মৃত্যুর পরে আর কিছু নেই এই বিশ্বাসে আমি স্থির
পরজন্ম বা পরলোক বলে কিছু যে নেই
লেখার বিষয়বস্তু সীমাবদ্ধ করে রাখা মেনে নিতে না পেরে আমি পদত্যাগ করি
সাতদিনঃ নিজের লেখালেখিকে আপনি
কি ভাবে মূল্যায়ন করেন?
পূরবী বসুঃ আমি একজন পরিশ্রমী মানুষ। যা লিখি, যখন লিখি,
চেষ্টা ও পরিশ্রম থাকে তাকে যতটা সম্ভব ঘষে মেজে দাঁড় করাবার। তারপরেও বুঝি, যা লিখতে চেয়েছিলাম, যেমন করে লিখতে চেয়েছিলাম, তেমন হলো না।
নিবন্ধ বা প্রবন্ধের বেলায় এরকম বোধ ততটা হয় না, কেননা non-fiction লেখার বেলায় কোন একটি বিষয়ে প্রথমে আমাকে উদ্দীপিত হতে হয়। বিষয়টি সম্পর্কে আমার নিজস্ব ও বিশেষ কিছু বক্তব্য বা মন্তব্য থাকা জরুরী যা যুক্তি-তর্ক ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে গ্রহণীয় বা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাই
হলো আমার কাজ।
সৃজনশীল লেখার বেলায় ব্যাপারটা তেমন সোজা বা সরাসরি নয়। ফলে পরিশ্রম, অধাবসায় সবসময় কাজে আসে না। হতাশা হয় সেখানেই বেশি। তবে একটা কথা বলি। কেউ যদি সত্যি বুঝতে পারে তার লেখা কিছুই হচ্ছে না, সে বেশীদিন লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারে না। ফলে বিনয়ের অবতার হয়ে মুখে যাই-ই বলুন লেখক, যিনি আজো লিখে যাচ্ছেন, মনে মনে নিজের লেখা সম্পর্কে সাধারণত একটি ইতিবাচক ধারনা পোষন করেন তিনি, এবং নিজ লেখার ভবিষ্যত সম্পর্কেও মূলত আশাবাদী।
তবে লেখা শেষ করার পরে যে আবার অতৃপ্তির সৃষ্টি হয়,
সেটাও খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, যা লেখকের মজ্জাগত, যা তার লেখা পরিশীলিত করতে সাহায্য করে। এই ব্যাপারে আমার অবস্থান তাই অতি প্রথাগত, অর্থাৎ নিজের লেখা সম্পর্কে মিশ্র অনুভূতি রয়েছে।
সাতদিনঃ আপনার প্রথম লেখা এবং প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
পূরবী বসুঃ প্রথম লেখার কথা স্পষ্ট মনে নেই। তবে স্কুলের হাতে-লেখা দেয়াল পত্রিকায় পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন লিখিত গোয়েন্দা-গল্প ‘অতীন-হত্যারহস্য’
আমার প্রথম বা দ্বিতীয় লেখা ছিল সন্দেহ নেই। প্রথম গল্পের বই ‘পূরবী বসুর গল্প’ ১৯৮৯ সালে সাহিত্য-সমবায় থেকে প্রকাশ পায়। বইটির নাম দিয়েছিলেন বিখ্যাত গল্পকার - স্বেচ্ছানির্বাসিত কথাসাহিত্যিক শামসুদ্দীন আবুল কালাম।
রোমে বসে তিনি আমার গল্পগুলো সবই পড়েছিলেন। একাধিক চিঠিতে লিখেছিলেন, এ বইয়ের নাম ‘পূরবী বসুর গল্প’ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। আমার সেই প্রথম বইটি ছাড়াও আরো দু’ তিনটি বই তিনি দেখে গেছেন।
প্রথম লেখার দিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত নিজের লেখা ও প্রকাশনার ব্যাপারে বরাবর-ই আমি
দ্বিধান্বীত থাকি। একদিকে খুশি হই, অন্যদিকে অতৃপ্তি থেকে যায়।
সাতদিনঃ বাংলা সাহিত্যের কোন
শাখা তুলনামুলক ভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন?
পূরবী বসুঃ নিঃসন্দেহে ছোটগল্প।
সাতদিনঃ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির
যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
পূরবী বসুঃ প্রশ্নটা জটিল, ঠিক বুঝতে পারলাম কিনা কী জানতে চাইছেন, জানি না। তবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা জীবনে সাহিত্যের গুরুত্ব অথবা প্রতিফলনে কোন নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করি না।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অগ্রগতি ফসলের ফলন বাড়িয়ে, কাপড়জামার দাম হ্রাস করে, বহু ধরণের সংক্রামক ও মেটাবলিক রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ বের করে বা সেগুলো পরিপূর্ণভাবে উৎখাত করে, বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস জানিয়ে দিয়ে মানুষের জীবনে এতোটা নিরাপত্তা এনে দিয়েছে যে মধ্যযুগে, এমন কি ঊনিশ শতক পর্যন্ত-ও
বাংলা সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য ছিল যে প্রকৃতির কাছে মানুষের সম্পূর্ণ উপায়হীনতা, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, গভীর নির্ভরশীলতা,
তা আর আগের মতো নেই।
দারিদ্র, কলেরা-বসন্তের মহামারী, দীর্ঘ জ্বর ও পেটের অসুখসহ বিবিধ সংক্রামক ব্যাধি, বন্যায় ফসল ভেসে যাওয়া,
জায়গা-জমিন,গরু,গয়না বন্ধক দেয়া, জীবিকার অভাব, খাদ্যস্বল্পতা, দুর্ভিক্ষ, অনাহার, যক্ষা, বিষাক্ত সাপের কামড়ে অকাল মৃত্যু এসব-ই ছিল প্রাচীন, মধ্যযুগ ও বিংশ শতব্দীর গোড়া পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের মূল উপজীব্য - প্রধান অবয়ব।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে সাহিত্যের
প্রধান উপজীব্য হয়েছে, দারিদ্র্যের বদলে,
মানবাধিকার, নারী অধিকার, বিশ্বজুরে যুদ্ধহ্রাস ও শান্তিস্থাপন এবং পরিবেশ-বান্ধব সমাজের অন্বেষণের মতো বিষয়সমূহ।
সাহিত্য যেহেতু জীবনের-ই প্রতিফলণ, শুধু বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা কেন,
নিয়ত পরিবর্তনশীল সামাজিক অন্যান্য উপকরণ
যা জীবনকে প্রভাবিত করে তাও আজ সাহিত্যে উঠে আসছে, এবং সেটাই তো স্বাভাবিক।
সাতদিনঃ আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে
কিছু বলবেন কি?
পূরবী বসুঃ আমার প্রিয় লেখক একজন নন। ফলে এ সম্পর্কে বিস্তৃত বলা কঠিন। কোন প্রিয় লেখকের-ই সব লেখা যেমন প্রিয় নয়, এমন কিছু লেখক-ও রয়েছেন, যাদের কয়েকটি লেখা বিশেষ প্রিয় হয়ে আছে, কিন্তু তাঁদের প্রিয় লেখক বলে শনাক্ত করতে পারবো না।।
সাতদিনঃ আপনার নিজের প্রিয় লেখা
কোনটি এবং কেনো?
পূরবী বসুঃ বলা মুস্কিল। তবে গল্পের মধ্যে ‘অরন্ধন’ ও ‘সালেহার ইচ্ছা-অনিচ্ছা’র প্রতি বিশেষ দূর্বলতা রয়েছে।
সাতদিনঃ আপনার লেখালেখির পেছনে
মূল প্রেরণা কি?
পূরবী বসুঃ লিখি প্রধানত নিজের তাগিদেই, বিশেষ কোন বিষয়, ঘটনা, কথা, শব্দ বা বাক্যে আলোড়িত হয়ে। আমি লক্ষ্য করেছি ন্যায়বিচারের অভাব, সামাজিক বিভেদ ও বৈষম্য আমাকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে এবং লেখার ব্যাপারে বিশেষ প্রেরণা যোগায়।
কখনো কখনো আবার লিখি কারো অনুরোধে, দাবী মেটাতে। ছোটবেলায় আমার লেখালেখির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছি বাবার কাছে। আঠার বছর বয়স থেকে গল্পকার স্বামী জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের কাছে প্রচুর প্রেরণা পাই। আমি যখন লিখতে বসি, আমাকে যথেষ্ট সময় ও খোলামেলা জায়গা (space) দেবার জন্যে জ্যোতি সংসারের কাজকর্ম করতে মোটেও দ্বিধা বা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। এছাড়া আছে আমার বড়দির বড় ছেলে, অলক মিত্র। অনেক আগে থেকেই আমার লেখার প্রতি তার গভীর নিষ্ঠা আমাকে বিস্মিত করেছে। তাছাড়া বেশ কয়েকজন ব্যক্তি যেমন, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, হায়াৎ মামুদ, আবুল হাসনাত, শামসুজ্জামান খান, আলম খোরশেদ, শফি আহমেদ, খালেদ হায়দার, বজলুর রহমান, দ্বিজেন শর্মা, নিয়াজ জামান,
সাদ কামালী, ওবায়েদ আকাশ, সরকার আমিন, রাকীব হাসান, নাহার মনিকা, আলমগীর রহমান, আশরাফ কাজল, আসগর ওয়াহেদ, মাজহারুল ইসলাম, মোহম্মদ আব্দুল মজিদসহ আরো অনেকে বিভিন্ন সময়ে আমাকে লেখার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। আমি নিশ্চিত অনিচ্ছাকৃতভাবে অনেকের নামই বাদ পড়ে গেল এখানে, আরো যাঁরা আমাকে লিখতে প্রেরণা দিয়েছেন।
সঙ্গে সঙ্গে যে নামগুলো মনে পড়লো তাই বলে গেলাম।
ভেবেচিন্তে বললে তালিকাটা আরো সম্পূর্ণ হতো। যাঁদের কথা বলা উচিত ছিল, বলা হয়নি, তাঁদের কাছে অগ্রীম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি অনিচ্ছাকৃত ভুলের কন্যে।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা স্বীকার করা জরুরী, আর সেটা হলো, গল্পের যথার্থ ও পছন্দমতো
শিরোনাম দিতে আমার একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমার বেশ কয়েকটি গল্পের
নাম-ই দিয়ে দিয়েছেন সুহৃদ আলম খোরশেদ, সাদ কামালী, শফি আহমেদ এবং নিঃসন্দেহে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত।
সাতদিনঃ শর্ত স্বাপেক্ষে লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে বললে কি ছাড়তে পারবেন?
পূরবী বসুঃ ঢাকায় ফিরে গিয়ে চাকরী নিয়েছিলাম এক বেসরকারী লাভজনক প্রতিষ্ঠানে। নব্বুইয়ের দশকের প্রথম দিকে। তখন অনেক কলাম লিখতাম দৈনিক কাগজগুলোতে - প্রতি সপ্তাহেই। আমার কোম্পানীর উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমার ওপর সেসময়
প্রচুর চাপ আসে কিছু বিশেষ ধরণের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে লেখালেখি না করার জন্যে। শর্তসাপেক্ষে ও তাদের অনুমোদিত
তালিকার ভেতর লেখার বিষয়বস্তু
সীমাবদ্ধ করে রাখা মেনে নিতে না পেরে আমি পদত্যাগ পত্র দাখিল করি। পরে সেই শর্ত তুলে নিয়ে আমাকে পুনরায় কাজে বহাল করা হয়। কারো শর্ত মেনে নিয়ে সাহিত্য রচনার ইচ্ছে আমার নেই। সেক্ষেত্রে লেখা বন্ধ করে দিতে রাজি আছি।
আমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছি, বিজ্ঞান বিষয় নিয়েই বরাবর আমার জীবিকা-অর্জন। সাহিত্য আমার নেশা, বিজ্ঞান আমার পেশা। যদি দেশের রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিবেশ এমন হয়, নিজের মতো করে কথা বলতে পারছি না, লিখতে পারছি না, সেক্ষেত্রে লেখা ছেড়ে দেয়াই সহজতর মনে হবে, ছক বেঁধে দেওয়া গন্ডির ভেতর লেখার চেষ্টা বা ঘোরাফেরা করার চাইতে। আর তাছাড়া বিজ্ঞান তো রইলোই, চিন্তা ও চেতনার নাড়াচাড়ার জন্যে।
সাতদিনঃ এক জন লেখকের ভেতরের
‘মানুষস্বত্তা’ কে আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করেন??
পূরবী বসুঃ খুব –ই বড় করে দেখি। আমাদের যতগুলো পরিচয় আছে, তার সবচাইতে বড় ও মৌলিক পরিচয় মানুষ হিসেবে আমরা কেমন। একজন হৃদয়বান, সত্যবাদী, সৎ, পরিশ্রমী, সহমর্মী মানুষের তুলনা হয় না।
একজন লেখকের এই অতি মৌলিক গুনগুলো না থাকলে তার লেখা দূরে বসে পড়তে পারি, তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হবার কোন আকাঙ্খা হবে না আমার।
সাতদিনঃ মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে
দেখেন?
পূরবী বসুঃ যেহেতু মৃত্যুর পরে আর কিছু নেই এই বিশ্বাসে আমি স্থির, প্রিয়জনের মৃত্যুকে আমি মানতে পারি না। কেননা পরজন্ম বা পরলোক বলে কিছু যে নেই সে ব্যাপারে আমি যেরকম নিশ্চিত, খুব কম বিষয়েই ততটা নিশ্চিত। আমি আজ পর্যন্ত কোন অতি প্রিয় মানুষের মৃত মুখ দেখিনি। কখনো দেখতে চাই না। মৃত্যুর finality, terminal ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে না। প্রিয় মানুষ যখন মরে যায়, তার জন্যে কষ্ট পাবার সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর আমার খুব রাগ ধরে। মনে হয়, এই কঠিন, অনিবার্য কাজটা তুমি তো বাপু আগে ভাগে করে সারলে, এখন তোমাকে ছাড়া এই জীবন বয়ে বেড়াবার ভার, কঠিন দায়িত্বটা যে রেখে গেলে আমার ওপর,
সেই বিশাল কাজটা আমি কী করে করি যখন তুমি অদৃশ্য হয়ে গেলে সারাজীবনের জন্য!
আমি তাই তার ছবি দেখিনা,
তার সম্পর্কে যতটা সম্ভব কম কথা বলি, তাঁর প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাই।
কিন্তু আশেপাশের মানুষ আমাকে ভুল বোঝে। আমাদের এক বন্ধুতো এজন্যে আমায় পরিত্যাগ করেছে তার মায়ের মৃত্যুর পরে তার মাকে দেখতে যাইনি বলে। খালাম্মা আমাকে মায়ের মতো-ই স্নেহ করতেন। জীবিত খালাম্মার জ্বলন্ত স্মৃতি বুকে নিয়ে কী করে তাঁর মৃত মুখ দেখি?
কিন্তু বন্ধু তা বুঝতে পারলো না।
আরেকটা কথা। মৃত্যুর পরে কোন কিছুতে যেহেতু বিশ্বাস করি না, মারা যাবার পর অতি নিশ্চুপে, জীবিতদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় কোনরকম ঝামেলা না করে, বাধা না দিয়ে আমি
মেডিকেল কলেজের লাশ-কাটা ঘরে কিংবা ফ্রিজারে চলে যেতে চাই, যেমনটি ইচ্ছাপোষন করেছি আইনী কাগজে। মৃত্যুর পরে আমাকে নিয়ে কোনরকম স্মরণসভা, অনুষ্ঠান, বা যে কোন আদিখ্যেতার কথা মনে হলেও সংকোচ হয়, বিরক্তি লাগে। আমার মৃত্যু বা আমার মৃতদেহ যেন জীবনকে, জীবিতদের
কোনভাবে
উত্তক্ত না করে, তাদের মূল্যবান সময় অপচয় না করে, তাদের সাজানো দৈনন্দিন জীবনে কোনরকম ব্যাঘাত না ঘটায়।
চোখ দুটো ‘সন্ধানী’ নিয়ে নেবার পর পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জীবিতদের চোখের
আড়ালে চলে যাবে আমার লাশ, এটাই আমার ইচ্ছা।
মৃত্যু আমার কাছে অন্তহীন এক নিদ্রা ছাড়া আর কিছু নয়। আত্মা, আরেক জীবন, স্বর্গ-নরক – পরকাল,
কোন কিছুতে বিশ্বাস নেই।
ফলে মৃত্যুর পরে আমাকে নিয়ে কী করা হলো,
আমাকে কী বলা হলো,
আমি কিছুই দেখবো না, জানবো না, আমার কিছুই যায় আসে না তাতে। ওসবের কোন মূল্য, কোন অর্থ, কোন আগ্রহ বা মোহ, কিচ্ছু নেই আমার।
সাতদিনঃ লেখালেখি ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয়?
পূরবী বসুঃ পছন্দঃ ভালো ছায়াছবি, নতুন নতুন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া, প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা, বাগান করা বিশেষ করে বিভিন্ন রকম ফুল ফোটানো, সাধ্যমতো কারো উপকারে আসা, প্রিয়জনদের সুখেদুঃখে জড়িয়েজাপ্টে থাকা। অপছন্দঃ মেকিপনা, মিথ্যাকথা বলা, সাম্প্রদায়িকতা, স্বার্থপরতা, আত্মম্ভরিতা, বিশ্বাসঘাতকতা, অসাধুতা বিশেষ করে আর্থিক ব্যাপারে।
সাতদিনঃ সাহিত্যের বাইরে আরো
একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শ্ত্রুকে কি ভাবে মূল্যায়ন করেন
পূরবী বসুঃ বন্ধু আমার জীবনে সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি। বন্ধু তাকেই বলি, যে আমার কোন অর্জন বা সাফল্যে নিঃশর্তভাবে আনন্দিত হয়, আবার আমার কষ্টে, বিপদে, দুঃখে, অপমানে, পরাজয়ে সমব্যথী হয়, কষ্ট পায়, পাশে থাকে। বন্ধু যে, সে আমার সঙ্গ পছন্দ করবে, যদিও কিছু কিছু চিন্তা বা মতের অনৈক্যে কখনো সখনো তার সঙ্গে তর্ক বা ঝগড়া হোতেই পারে।শত্রু খুব একটা আছে মনে করি না। বন্ধুর কাছে যে প্রত্যাশা, শত্রু যদি থেকে থাকে, বন্ধুর উল্টোটাই করবে বলে বিশ্বাস।
……………………………….
আমি কি আত্মহত্যা
করতে পারি!
![]() |
এখনকার মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ফোরামের হারুন হাবীব |
মুক্তিযুদ্ধ আমার অস্তিত্ব, আমার অহংকার। আমার লেখালেখি বেশির ভাগই
মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক।
মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক।
![]() |
একাত্তরের যোদ্ধা হারুন হাবীব |
প্রযুক্তি বিশ্বকে সকল স্তরের মানুষের বৈঠকখানায়।
বন্ধু ছাড়া যেমন জীবন পূর্ণ হয়না, শত্রু ছাড়াও নয়।
আমার কাছে মৃত্যু
জন্মের মতোই সহজাত।
সাতদিনঃ নিজের লেখালেখিকে আপনি কি ভাবে মূল্যায়ন করেন?
হারুন হাবীব: নিজের লেখালেখিকে কিভাবে মূল্যায়ন করি, ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবো না। হয়তো বুঝিওনা। একবার মনে হয়, যা চেয়েছি তার কিছুই হয়নি, আবার মনে হয়, হয়েছে- সামান্য হলেও!
সত্যি বলতে কি, আমি যা লিখি তার বেশির ভাগই আমাকে তৃপ্ত করেনা; মনে হয়- পূর্ণ হলোনা, যা চাই তা হলোনা। এরপরও এক ধরণের তৃপ্তি আসে যখন দেখি আমি যা আঁকতে চেয়েছি- হয়তো কমবেশি হয়েছে। মোটকথা আমার লেখালেখি নিয়ে আমার দ্বন্দ আছে, ভালোমন্দ মিলিয়েই আছে।
আমার লেখালেখি বেশির ভাগই মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক, বাঙালির জাতীয় স্বাধীনতার ঐতিহাসিক যুদ্ধকেন্দ্রিক। সেই শুরু থেকে আজও-অব্দি মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই আমার বিচরণ। ভাল, মন্দ, সীমাবদ্ধতা যাই বলা হোক না কেন, মুক্তিযুদ্ধ আমার সর্বগ্রাসী প্রেম। একে এড়িয়ে চলার সামর্থ আমার নেই। মুক্তিযুদ্ধ কেবল আমার বিশ্বাস নয়, মুক্তিযুদ্ধ আমার অস্তিত্ব, আমার অহংকার।
সাহিত্যে একাত্তরের সুবিশাল জনযুদ্ধের সার্থক প্রতিফলন হওয়া উচিত, জাতীয় অহংকারের আত্মা, কথা ও কাহিনী ওঠে আসা উচিত; আক্ষেপ- হয়নি তা এখনো। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবেগী সাহিত্য বা লেখালেখি কম হয়েছে বলা যাবেনা; কিন্তু আমার মনে হয়, স্বমহিমায় শিল্পীত হতে আজও বাকি আছে একাত্তরের। এই অপূর্ণতা আমাকে আরও বেশি কাছে টানে মুক্তিযুদ্ধের। এমনও হতে পারে, অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে লড়াই করার সৌভাগ্য হয়েছিল বলে অভাবিত এক টান অনুভব করি আমি একাত্তরের।
সাতদিনঃ আপনার প্রথম লেখা এবং প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
হারুন হাবীব: আমার প্রথম লেখার কথা খুব একটা মনে পড়েনা, এটুকুন জানি, ক্লাস এইটে পড়ার সময়ই লেখালেখির সাথে আমার প্রেম। তবে প্রথম বই ‘প্রিয় যোদ্ধা প্রিয়তম’, একটি উপন্যাস, সম্ভবত আশি সালের দিকে প্রথম প্রকাশ পায়। প্রথম উপন্যাসটি রচনার এক প্রেক্ষাপট আছে। ১৯৭৯ সালে সাংবাদিকতার কাজে প্রথম দেশের বাইরে যাই, সাবেক যুগোস্লাভিয়ার বেলগ্রেড-এ। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি বড় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যুগোস্লাভ রাজধানীতে, যুগোস্লাভ বিপ্লবের নেতা যোসেফ ব্রজ টিটোর জীবনে শেষ সম্মেলন সেটা।
ঘটনাচক্রে নির্ধারিত সময়ের চাইতে অনেক বেশি থাকতে হয় আমাকে বেলগ্রেড-এ, দেশটির নানা জায়গায় বেড়াবার সুযোগ হয়। যুগোস্লাভিয়ার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী একটি পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ হবারও সুযোগ ঘটে। বাংলাদেশের অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে পাঠানো হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পরের বছরগুলিতে চিকিৎসার জন্যে। এদের কারও হাত,কারও পা খোয়া গেছে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই এ। কি কারণে জানিনা, যুগোস্লাভিয়া ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নায়ক-নায়িকাদের এক মনে হতে থাকে আমার।
এই উপলব্ধি নিয়েই আমার প্রথম উপন্যাসের কাহিনী বিস্তৃত হয়। ইউরোপীয় বিপ্লবের সাথে যুক্ত এক যুগস্লাভ তরুণী বাংলাদেশের এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে প্রেম নিবেদন করে। দুই রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রমীরা ত্যাগ ও মহীমায় এক হয়ে ওঠে।
![]() |
স্বপরিবারে হারুন হাবীব |
সাতদিনঃ বাংলা সাহিত্যের কোন শাখা তুলনামুলক ভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন?
হারুন হাবীব: বাংলা সাহিত্য তার বহুমূখি শাখা বিস্তার করে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপূর্ব ভারতসহ তাবৎ বাংলাভাষী অঞ্চলের সাহিত্য নিয়েই বাংলা সাহিত্য। এর বিভাজন চলে না। ইউরোপ-আমেরিকার প্রবাসে যারা বাংলা সাহিত্যের চর্চা করেন তাদের কাজকেও বাদ দেয়ার সুযোগ দেখিনে আমি। তবে প্রশ্নটির যথার্থ উত্তর হয়তো বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কিত।
আমি মূলতঃ গদ্য সাহিত্যের মানুষ, যদিও কবিতার প্রতি আমার অনুরাগ অপরিসীম। আমার নিজের উপলব্ধি হচ্ছে, আমাদের কবিতা যতোটা অগ্রসর হতে পেরেছে, গদ্যসাহিত্য বা গল্প-উপন্যাস ততোটা নয়। প্রবন্ধ নিয়েও আমরা বেশিদূর এগুতে পারিনি। বেশির ভাগ লেখকদেরই চটজলদি লাভবান হবার বা জনপ্রিয় হবার মনোভাব বিষয়টাকে আরও জটিল করেছে। সাহিত্য নিমগ্ন চর্চার বিষয়, আরাধনার বিষয়, প্রতিযোগিতার বিষয় নয়। এরপরও বলতে হবে যে, এর মাঝেও অনেকেই গদ্য নিয়ে যথেষ্ঠই কাজ করেছেন, করে চলেছেন। নতুনদের মধ্যেও অনেকে দক্ষতার স্বাক্ষর রখেছেন। এদের কেউ কেউ পাঠকও আকৃষ্ট করতে পেরেছেন। আমাদের প্রজন্মের কেউ কেউ প্রবল জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছেন। কিন্তু এই জনপ্রিয়দের মধ্যে বাণিজ্যিক মনোভাব ভর করায় এদের হাতে চটকদারী সাহিত্য হয়েছে মাত্র। আমার ধারণা, এসব বাণিজ্যিক রচনাকারীরা তাদের প্রতীভার অবমূল্যায়ন করেছেন।
সাতদিনঃ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে?
হারুন হাবীব: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের জীবনযাপনকে অভাবিত সহজ করেছে। দুই-তিন যুগ আগে যা সম্ভব হয়নি, ভাবাও যায়নি, তাই আজ সম্ভব হয়েছে। ইন্টারনেট, টিভি গোটা বিশ্বকে সকল স্তরের মানুষের বৈঠকখানায় পৌঁছে দিয়েছে। এই বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগেও সাহিত্য টিকে আছে, থাকবেও। কারণ প্রযুক্তি সাহিত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, হবার কথাও নয়। প্রযুক্তি বাহন মাত্র, যাত্রি নয়। এই বাহনের অগ্রগতিতে সাহিত্য অনেক বেশি মানুষের নাগালে আসার সুযোগ লাভ করুক, এই আমি প্রত্যাশা করি।
তবে হ্যাঁ, সাহিত্যকে যারা কেবলই ‘এন্টারটেইনমেন্ট’ ভাবেন- তাদের কথা আলাদা। এই শ্রেণীর মানুষেরা হয়তো এটিও ভেবে বসেন যে, সবকিছুই যখন ‘রেডিমেইড’, চটযলদি হাতের নাগালে, তখন সাহিত্য পড়ে কি হবে! এ উপলব্ধি মূর্খ্যতা মাত্র। আমি সাহিত্যকে ‘এন্টারটেইনমেন্ট’ বা ‘প্রমোশনাল’ ভাবিনে। সাহিত্য ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের ছবি, যা ‘টেকনোলজির’ সৃষ্টি নয়, লেখকের সৃষ্টি। কাজেই অধূনা উন্নত ‘টেকনোলজি’র যুগেও সাহিত্য প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে বা পড়বে বলে যারা মনে কারেন, আমি তাদের দলে নই।
সাতদিনঃ আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
হারুন হাবীব: বাংলা সাহিত্যে আমার প্রিয় লেখক রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ ছাড়াও তারাশংকর, শামসুর রাহমান, সুনীল, শক্তিসহ আরও কেউ কেউ। আমি এদের রচনাবলি পড়ি, পড়তে বাধ্য হই, এর বেশি বলার কিছু নেই। এদের সম্পর্কে বিস্তারিত বলার সুযোগ এখানে সীমিত ।
সাতদিনঃ আপনার নিজের প্রিয় লেখা কোনটি এবং কেনো?
হারুন হাবীব: প্রশ্নটি যথেষ্টই কঠিন। এরপরও বলতে পারি, আমার লেখা, উপন্যাসের মধ্যে ‘সোনালি ঈগল ও উদ্বাত্তু সময়’ এবং ‘পাঁচপুরুষ’-এ নিজেকে হয়তোবা আমি অনেকটাই প্রকাশ করতে পেরেছি। আমার ছোটগল্পগুলির, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের প্রক্ষাপটে রচিত যেগুলো, তার অনেকগুলোই আমার প্রিয়, মনের কাছাকাছি।
সাতদিনঃ আপনার লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা কি?
হারুন হাবীব: আমার লেখালেখির মূল প্রেরণা আমার কাছের মানুষ, মনের মানুষ, আমার স্বদেশ। আরও স্থান করে নিয়েছে আমার জাতির, আমার কাছের মানুষের মুক্তির সংগ্রাম, জীবনযাপনের সংগ্রাম। হয়তো এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধ, যে জনযুদ্ধে আমি শরিক হবার সুযোগ পেয়েছি, আমার লেখালেখির মূল উপলক্ষ্য।
সাতদিনঃ শর্ত স্বাপেক্ষে লেখালেখি ছেড়ে দিতে বললে কি ছাড়তে পারবেন?
হারুন হাবীব: কি এমন শর্ত হতে পারে যে লেখালেখি থেকে আমাকে বিরত রাখবে? এমন শর্ত আমার দুয়ারে এসে আঘাত করার সাহসী হবে- মনে হয়না। যদি হয় তা নির্ঘাৎ প্রত্যাখ্যাত হবে। আমি কি আত্মহত্যা করতে পারি!
সাতদিনঃ একজন লেখকের ভেতরের ‘মানুষস্বত্তা’ কে আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করেন?
হারুন হাবীব: লেখক মানুষ, অতএব তার মানুষস্বত্তা সহজাত। তবে একজন লেখক যেহেতু শিল্পী, নির্মাণকর, সেহেতু তিনি মানবতাবাদী। মানবিক সত্তা ছাড়া কেউ লেখক হতে পারে না।
সাতদিনঃ মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
হারুন হাবীব: মৃত্যু জীবজগতের স্বাভাবিক পরিণতি। কাজেই মৃত্যু আমাকে তাড়িত করেনা। আমার কাছে মৃত্যু জন্মের মতোই সহজাত। তাই মনে হয়, জীবনের সার্থকতা মৃত্যুতে নয়; বরং জীবনে। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুও হেরে যায় জীবনের কাছে।
সাতদিনঃ লেখালেখি ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয়?
হারুন হাবীব: আমি সামাজিক মানুষ; সংসারীও বলা যায়। লেখালেখি আমার বেঁচে থাকার প্রিয় অবলম্বন। এর কোনো বিকল্প দেখিনে। সত্য আমার প্রিয়, অপ্রিয় মিথ্যে, যা আমি ