে যদি মুজিবের
আলো।
১০-১৭.০৭.২০১৪
কবিতাটি ইংরেজি অনুবাদ
O, the Bangali Jesus
][ Mohammad Nurul Huda
Forty years pass, your Bangalis do remember
you,
Forty thousand may pass, your Bangalis shall
seek refuge to you.
All the times in the veins of the Bangalis,
from one birth to another,
Your alluvial silts flow from the Himalyan
crest, in playful gesture,
Surfacing an island in the sea, extendning
Bengal’s border -
The sea, being your waves, flowing from one
age to another.
Bangali you’re in your dawning, Bangali your’re
in your dying,
Always undergoing an evolution in the
birth-remembering
Shadows and illusions of this Red-and-Green.
Long back you came down to the banks of the
Madhumoti,
Then as a revolving toy of childhood you went
to the huts
Full of joys and sorrows of this
Nation-Mother,
While recognizing the limitless, not the
limit.
In your youth you visited all the courtyards
of
Your Mother Country, apart from the rural
mother,
Your footprints are engraved in all the homes
of Bengal,
Regardless of religion, colour and odour,
In all the estuaries
Of all
the Bangalis.
No, you’re no more a corporeal being surviving
in moments;
No, you’re no more an incorporeal shadow like
death-laden silence.
Eternally free, you stand for intrepidity, liberty
and true humanity;
Individual you’re, you’re the Nation,
In the heart of a Coppery Nation, cuddling
divine immortality.
Your body is a seed of soil, its crops
multiplying at a geometrical rate;
Within the limit of of fifty-six thousand
miles your body is no more contained.
Your soul is sleepless and incorporeal,
A flyover bridging both the ends of time
eternal,
You’re the sovereign flag in the hands of
world-Bangalis for ages all.
The killers are self-murderers, devoid of
offspring at the verdict of time,
Banished in the land of infertility, they no
more take pride in their lineage.
Bangalis are a heroic Nation, you’re their
all-conquering flame;
Your flag upholds the sign of eternal victory
on the cheek of time.
Child you’re, in the homes of geneartions,
born and unborn,
Jesus you’re, the Bangali Jesus, your blood
redeems your children.
Your innocent eyes view the butterflies, white
sails, marshy lands, rivers,
Lakes-walks-habitats go on jingling, turning
and turning in endless gyres;
Child you’re, Jesus you’re, the Father of
Nation,
You’re the flame of human religion,
With no beginning and end, though burning on.
The Bangalis look for you, and you look for
the good of them,
It’s only the light of Mujib that makes the
Bangalis true human.
10-17.07.2014
মহাপ্রস্থানের কিছু চিত্র ][ সিকদার আমিনুল হক

রক্তের গন্ধটা ছিল সমস্ত সকাল। লেক থেকে
মাছ ডুব দিলো অহিংসার তলদেশে। কিন্তু ওপরের
মানুষের তৃষ্ণা খোঁজে বারুদের গন্ধ; ফলে
বর্বরের উচ্চাকাক্সক্ষা একজন বিশাল মানুষ
কিংবা, পাহাড়কে চায়। অচিন্তিত তিনি; তাছাড়া তো
মনে হচ্ছে বাংলাতেই কথা বলে, নীচে, অন্ধকারে!
আজীবন শুনেছেন পাঞ্জাবি, বালুচ, সিন্ধি আর
পশতুতে গালাগাল; চারপাশে এরা তো বাঙালি
বললেই ফিরে যাবে। কিন্তু হ’লে সজারুর কাঁটা
যখন বেরোয় রাতে, পশুগন্ধ থাকবে নির্ঘাৎ।
চশমা চোখেই ছিল, গলালেন মিহিন পাঞ্জাবি।
‘কী চাস এখানে তোরা?’ কিন্তু দরকার ছিল তাঁর
উচ্চস্বরে সম্বোধন, -‘তুমিও ব্রুটাস?’ …সে মূষিক
তখন লুকিয়ে ছিল ছিপ ফেলে আগামসি লেনে।
চিরকাল ছিল তার খর্বতার কষ্ট; অতএব,
পাহাড়ের পাদদেশে থাকা যায় কতদিন আর!
রাত্রিকে লেলিয়ে দিয়ে সাপ ছিল তখন গুটিয়ে।
দস্যুরা লাফিয়ে পড়ে; তারও আগে আরও ছোট সাপ
তৃণের সবুজে গিয়ে মিশে যায়, শেষ জয় তারই!
পবিত্র রক্তের ধারা চলে গ্যালো নীলিমা পেরিয়ে।…
স্মৃতি ][ জাহিদুল হক
তোমার স্মৃতি কি সূর্যের মতো জ্বলে?
