কেঁদেও পাবে
না তাঁকেঃ তিনি বেঁচে থাকবেন বাংলা কবিতায়...
![]() |
আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমান |
০৭ জুলাই ১৯৮৫, কবি আহসান
হাবীবের মৃত্যুর খবরটা পাই কবি শামসুর রাহমান-এর রুমে। রাহমান ভাই তখন দৈনিক বাংলা‘র সম্পাদক। তাঁর
রুমে ঢুকতেই দুঃসংবাদটা জানালেন। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় আর তিনি অত্যন্ত বিচলিত। আমি
বললাম, এখন কে
আর আমাদের স্নেহের ছায়ায় প্রশ্রয় দেবেন? কার কাছে যাবো!
রাহমান ভাই চেয়ার ছেড়ে আমার কাছে
এলেন। সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
‘আমি তো আছি। আমার কাছেই আসবেন।’
তারপর থেকে রাহমান ভাইয়ের সাথে
ঘনিষ্ঠতা দ্বিগুণে রূপান্তরিত হলো। আগেও দেখা হতো, বিচিত্রায় কবিতা ছাপতেন, আড্ডা হতো। ০৮ জুলাই থেকে শুরু হলো টেলিফোনে কুশল বিনিময়, প্রতিদিন সকালে।
তিনি তখন থাকতেন আউলাদ হোসেন লেনে। সেখান থেকে গেলেন তল্লাবাগ। তল্লাবাগ থেকে
শ্যামলী। আমাদের দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কটাও এভাবে পুরনো ঢাকা থেকে শ্যামলী পর্যন্ত
বিস্তৃত হয়। বিকশিত হয় সম্পর্কের শাখা-প্রশাখা, পুষ্প-পল্লব।
প্রায় প্রতিদিনই ফোনে রাহমান ভাইয়ের
খোঁজখবর নিতাম। এটা যেন নিত্যদিনের কর্মসূচি হয়ে গিয়েছিল। শুক্রবার ছুটির দিনে ফোন
না পেলে তিনি উল্টো ফোন করতেন বা পরদিন বলতেন: ‘কি দুলাল,
কাল ফোন করলে না যে?’
তাঁর পুত্রবধু টিয়া প্রায়ই বলতেন,
‘প্রতিদিন সকালে বাবা আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকেন!’ এভাবেই কেটেছে
আমাদের কুড়ি বছর। ফলে রাহমান ভাইয়ের সঙ্গে পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কটা ছিলো
খুবই গহীন-গাঢ়।
রাহমান ভাই ছোট-বড় বা সমবয়সী সবাইকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন।
একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল আমার ক্ষেত্রে। তিনি আমাকে ‘তুমি’
বলতেন। সে জন্য আমার বন্ধুরাও রাহমান ভাইকে চাপ দেন। অবশ্য পরে হাতে গোনা ক’জনকে তিনি ‘আপনি’ বলা ছেড়ে দিয়ে ‘তুমি’তে নেমে আসেন।
তাঁর প্রত্যেকটি দিনের খবরা-খবর,
আনন্দ-বেদনা-কষ্ট, অসুখ-অসুস্থতা, নতুন লেখা কবিতা
বা কলাম কিংবা গতকালের কোনো-কোনো একান্ত ব্যক্তিগত ঘটনা জানা হয়ে যেত পরদিন। এমনকি
সদ্য লেখা প্রেমের কবিতার অনুপ্রেরণাকারিণীকেও যেন জমা রাখতেন আমার কাছে। তাঁর এই
বিশ্বাস এবং বিরল বন্ধুত্বের বিকল্প নেই।
……………
আমাদের প্রকাশনী স্বরব্যঞ্জন থেকে
তাঁর একমাত্র গল্পের বই ‘শামসুর
রাহমানের গল্প’ এবং
পাঠশালা থেকে ছড়াগ্রস্থ ‘চাঁদ
জেগেছে নদীর বুকে’ বের
হয়েছিল যথাক্রমে ২০০২ ও ২০০৪ সালে।
তাঁর গল্পের বই বের হতে পারে তা তিনি
নিজেও কখনো ভাবেননি। প্রথমতঃ গল্পগুলো তার সংগ্রহে ছিল না, আর দ্বিতীয়তঃ
গল্প মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি!
আমি দীর্ঘ দু বছর ধরে চেষ্টা করে তাঁর
৬টি গল্প (যথাক্রমে সে, একটি
ব্লেড এবং সুরভি, সাযযাদ
আমিনের কথা, গাঙচিল, প্রৌঢ়ের প্রব্রজা, বর্ষারাতে নুপুর
ধ্বনি, না রোদ
না জ্যোৎস্না) সংগ্রহ করি। কিন্তু পঞ্চাশ দশকে লেখা, সোনার বাংলা‘য়
প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্পটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অবশ্য রাহমান ভাই সেটা স্মৃতি
থেকে পুনঃলিখন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য পারেননি। গ্রন্থের ভূমিকায়
তিনি লিখেছিলেন:
“অনেক
বছর আগে আমার লেখক জীবনের একেবারে গোড়ার দিকে হঠাৎ ভৈরবের পুল নিয়ে একটি ছোটগল্প
লিখে ফেলেছিলাম। গল্পটি নলিনী কিশোর গুহ সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা সোনার বাংলা’র প্রকাশিত হয়। এরপর বহুকাল গল্প লেখার কোনো চেষ্টা করিনি।
দীর্ঘসময় কেটে যাওয়ার পর অধুনালুপ্ত সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় সম্পাদক
গাজী শাহাবুদ্দিন-এর অনুরোধে এবং অনুপ্রেরণায় ‘সে, একটি ব্লেড এবং সুরভি’ নামে একটি গল্প লিখি, ১৯৮৬ সালে। গল্পটির তারিফ করেন কেউ কেউ। উল্লেখ্য, গল্পটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে নাট্যরূপ দেন কবি সাইফুল্লাহ
মাহমুদ দুলাল এবং সেটি প্রচার হয় ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ তারিখে।
এরপর দীর্ঘদিনের বিরতি। আবার নব পর্যায়ে প্রকাশিতসন্ধানী
পত্রিকার সম্পাদকের তাগিদে আরেকটি গল্প লিখতে হয়। আবার ছেদ পড়ে গল্প লেখায়।
বেশ কিছুদিন পর ভোরের কাগজ-এর তদানীন্তন সাহিত্য সম্পাদক
সাজ্জাদ শরীফের আগেকার আমলের সুদ আদায়কারী কাবুলিওয়ালার মতো নাছোড় তাগাদায়
দু-তিনটি গল্প লিখতে হয়। হ্যাঁ, এর আগে কবিদের লেখা গল্প সঙ্কলনের জন্য গাঙচিল নামে একটি
গল্প লিখে উঠতে পেরেছিলাম।
এই হলো আমার গল্প লেখার তুচ্ছ, অতিশয় ক্ষুদ্র ইতিহাস। এই সামান্য কয়েকটি গল্প সংগ্রহ করে
কবি-প্রকাশক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল একটি ক্ষুদ্রাকার পুস্তক প্রকাশের প্রস্তাব
পেশ করেন আমার কাছে। আমি তাঁর অনুরোধ ঠেলে দিতে পারিনি। তাঁর আগ্রহ লক্ষ করে বেশ
বিস্মিতই হয়েছিলাম। গল্পের বইটির আয়তন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আরো দু-একটি ছোট গল্প
লেখার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয়েছি। যা হোক, যাঁরা আমাকে দিয়ে গল্প লিখিয়ে নিয়েছেন এবং যারা কিছু
তারিফের বদান্যতা দেখিয়ে আমাকে ধন্য করেছেন তাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। প্রকাশকের
সাহসের প্রশংসা না করলে অন্যায় হবে”।
বইটি আমাকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু আমি নিজে প্রকাশক আবার আমাকেই উৎসর্গ করা হলে তা শোভন হয় না। পরে তাই পুত্র
ফাইয়াজ-এর স্ত্রী টিয়াকে উৎসর্গ করেন।
বই প্রকাশের অনেক আগেই সে, একটি ব্লেড এবং
সুরভিপ্রচারিত হয় বাংলাদেশ বেতারে। এবং সাযযাদ আমিনের কথা বিটিভিতে নাট্যরূপ দিয়ে
প্রচার করলে তিনি খুব খুশী হন এবং ধন্যবাদ দিয়ে তৎকালীন ডিজি সৈয়দ সালাহউদ্দিন
জাকী, প্রয়োজক
সৈয়দ জামান এবং চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক হিসেবে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি দেন।
এরকম তাঁর অনেক চিঠি, চিরকুট আছে, আছে একটি
অপ্রকাশিত কবিতা এবং অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার।
পাক্ষিক তারকালোক-এর সম্পাদক এক ঈদ
সংখ্যার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেন ‘১০০
প্রশ্নের কাঠগড়ায় কবি’-নামে
একটি প্রশ্নোত্তর নির্ভর প্রতিবেদন তৈরির,
রাহমান ভাইকে নিয়ে। আমার তৈরিকৃত এবং অনুজ শিহাব শাহরিয়ার-এর ধারনকৃত ২৬টি
জবাব দিয়ে ছিলেন, বাকি ৭৪টি
জবাব আর দেয়া হয়নি। রাহমান ভাইয়ের সেই ২৬টি উত্তর আমার ঢাকাস্থ বাসায় বাক্সবন্দী।
বাইরে থেকে রাহমান ভাইকে দিব্য ও
দ্বীপ্ত নায়কের মতো উজ্জ্বল মনে হলেও তাঁর ভেতরে ছিল অনেক বেদনা। অতি নীরবে বহন
করতেন সেই বেদনার স্রোত। রাজনৈতিক,
সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন
ঘটনাও তাকে নানাভাবে কষ্ট দিতো। সেই দুঃখ-কষ্ট, যাতনা-যন্ত্রণাকে ধারণ করে হিরন্ময় রত্ন উপহার দিতেন–যে রত্নের
নাম-কবিতা।
যদি শুধুমাত্র তাঁর রাজনৈতিক কবিতার
কথাই বলি, তাহলে
দেখা যাবে বাঙালি এবং বাংলাদেশের ধারাবাহিক রাজনীতির উত্থান-পতনের সাথে স্বর্ণলতার
মতো জড়িয়ে আছে রাহমান ভাইয়ের কবিতা। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ষাট দশকের ছয় দফা, ঊনসত্তরের
গণআন্দোলন, একাত্তরের
মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা
অর্জন, পচাঁত্তরের
নির্মম হত্যাকাণ্ড, জেলহত্যা, সামরিক শাসন, স্বৈরাচার, রাজাকারদের প্রতি
ঘৃণা, গণআন্দোলন–কি নেই তাঁর
কবিতায় ? কখনো-কখনো
চমৎকার প্রেমের পঙক্তির মধ্যেও রাজনৈতিক সত্য নিপুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন: সরকারি
প্রেসনোটের মতো মিথ্যে তোমার প্রেম।
রাহমান ভাইয়ের সাথে বহু বিষয় নিয়ে
বিতর্ক বা মতান্তর হয়েছে,
তবে মনান্তর নয়। রাগ-জেদ করে কথা হয়নি বেশ কিছু দিন। তারপর আবার সরল মনের বরফ
গলেছে।
বিদেশে গেলেই তিনি আমাকে চিঠি
লিখতেন। ফ্লোরিডা, টোকিও
এবং কলকাতা থেকে যে চিঠিগুলো পেয়েছি,
সেই চিঠিগুলো আজ আমার কাছে অমূল্য স্মৃতিসম্পদ।
এরশাদ তাঁর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী
কাজী জাফরকে পাঠিয়েছেন তল্লাবাগ বাসায়,
বাংলাবাজারের প্রকাশক আজো প্রুফ দেয় নি,
নিউইয়র্কের কৌশিকের কাছ থেকে চোখের ড্রপ আনতে হবে, বিটিভিতে তাঁর
গল্প থেকে নাটকটা কবে যাবে,
আজিজ মার্কেটে টমাস ট্রান্সট্রোমারের নতুন বইটা আসছে কী না, অমুকের নতুন ফোন
নম্বরটা কত, নতুন দু’টি ছেলে বিবৃতিতে
সই নিতে এসেছিল, তাদের
চিনি কিনা, ছোট মেয়ে
শেবা অটোয়ায় চলে যাচ্ছে, ছেলেটার
একটা চাকরি দরকার, হরকাতুল
জেহাদ এসে বাসায় হামলা চালিয়েছে…চিঠিতে
লেখা নিত্যদিনের এসব ঘটনা আজ শুধুই স্মৃতি। আমার মতোই রাহমান ভাইয়ের ‘বন্ধু-ভাগ্য’ খুব একটা ভালো
ছিল না। তাই তিনি তাঁর এক খ্যাতিমান বন্ধুর উদ্দেশ্যে দৈনিক সংবাদ-এ লিখেছিলেন,- “আমার
অনেক বন্ধু জীবিত কিন্তু তারা আমার কাছে মৃত আবার মৃত বন্ধুরাও আমার হৃদয়ে জীবিত”।
তাঁর সাথে তিন দশকের স্মৃতি নিয়ে
অন্তত তিন ফর্মার বই লেখা যায়। লিখবো। আজ ২-৩ টি স্মৃতির কথা উপস্থাপন করবো–রাগের, দুঃখের আর
প্রেমের।
রাগের ঘটনা
বেক্সিমকো থেকে দু’টি পত্রিকা বের
হয়েছিল, কায়সুল
হকের সম্পাদনায় শৈলী এবং কে. জি. মুস্তাফার সম্পাদনায় দৈনিক মুক্তকণ্ঠ।
একবার ঈদসংখ্যার জন্য চিঠি দিয়ে শৈলী’র জন্য কবিতা
নিয়ে তা ছাপালো ঈদসংখ্যার পরবর্তী সংখ্যায়,
তাও মফঃস্বলের এক মহিলা কবির নীচে। দেখে তো মেজাজ খারাপ!
চলচ্চিত্রের পত্র লেখক লিয়াকত হোসেন
খোকনের মতো বাংলা সাহিত্যের পত্র লেখক হিসেবে আখ্যায়িত করে কায়সুল হক‘কে কড়া ভাষায়
তীব্র এক চিঠি দিলাম। সেই চিঠি নিয়ে ‘নালিশ’ করলেন রাহমান
ভাইয়ের কাছে। রাহমান ভাই ক্ষুদ্ধ হয়ে আমাকে ফোন করে ঝগড়া শুরু করে দিলেন, রেগে গিয়ে বললেন
বললেন, ‘তোমার
সাথে কথা নেই।’ আমিও
বললাম, ‘ঠিক আছে।’
বেশ কিছু দিন পর মহিউদ্দিন ভাইয়ের
(মুক্তিযোদ্ধা, পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব) সৌজন্যে এক পার্টিতে রাহমান ভাইয়ের সাথে দেখা। তখনও
রাগের রেশ কাটেনি। কাছে গিয়ে বললাম,
‘কেমন আছেন রাহমান ভাই।’
জবাব দিলেন, ‘আরো আধ ঘন্টা পর
কথা বলবো।’ তার মানে
রাগের জের কমে এসেছে কিছুটা! কিছুক্ষণ পর ডেকে বললেন, ‘ক’টা বাজে?’
আমি বললাম, ‘আধাঘন্টা হয়নি!
এখনো বাকী আছে!’
‘আরে না, আট্টা বাজে কীনা? চোখে ড্রপ দিতে
হবে।’ ঔষধটা
হাতে তুলে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘বড়দেরকে ওভাবে চিঠি দিতে হয় না।’
আমি বললাম, ‘বয়সে বড়
হলেও মনের দিক দিয়ে যাঁরা ছোট,
তাদেরকে আমি ছাড় দিতে রাজী নই।’
তখন রাহমান ভাই আর কোনো কথা না বলে
ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’চোখ মেলে
দিলেন। চোখে ড্রপ নিয়ে বললেন,
‘ঠিক আছে আমি এ বিষয়ে আর তোমার সাথে কিছু বলতে চাই না। এটা তোমার আর কায়সুল হক‘র ব্যাপার।’ আমি বললাম, ‘তাহলে তাঁর পক্ষে
ওকালতি করছেন কেনো?’
রাহমান ভাই বললেন, ‘আমি তোকে পছন্দ
করি, স্নেহ
করি।’
আমিও নাছোড়বান্দা। বললাম, ‘আমাকে পছন্দ
কিংবা স্নেহ করার চেয়ে কায়সুল হক‘র প্রতি
পক্ষপাতিত্বই প্রাধান্য পেয়েছে।
আমাদের মৃদু তর্ক শুনে মহিউদ্দিন ভাই
আমাকে থামিয়ে দিলেন।
এরকম ঘটনা ঘটেছে বেশ ক’বার। কিন্তু
ব্যক্তিগত সম্পর্কে অবনতি ঘটেনি। পারিবারিক সম্পর্কটা তিনি গুরুত্ব দিতেন। যখনই
ডেকেছি, সাঁড়া
দিয়েছেন। আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছেন,
আমার মেয়েকে দেখতে সস্ত্রীক আমাদের মিরপুরস্থ বাসায় গেছেন, ছোটখাটো
অনুষ্ঠানে ডাকলেও ছুটে আসতেন,
আমার অফিস আজিজ মার্কেটে। আমার আবদার-অনুরোধে কখনোই না করেন নি।
দুঃখের ঘটনা
আগে বলেছি–রাজনৈতিক, আর্থিক, মানসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে
তাঁর দুঃখ কষ্টের শেষ ছিল না। যেমন রাজনৈতিক ভাবে চাকরিচ্যূত হন, বড় ছেলের কোনো
চাকরি ছিল না, ছোট
ছেলের অকালে মৃত্যু, মৌলবাদীদের
সাথে লড়াই, কিংবা
কবিতা পরিষদ নিয়ে বিরোধ…..
এরকম অনেক ব্যক্তিগত বেদনা নিভৃতে লালন করতেন।
এরকম একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ১৯৯৯
সালের ১৮ জানুয়ারি হরকাতুল জেহাদ তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর বাসায় আক্রমন করে।
মামলা হয়। সেই মামলার রায় ‘ফসকা
গেরো’ হয়ে
ফুরিয়ে যায়। কারণ, নেপথ্যের
ষড়যন্ত্র ছিলো অত্যন্ত গভীর। কে বা কারা ভেতর থেকে কলকাঠি নেড়ে হাজিরার চিঠি গায়েব
করে দেয়। ফলে, ফলাফল
শূন্য।
তবে তাঁর নিরাপত্তার জন্য শ্যামলিস্থ
বাসভবনে পুলিশ মোতায়েন ছিলো। একটি বাসায় নিয়মিত ২/৩ জন বাড়তি মানুষের
থাকা-খাওয়া-বসবাস কী যে বিড়ম্বনা,
তা পুরো পরিবারকে সহ্য করতে হয়েছে দীর্ঘদিন। নিয়মিত যাতায়াতের কারণে পাহারারত
পুলিশ আমাকে চিনতো। একবার সিফট বদল হওয়ায় রেড সিগনালের মুখে পড়লাম। পুলিশ আটকিয়ে
দিলো। দো’তলায় ঝুল
বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে রাহমান ভাই গ্রিন সিগনাল দিলেন। ভেতরে গেলাম, আড্ডা দিতে দিতে
বললেন, “পুলিশ
মূলতঃ আমাকেই ‘গৃহবন্দী’ করেছে!”
প্রেমের ঘটনা
রাহমান ভাইয়ের প্রেমের ঘটনা প্রচুর।
তাঁর কবিতাই তার প্রমাণ। অন্য কবিদের কবিতা কল্পনার প্রেমের আর রাহমান ভাইয়ের
প্রেমের কবিতা অভিজ্ঞতা থেকে। মজার বিষয় হলো,
এ ব্যাপারে রাহমান ভাবী‘র কোনোই
অভিযোগ ছিলো না। আরো মজার ঘটনা,
প্রিয় পুত্রবধু টিয়া সব জানতেন। শিশুর মতো সরল শামসুর রাহমান খুব খোলামেলা
ভাবে তা শেয়ার করতেন।
একবার অসুস্থ হয়ে ভর্তি হলেন পিজিতে।
পাশের আজিজ সুপার মার্কেটে আমার অফিস থেকে প্রতিদিন দুপুরে খাবার পর বেশ কিছুটা
সময় তাঁর কেবিনে কাটাতাম।
একদিন দুপুরে তাঁকে খুব অস্থির মনে
হচ্ছে। বার বার জিগ্যেস করছেন,
‘ক’টা বাজে?
এখনো দু’টো বাজে
নি? দুলাল, তুমি কখন উঠছো, কোনো কাজ নেই?’
রাহমান ভাইয়ের কথাবার্তা, কান্ডকারখানা
দেখে টিয়া মুখ টিপে হাসছেন। কিন্তু কিছু বলছেন না। পরে বিষয়টি বুঝতে পারলাম। তিনি
কারো জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কাঙ্খিত ব্যক্তির আগমনের জন্য জামাকাপড়
পাল্টিয়ে প্রস্তুতি নিলেন। চুল আঁচড়ালেন। বিছানা গুছিয়ে ঠিকঠাক করে দিতে বললেন।
তখন টিয়া বললো, ‘এটা তো
নার্সদের কাজ।’
অবশেষে নির্দ্রিষ্ট সময়ের ১৫/২০ পর
ডিউটির রদবদলে নতুন শিফটের নার্স এলেন। রাঙা হয়ে উঠলেন রাহমান ভাই। একটু অভিমানে,
রেগে কর্মরত নার্সকে বললেন,
‘তোমার ডিউটি কয়টা থেকে?
দেরি করে এলে কেনো। না এলেই পারতে।’
নার্স হাসছে। টিয়া হাসছে। আমিও।
নার্স তার প্রাথমিক কাজকর্ম করে সেরে
পাশের কেবিনে গেলেন। এই ফাঁকে টিয়া বললেন,
‘দেখুন তো আব্বুর কান্ড! আব্বু কত বড় একজন বিখ্যাত কবি। প্রেম করবেন ডাক্তারদের
সাথে, তা না
করে নার্সের প্রেমে পড়েছেন।’
রাহমান ভাই, আমাকে উদ্দেশ্য
করে বললেন, ‘ভালোবাসার
বিষয়টি তোমরা বুঝবে না। ভালো লেগেছে নার্সকে আর ভালোবাসবো ডাক্তারকে? কী আশ্চর্য!’
হ্যা, এ ধরনের অনেক আশ্চর্য রকমের ঘটনা রাহমান ভাইয়ের
ব্যক্তিজীবনে ঝিলমিল করছে,
তাঁর কিছুটা প্রতিফলন পাওয়া যায় তাঁর প্রেম-বিরহের কবিতায়।
রাহমান ভাই, ‘আপনি বাস্তবে
আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু
স্মৃতিতে জীবিত। শুধু স্মৃতিতেই নয়;
আপনার কবিতা জীবন্ত। এই কবিতায় আপনি বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন।
(জঃ অক্টোবর ২৩, ১৯২৯ ।। মৃঃ আগস্ট ১৭, ২০০৬)
আত্মকথন পড়ে খুবই ভালো লাগলো। ধন্যবাদ ।
উত্তরমুছুন