বাংলার পথে পথে তারা কথা বলে।
তোমার বুকের মানচিত্রের কাছে,
উজ্জ্বল সেই আগামী দিনটি জ্বলে।
পদ্মা ভোলে নি ভোলে নি মেঘনা নদী
তোমার পতাকা অমলিন নিরবধি,
তুমি আজ নেই, তবু মানুষেরা ভাবে
হঠাৎ কখনো ফেরে মুজিবর যদি।
ভিন্ন আকাশ খুঁজছি ][ কাজী রোজী
সেই থেকে একটি ভিন্ন আকাশ খুঁজছি
যেখানে সূর্যের দাগ ছুঁয়ে রক্ত রঙ খেলবে- সোনা রঙ হাসবে।
যেখানে মেঘ বিদ্যুৎ ঝড় ঝঞ্ঝা থাকলেও
স্পষ্ট প্রতিভাত হবে স্বচ্ছ আরশিতে রাখা আমাদের চিরচেনা প্রিয় মুখ।
সেই থেকে একটি ভিন্ন আকাশ খুঁজছি
যেখানে রোদের পাখির গানে থেমে যাবে বর্ষা নূপুর… কুয়াশা দুপুর।
যেখানে ঝলসে যাওয়া তীব্র দাহ থাকলেও
স্পষ্ট প্রতিভাত হবে স্বচ্ছ আরশিতে রাখা নিবিষ্ট ভালোবাসা মুখ।
সেই থেকে একটি ভিন্ন আকাশ খুঁজছি
যেখানে চাঁদের জ্জ্যোৎস্না ঢালা সমুদ্দুরে
মেঘের আড়ালে মেঘ গুঁড়ো গুঁড়ো ভাঙে।
যেখানে ঘন অমাবস্যার অপ্রতিরোধ্য নীল নকশা থাকলেও
স্পষ্ট প্রতিভাত হবে স্বচ্ছ আরশিতে রাখা বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানের মুখ।
সেই থেকে একটি ভিন্ন আকাশ খুঁজছি
যেখানে পঁচাত্তরের পরে সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতো
বারবার সেই সিঁড়িতেই থমকে দাঁড়ায় সব।
যেখানে সিঁড়ির দাগে
জাতির পিতার নাম মুছে দিতে চাইলেও
স্পষ্ট পৃতিভাত হবে স্বচ্ছ আরশিতে রাখা বঙ্গবন্ধুর মুখ।
সেই থেকে একটি ভিন্ন আকাশ খুঁজছি
যেখানে হাজার নয়নতারা পাহারা দেবে
দুর্বিনীতকাল উপেক্ষা করে বাতাসে সবুজের বিশ্বাস আনার জন্যে।
যেখানে স্পষ্ট প্রতিভাত হবে
স্বচ্ছ আরশিতে রাখা একটি মুখের পরে লক্ষ জনতার মুখ।
সেই থেকে একটি ভিন্ন আকাশ খুঁজছি
সেই স্বাধীনতা খুঁজছি খুঁজছি সেই ইচ্ছের তুলি রঙ
যেখানে সেই ইচ্ছে প্রিয় মানুষটাকে
এঁকে যাব আমি তারপর নতুন আর এক
তারপর আরও নতুন আর এক
তারপর শেষ পৃথিবীর আর এক নতুন।
স্বাপ্নিকের মৃত্যু ][ খোন্দকার আশরাফ হোসেন
পায়ের পাতায় বিঁধেছে তোমার কাঁটা
তুমি যাবে দূরে যাবে দূরে যাবে দূরে
তোমার জন্যে মাঠে বিনষ্ট ধানেরা বিছায় বুক
তোমার জন্যে শামলী নদীর হৃদয় ফেটেছে রোদে
চোখের সামনে ধু ধু বালুকার মৃত্যুতে ভরা চাঁদ
তোমার দু’চোখে স্বপ্নেরা ছিল ভরা যুবতীর ক্রোধ
যেহেতু পৃথিবী খাবলে খেয়েছে ক্ষুধিত বাঘের নোখ
তুমি যাবে দূরে যাবে দূরে যাবে দূরে
তোমার জন্যে গোহালে বাছুর দুধের তৃষ্ণা ভোলে
তোমার জন্যে মেঠো ইঁদুরের দাঁতেরা শানায় ছুরি
কৃষকের চোখে নষ্ট ধানের শীষের বানানো ফাঁদ
পায়ের পাতায় বিঁধেছে তোমার কাঁটা
তুমি যাবে দূরে যাবে দূরে যাবে দূরে
তোমাকে খেয়েছে তোমার স্বপ্ন-পথিকের উদ্যম
নমিত গমের পূর্ণ খোয়াব বুকের পাঁজরে নিয়ে
ঘুমহীন চোখে হেঁটে যাও তুমি কালের হালট ধু ধু
হৃদয়ে রক্ত, জামায় ঘামের চন্দন-কর্দম
তুমি যাবে দূরে যাবে দূরে যাবে দূরে
কতটা দূরের স্মৃতির গোহালে ঝরে দুধ যেন আঠা
যেখানে বাঘেরা ভুলে যায় প্রিয় নরমাংসের স্বাদ
শিশুর চোয়ালে চুমু খেয়ে যায় পুষ্ট স্তনের বোঁটা
সিংহ-পাড়ার নীল বুনোঘাসে হরিণেরা খেলা করে
তোমার মৃত্যু দিয়ে যাবে শুধু স্বপ্নের চোরাবালি
তোমার পায়ের পাতায় বিঁধেছে গোলাপের ভুল কাঁটা
তোমার জন্যে শূন্য বাটিত জমা হবে লাল ক্রোধ
খঞ্জ পথিক উধাও চরের ভ্রান্তিতে দিশাহারা
তোমার কাফনে কর্দমমাখা পায়ের স্বপ্ন মোছে
তুমি যাবে দূরে যাবে দূরে যাবে দূরে
শোনো, একটি মুজিবরের থেকে
কথা: গৌরী প্রসন্ন মজুমদার ।। সুর: অংশুমান রায়
শোনো, একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।।
সেই সবুজের বুক চেরা মেঠো পথে,
আবার এসে ফিরে যাবো আমার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাবো।
শিল্পে কাব্যে কোথায় আছে হায় রে
এমন সোনার দেশ।
বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ,
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা
রূপের যে তার নেইকো শেষ, বাংলাদেশ।
‘জয় বাংলা’ বলতে মনরে আমার এখন কেন ভাবো,
আমার হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাবো,
অন্ধকারে পুবাকাশে উঠবে আবার দিনমণি।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উর্দূ কবিতা ভোর কোথায়?
মূলঃ মীর গুল খান নাসির ][ অনুবাদ: রিজওয়ান উল আলম
বেলুচিস্তানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মীর গুল খান নাসির (১৯১৪-১৯৮৩)।, তিনি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিজ জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলার কারণে এই বালুচ কবি পাকিস্তানি শাসকদের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বাংলাদেশে একদল বিপথগামী সেনার হাতে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন, তখন মীর গুল খান নাসির ছিলেন হায়দরাবাদের কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী। কারাগারে বসে, বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৪ দিন পর ২৯ আগস্ট তিনি এই কবিতাটি লেখেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এটাই সম্ভবত প্রথম কবিতা, যাতে মীর গুল খান নাসির যথার্থভাবেই জাতীয় জীবনে এই হত্যার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং সাম্রাজ্যবাদী চক্রের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। বালুচ ভাষায় লেখা কবিতাটি ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। এখানে ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষান্তর প্রকাশ করা হলো:
চিৎকার, ক্রন্দন আর শশব্যস্ত আহ্বানের মাঝে
উল্লাস করছে অন্ধ জনতা।
ওরা বলে, ‘এখন ভোর’, কিন্তু জীবনপানে তাকিয়ে
আমি দেখি রাত্রি, ঘোর অমানিশা।
বিদ্যুৎ চমকানো আর বজ্রপাতে মনে হয় দূরে বৃষ্টি হচ্ছে,
কিন্তু বাতাসে বৃষ্টির নাম-গন্ধ নেই
রক্তের ধারা বইছে প্রবল।
হে নির্বোধের দল, কোথায় উজ্জ্বল প্রভাত?
এখানে এখনো ক্রুদ্ধ রাত
এজিদরূপী সাম্রাজ্যবাদীরা এখনো চূর্ণ করছে
সাহসী দেশপ্রেমিকের হাড়,
জনবহুল, চিত্রময় বাংলাদেশে আবারও রক্তের ঝড়।
সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা আবারও জ্বালিয়ে দিচ্ছে গ্রাম-নগর,
মহান দেশপ্রেমিক মুজিব নিজ রক্তের সাগরে শায়িত
সাম্রাজ্যবাদের অভিশপ্ত সেবাদাসেরা তাঁকে
রক্তের জামা পরিয়ে দিয়েছে এবং বিদ্ধ করেছে বুলেটে
এজিদের বিরুদ্ধে হোসেনের কাহিনির পুনরাবৃত্তি।
হে সাহসী কমরেডগণ, এজিদ থেকে সতর্ক হও,
তোমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হও, পরাস্ত হবে তারা
তাদের মুখ তাদেরই কিন্তু জবান সাম্রাজ্যবাদীদের।
সেবাদাসেরা ব্যর্থ হয়েছে এবং তাদের পকেট স্ফীতকায়
এবং সাহসী দেশপ্রেমিকদের খতম করে দিতে
সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে জোগান আসতেই থাকবে
তারা পাঠাবে ভাড়াটে লোক ও অস্ত্র
এই কাপুরুষদের কোনো দয়া-মায়া নেই,
এদের কারণেই বিশ্বে এখন ঘোর অন্ধকার।
মুক্তির শিখা কোথাও জ্বলে উঠলে এরা তা নিভিয়ে দেয় দ্রুত
বঙ্গবন্ধু মুজিব সপরিবারে নিহত ওদের হাতে
আবারও, স্বাধীনতার পতাকা অর্ধনমিত।
সাম্রাজ্যবাদীরা আবারও ফিরে গেছে তাদের সেই পুরোনো
চক্রান্তে, বিশ্বাসঘাতকতায়
আবারও দ্বন্দ্বের ফয়সালা হচ্ছে বন্দুকের নলে
আবারও সোনার জমিনে জ্বলছে আগুন
হে বন্ধুরা, এভাবেই সময়ের মুখোমুখি আমরা
আমার মাতৃভূমি বেলুচিস্তানও জ্বলছে এখন
ভয় পেয়ো না হে সাহসী যোদ্ধারা, থেমে যেয়ো না,
কণ্টকিত দুর্গম পথ এখনো অনেক বাকি।
মুজিবের রক্ত কখনোই বৃথা যাবে না,
দেশপ্রেমিকের জন্য এ এক অগ্নিপরীক্ষা।
বেশিক্ষণ নয়; কুয়াশা ও আঁধার সত্ত্বেও
এই ভয়াল রাত্রি দ্রুত কেটে যাবে
হূদয় দিয়ে নাসির স্পষ্ট দেখতে পায়
বিজয়-পতাকা উড়ছে।
==================================================================
বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিক নতুন কবিতা
---------------------
শোকস্রোতে এক রত্তি পদ্ম ][ সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
পূর্বে বন্দনা করি, পশ্চিমেও। বন্দনা করি উত্তরে আকাশে শেষ প্রান্তে, দক্ষিণে পায়ের পাতায়। বৃষ্টি এবং বৃক্ষের বন্দনা করি, বন্দনা আকাশের, বাতাসের, ইতিহাসের। জোড়াসাঁকো আসানসোলের বন্দনা; বন্দনা মাহুতটুলি, বিক্রমপুরের, বন্দনা করি কুড়িগ্রামের; আর যাবতীয় বন্দনাসমগ্র টুঙ্গিপাড়ার জন্য।
আগষ্টের কষ্টে শ্রাবণের মুশল ধারায় ভিজতে থাকে বাংলাদেশ। অজস্র মেঘমৃত্যুর বারিধারায় শোকস্রোতে ভাসে থাকে একটি রক্তিম পদ্ম।
হৃদয়ের রজনীগন্ধা ][ গোলাম কিবরিয়া পিনু
এসো, আমরা মাটির সাথে মিশে যাই
লজ্জায়! লজ্জায়!
তাঁর মৃত্যুদিনে কীভাবে দাঁড়াই
রঙিন সজ্জায়!
আমরা কি এত দীনহীন।
যে দিল বুকের রক্ত, যে দিল পরিচয়ের ভিতমাখা মাটি
যে দিল মন্ত্রী, নেতা ও জেনারেলদের পতাকাশোভিত দিন
তাঁকে কেন করতে চেয়েছি বারবার অমাবস্যায় বিলীন।
আমরা এতটা কেন কাঙাল-ভিখিরি
নিজের ঝোলায় সব টেনে নিতে নিতে
নিজের ও ইতিহাসের কী করেছি ছিরি!
আমরা মাথাটা শুধু রাখি- বিবেক রাখি না নিজের মাথায়
ক্ষমতা ও স্বার্থের হিসেব শুধু নিজের খাতায়,
যে দিল গোলাটা ভরিয়ে সোনালি ধানে
সে তো নেয়নি কিছুই নিজেকে ছাড়া তাঁর অস্তর্ধানে
প্রিয় দেশ ও জনতা শুধু ছিল তাঁর বুকভরা অভিধানে।
কোথায় রেখেছি বলো তাঁকে?
ইতিহাস একা একা তাঁর ছবি আঁকে
অন্ধকারে জ্বালিয়ে মোমবাতি,
নিভাতে পারে না সেই আলো কোনো মাতাল হাতি।
ভালোবাসার বিপরীতে
হিংসুটে বিষকালো ডেঁয়োপিঁপড়েরা
লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোন মরণদেবীর গীতে,
যতই হোক না সময় ও কাল বন্ধ্যা
মুজিবের জন্য নষ্ট হবে না হৃদয়ের রজনীগন্ধা।
প্রান্তের আকাশ ][ আবু মকসুদ
পৃথিবীর প্রান্তে একজন মানুষ জন্মালে
আমি জিজ্ঞাসিত হই, ইচ্ছুক উত্তরে
আমার আত্মা মানব জনমের দৃঢ়তায়
মোহনীয়তায়, কমনীয়তায় আপ্লুত হলে
প্রান্তের আকাশ দেখায় উজ্জ্বল তারা।
কপর্দকশূন্য অস্তিত্বে অনাদি আত্মা
আবশ্যিক কারণে ভগ্ন মনোরথে
ধাবিত হলে তারার উজ্জ্বলতা
দিক ভ্রষ্ট নাবিকের
কম্পাসের মত আস্থায় ফিরে আসে।
আমি ভাবি- একদিন সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে
পরে নিতে হবে আগুনের মুকুট
বিকেলের রোদে বাড়ি ফিরে
পুনরায় দাঁড়াতে হবে শপথের মাঠে।
আমার পৌরুষ পিতা মানুষের মাঠে
তর্জনী হেলিয়ে ছিলেন
পিছু নিয়েছিল লক্ষ কোটি মুষ্টিবদ্ধ হাত
তাঁর শিক্ষায়, পথ নির্দেশনায়
মানুষ শিখেছে সূর্য করায়ত্তের বিদ্যা
পৌরুষ পিতার পদতলে
গড়াগড়ি খেয়েছে সময়
তর্জনীর বিভায় পুড়েছে
অসংখ্য কালের রাখাল।
তাঁর উচ্চতায় হিমালয় খাটো হলে
অবাক লাগে না, নিজস্ব জীবন মন্থনে
পাওয়া অমৃত পান করে
পিতা পেরিয়েছেন অমরত্বের সকল স্তর
জগতের যাবতীয় অর্জন তাঁর তেজের কাছে তুচ্ছ।
আমার পৌরুষ পিতা আকাশের প্রান্তে
হয়ে আছেন ঝলমলে আকাশ
ছেয়ে আছেন বাংলাদেশ- বাঙালির অন্তরীক্ষ
এ জাতির ঈশ্বরত্ব তাঁকেই মানায়।
স্মৃতি নেই, শূন্যতাও ][ আহমেদ স্বপন মাহমুদ
স্মৃতি নেই, শূন্যতাও।
গুল্ম ও নদীরেখার কথা মনে আছে--
সামান্য প্রেম যেভাবে জ্বলেছিল অসামান্য জলে
মনে আছে-- শুভবার্তা প্রভাতের, সঘন
গনগনে উত্তাপ ও অস্থিরতা লয়ে
চোখ যেভাবে অনিদ্রায় কাঁপছিল চেয়ে চেয়ে
মন নাচছিল যার কথা ভেবে, তার কথা।
স্মৃতি নেই, হত্যাকারীও, আড়ালে
রেখে যাওয়া ‘মনে রেখ’ পড়ে আছে
নীরব, গহন বেদনার কাছে জমেছে ঋণ
মলিন সুতোয় জড়ানো কারুকাজ দেখে।
তারপর রক্তনদী, হত্যামুখর পরিণয়!
বংশপিতা ][ মুজিব ইরম
তুমি তো কবিই ছিলে পিতা...
মানব-উদ্যানে তুমি দিয়েছিলে ডাক কবিতা-প্রণাম...
সেই মার্চ
সেই সপ্তম দিবস
সেই বংশ-জাগা দিন
তুমি তো কবিই ছিলে পিতা...
আজও আমি কুলজি গ্রন্থের খুঁজে রাত জেগে রই
আজও আমি শুনতে পাই শব্দের ঝলক, তোমার তর্জনী...
এই দেহের ভিতর জেগে রয় টুঙ্গীপাড়া
জন্মে-পাওয়া নাম
বংশের আছর...
এই বংশে তুমি আজও শব্দ-অধিপতি, বংশ-কুলপতি...
তুমি তো কবিই ছিলে পিতা...
মধ্য আগস্টের পনের তারিখে ][ মাহফুজ পারভেজ
রাজনীতি দিনে দিনে বড় হচ্ছে নাকি ছোট?
দূরে যাচ্ছে নাকি কাছে আসছে; কিংবা
অন্যকিছু ঘটছে দূরে বা কাছে- আদিম অজ্ঞাতে?
আসলে যা হচ্ছে, তা হলো, জটিল খেলা:
রাজনীতিবিদ আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর কাছে নয়,
আসল হিসাব-পত্র আর পরিমাপ এখন দর্জির লম্বা প্যাঁচানো-ফিতায়-
প্লেটোর এথেন্সে বা মেকিয়াভেলির ইতালীতে
এমন কি, কৌটিল্য বা নিজাম-উল-মুলকের মুলুকেও নয়-
ঘটনাসমূহ ঘটছে অন্যত্র; গোপন দরবারের লুকনো পাশা খেলায়
খেলা থেকে বাস্তবের সাম্রাজ্যবাদী সার্কাস মাঠে;
ভোজবাজির জাদুর মতো পাশের বাড়িটি চলে গেছে বহুদূরে
প্রিয় লোকটি আড়ালে
স্বজনেরা শত্রু এবং
আত্মকলহের মহাভারতের পৃষ্ঠা সর্বত্র ছড়ানো...
তবুও আমরা টের পাচ্ছি না যে ছোট হচ্ছি নাকি বড়
তবুও আমরা টের পাচ্ছি না যে কাছে আসছি, না দূরে যাচ্ছি?
হায়!?
শেষবাতিঘরটিও সমূলে ভেঙে দিল
মধ্য আগস্টের পনের তারিখে;
তারপরও আমরা অনেক কিছুই টের পাচ্ছি না ভোতা-চৈতন্যে...
চট্টগ্রাম, আগষ্ট ০৯, ২০১৪
পরিস্থিতি ][ পিয়াস মজিদ
আনে আনে
ওরা সব আনে
সস্যুর আনে
ফুকো আনে
আনে দেরিদা
উত্তর-উপনিবেশ থেকে উত্তরাধুনিকতা
কিংবা জাঁক লাঁকা।
শুধু শেখ মুজিবের নাম আনতে মানা
এই নাম মুখে আনলে
যেহেতু খসে পড়ে
পাকি-খোয়াবের
সমুদয় চান-তারা...
অগাস্টের শোকাহত পঙ্ক্তি][নাজিম শাহরিয়ার
মনেরেখো,
সেই রাতের তারারা ছিল সাক্ষী,
সেই আঁধারের ক্রন্দন
আমাদের বুকে নিয়েছে ঠাঁই,
ক্ষয় নাই, তোমার ক্ষয় নাই.....
জেগে আছে এই নিঃশঙ্ক নিসর্গ
জেগে আছি আমরা সবাই....
আগস্ট পনেরো ][ ফারহান ইশরাক
বললো শয়তান, অস্ত্রই উস্কে দিয়েছে হাত; বলেছে আমার
স্বয়ংক্রীয়তা তোমার একটু সহায়তা চেয়েছে মাত্র
হাত নয়, হাতিয়ারই কৃতকারিতার দায়ভার বুঝে নেবে!
‘মারণাস্ত্রেরও একান্ত মতামত থাকতে পারে ভেবে সাঁয় দিয়েছি’,
হাই তোলে যক্তিবাদী চিকন শয়তান:
‘তারাপতনের রাত পার কোরে শাদা নক্ষত্র এসে জমিনের ভার
কাঁধে নিতে দ্বিধা করবে না।’
চোখেমুখে রাগের রেখা ফুটিয়ে ছুটে এলো মৌলিক খড়কুটো!
বুকের কণিকা ছলকায়, ফুলে ওঠে শিশিরজনতা। তৃণমূলে
হঠাত শিহরণ: দ্বীপের বলয়ে দাগ টেনে মানচিত্র কাটলো যে,
তাকে ছাড়া কাউকে চিনি না।
খেটে-খাওয়া ফেরেশতার খোরাক শয়তানের গোলাঘর ভেঙে
যে এনেছে, তৃণমূল জলের পক্ষ থেকে প্রণতি তাহাকে
অস্ত্র নিভিয়ে এসো নিহিত শয়তান, ভেঙে দেবো হাতের বিবাদ।
বঙ্গবন্ধু শুধু দল নয়, বাংলাদেশ ][ মাসুদ পথিক
অথবা এই তো সেদিন চুপিচুপি ঘাসবনে
শুইয়ে দিয়ে এলাম
কখনো যে ঘুমায় না, চির জাগরুক আবহমান রাতে
আর এতো ঘাস, হৃদয়ে হৃদয়ে রক্তবাতাসে কত যে খায় দোল
ফলে আমি কোনো অকৃতজ্ঞ সন্তান কিনা, জানি না
যে পথের ধুলোমাখা ঘাস, আর ঘামসিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ওঠে এলাম
আমি কী সময়বাহী দানব অথবা নাগরিক কোলাহলে নিজেকে হারিয়ে ফেলা কেউ
অথবা কেউ দীর্ঘশ্বাসের পাশে নিভৃতকথা বুনে বুনে, তাহার চেতনা সকল
লিখে যাই গল্প-কবিতা, জনমানসের আখরে বিপুল শোকগাঁথা
তবে আজ কার মনে জাগে মাঠের সবুজ দোল, অনুশোচনায় তুমুল
তাদেরও ভালোবেসে যাই সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ভার্চুয়ালে
বাঙালির স্থায়ী ইতিহাস লিখে ভালোবেসে যাই আমির অতলে
সিগনামে মানুষ সমীপে, স্বত:স্ফূর্ত ভাষিকের আপন পিতাকে চিনে নিতে
আর যে চায় তোমাকে দলীয়করণ বিহনে, বীনা প্রটোকলে
তার কাছেই শুনি বঙ্গবন্ধু গভীর হয়ে আছে
দূর মাঠে, ঘাসবনে, ক্লান্তকৃষক মেহনতীর সরল আলাপনে
অথবা তাহার নাম যায় ভেসে দূর মেঘের পালে আর ইথারে
বিলাপ ][ শাহীনা কবির
সেদিন
আকাশে নিকষ আঁধার ছিলো যমদূতের মতো
মেঘের
আচ্ছাদনে ঢাকা পড়েছিলো শ্রাবণের শেষ আকাশ
মিটিমিটি
করে একটি তারাও চোখ মেলতে পারেনি সেদিন
তখন
তোমাকে পাহাড়া দেবার মতো কেউ ছিলোনা পিতা!
যখন
পাহাড়াদার গুলো জল্লাদ হয়ে গিয়েছিলো ঠিক তখন।
রাত
পোহাতে আর ক্ষণিক বাকি,পূব আকাশেও আলো নেই
এমন
সময় ঘাতকেরা বন্দুকের নল থেকে তারার ফুল্কি ছড়াচ্ছে
একটি
দুটি তিনটি করে বেড়েই চলেছে মিছিলে লাশের সংখ্যা
শুকতারাটি
ভয়ে আতঙ্কে আকাশ থেকে ছিটকে পড়তে চাইছে
মসনদের
লোভে পাহাড়াদারদের হাতে ভর করেছে নিপুণ মৃত্যু।
মা'গো তোমার হাতের নুন যাদের পাতের নিত্য
আহার ছিলো
তারা
নুনের দাম দিতে চাইলে, তুমি তা অবলিলায় মেনে নিলে?
ওরা
যে গুনে গুনে বুলেটে শুধিয়ে দিলো তোমার নুনের দাম।
তোমার
ছোট্ট সোনা রাসেলকেও তোমার কাছে পৌঁছে দিল
বেওনেটের
মাথা থেকে তুমি তাঁকে তোমার কোলে তুলে নিলে।
প্রকৃতি
আর সইতে পারলোনা, চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো
শ্রাবণের
বিলাপ বাঁধ মানছেনা আর,অঝোরে ঝরতে লাগলো
পিতা, তোমার রুধিরে ভেসে যাচ্ছে ৩২ নম্বর
থেকে সারা বাংলা,
গঙ্গা, যমুনা,মেঘনা,মধুমতি হয়ে মিশেছে বঙ্গপের জলের সাথে
শাপলারা
হয়ে গেলো রক্তিম, তোমার রক্তের রঙ পরশ করে।
সাগরের
জল ছুঁয়ে যে সুরুজ সেদিন উঠেছিলো সে যেনো একটু
বেশিই
লাল ছিলো,তোমার রক্তের রঙ্গে, অথবা লজ্জা পাচ্ছিলো
ধরণীর
মানুষের কাছে মুখ দেখাতে,দেরি করে উঠেছিলো বলে,
সেই
অন্ধকারে অনেকগুলো হায়েনা মানুষের মুখোশ পড়ে নিল
আড়াল
করে নিলো হিংশ্র স্বাপদ কুৎসিত রুপ মানুষের আদলে।
তিনি ][ হুমায়ূন কবীর ঢালী
তিনি
আছেন, থাকবেন
উপর
থেকে ডাকবেন।
মাথার
উপর ছায়া
পিতার
আদর মায়া।
দুঃসময়ের
মিতা।
তিনি
জাতির পিতা।
১৫ আগস্টের কলঙ্কতিলক ][ আশরাফুল ইসলাম
এ
বাংলার এমন কোন বাগান ছিলনা
যে
বাগানে মুজিব তুমি গোলাপ হয়ে ফোঁটনি;
এ
বাংলায় এমন কোন স্বপ্ন ছিলনা
যে
স্বপ্নে তোমার অনুভবের অস্তিত্ব্য খুঁজে পাওয়া যায়নি;
এ
বাংলার এমন কোন প্রান্তর ছিলনা
যে
প্রান্তর তোমার বজ্রকণ্ঠের আহ্বানে উত্তাল হয়নি।
তাইতো, তোমার বিপ্লবী অঙ্গুলী হেলনে
কেঁপে
উঠেছিল ইয়াহিয়া আর ভূট্টোদের পাক মসনদ,
তোমার
দেখানো স্বাধীনতামন্ত্রে দীক্ষিত বাঙালী গর্জে ওঠে
এক
সাগর রক্তে কিনে- স্বপ্নের স্বাধীনতা।
যুদ্ধজয়ের
অবিনাশী আনন্দে বিভোর বাঙালীর জীবনে
বজ্রপাতের
মতো নেমে আসে ধ্বংসের ভয়াল থাবা,
ক্যালেন্ডারের
পাতা থেকে খসে যায় আরেকটি দিন, ১৪
আগস্ট;
আসে
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫!
অবতীর্ণ
হয় বাঙালীর স্বপ্নহন্তারকের সর্বগ্রাসী ভূমিকায়!!
স্বার্থান্বেষী
জল্লাদদের নিসপিস করা হাতে
রাতের
সুনসান নিরবতার ভেতর উঠে আসে মেশিনগান,
ঘুমজড়ানো
চোখেও তোমার সহজাত দৃঢ়প্রত্যয়ে সিঁড়ি ভাঙ্গা দেখে
আঁতকে
ওঠে জল্লাদদল, গর্জে ওঠে মেশিনগান;
তাদের
বুলেটের আঘাতে তোমার ফিনকি দিয়ে বের হওয়া
পবিত্র
রক্তের মতোই কেঁপে কেঁপে উঠেছিল ধরণী!!
বাঙালীর
স্বপ্নধারক আর গোলাপ মাড়িয়ে পশুত্বের সেই শুরু।
তারপর, শিশু রাসেলসহ তোমার বংশধরদের আর্তনাদে
খোদার
আরশ কাঁপলেও জল্লাদদের হৃদয় এতটুকু টলেনি!
তোমার
লাশের পাশে পড়ে থাকা ভাঙা চশমাটার শূণ্য দৃষ্টিটা
আজো
যেন খুঁজে ফিরে কোন স্বপ্নের সাজানো বাগান,
যে
বাগানে মুজিব তুমি আবারো স্বপ্ন আর গোলাপ হয়ে ফোঁটবে;
কেননা, নিরন্ন আর নিপীড়িতের ব্যথার ভাষাতো
শুধু তোমারই জানা।
যারা
তোমার আর তোমার পরিবারের পবিত্র রক্তে
বত্রিশ
নম্বরে রক্তের আল্পনায়
কলঙ্কতিলক
লেপ্টে দিল বাঙালীর ললাটে;
কেমনে
ভূলি এ ক্ষমাহীন নিষ্ঠুরতাকে!
একটি নির্ভীক তর্জনীর মানুষের নাম ][ তাহমিনা শাহেদ
একজন
দীর্ঘকায় মানুষ,
একটি
সুদীর্ঘ ছায়া,
একটি
জন্ম-যুদ্ধের সৈনিক,
একজন
আজীবন সংগ্রামী পুরুষ,
একটি
দৃপ্ত চেতনার নির্ভীক শরীর,
একজন
আমৃত্যু দেশপ্রেমিক,
একটি
দৃঢ় বিশ্বাসের ধারক,
একজন
স্বপ্নের দেশ গড়ার কারিগর,
একটি
অসাধারণ পতাকার বাহক।
একজন
কালজয়ী বক্তৃতার বক্তা,
একটি
মহান তর্জনীর অধিকারী........
"এবারের
সংগ্রাম 'স্বাধীনতার সংগ্রাম /এবারের সংগ্রাম
আমাদের মুক্তির সংগ্রাম' জয় বাংলা...!
আমরা
সবাই তাঁকে নির্দ্বিধায় বলি, তুমি
আমাদের জাতির পিতা,
তুমি
এই বঙ্গের 'বন্ধু' !!
মুজিব কারো একার না, মুজিব সারা বাংলার ][ রশিদ
আহমেদ তালুকদার
কি
সিংহ পুরুষ তিনি বজ্রকন্ঠ তীক্ষ্ণ চাহনি
তার
দীর্ঘ দেহে পেটানো সাহস আঙুলে আঙুলে নাচে প্রতিবাদ
তার রাজেন্দ্র পদক্ষেপে নড়ে উঠে স্বৈরাচারের মসনদ
তার
উল্টানো কেশের বিনুনিতে প্রশ্রয় পায় নাঙা গ্রাম
মেদিনীর
লাস্যময় যুবক তিনি চিন্তায় দ্বিধায় অংক কষেন অধিকার আদায়ের
আর
প্রত্যাশিত স্বাধীনতার,
মুক্তপুরুষ
তার মন্দ্রিত চিত্ত্বে ভীতিবিহ্বলতা ছিল না মোটেই,
পিপিলিকার
মত, পথ
ভোলা সন্ধ্যা পাখীর মত
জ্যোষ্ঠি
খরতাপের পর গাছের প্রথম সবুজ পাতার মত,
নিরংকুশ
বিনয়ে নতজানু হত
সবাই
এই বাংলায়
তারই
তর্জনীর ডাকে, গ্রাম
থেকে গ্রাম
বন্দর
থেকে বন্দরে গঞ্জে হাটে ঘাটে মাঠে
উদোম
গায় অথবা পোশাকে পানির মত
সমুদ্রের
স্রোত হত ভবদীয় জনতা তারই আহবানে।
এই
একটা মানুষ কি এক যাদু মুগ্ধতার নেশায়
কি
ধনী কি গরীব, কি
সাদা কি কালো, কি
নারী কি পুরুষ
অনায়াসেই
মোহাচ্ছন্ন করে অধিকার আদায়ের কন্টক পথে
হাটাতে
পারতেন লাখো বিংশতি।
মানুষ
টার আশ্চর্য ঐশী ক্ষমতা ছিল
মানুষটা
ঘুমুতেন কম, আহারে
বিহারে উৎসাহ নেই
দিনরাত
মাথায় খেলতো বাংলার স্বাধীনতানাগরিক মুক্তি গাঁথা।
ইনিকি
সত্যিকার মানুষ ছিলেন?
অর্ধনগ্ন
অনাহারী বুভুক্ষু হারগিলা
পূর্বের
মানচিত্রকে, রাতারাতি
কিভাবেই বা তিনি জাগান তবে?
'এবারের
সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'
এই
হুংকারে ঝনঝন করে চাঁদতারা পতাকার পতন হলো
ভূট্টোও
কেঁপে উঠে দুরু দুরু বক্ষে ইয়াহিয়া করে ইয়া নফসি
ইয়া
নফসি,
একবার
মাত্র ডাক তাতেই পাক সিপাহী
তরতর
করে মুক্তিযোদ্ধার কাছে মানে হার
গগন
বিদীর্ণ করে উঠে জয়বাংলা শ্লোগান।
ইনি
মানুষ, না প্রাণের পিতা?
মৃত্যুঞ্জয়ী
পিতা মজিবর মানুষ হও বা স্বর্গের কেউ
অমরত্বের
সুরা পায়ী
হে
জিতেন্দ্রিয় নেতা তোমার তুল্য শুধুই তুমি।
তুমি
একার কারো নও, তুমি
সমগ্র দেশ জনতার।
....................
অলংকরণঃশাহাবিদ্দিন, কাইয়ূম চৌধুরী, হাশেম খান, নাজিব তারেক এবং অন্যান্য শিল্পী। ছবিঃ নাসরিন হক এবং অন্যান্য আলোকচিত্রী।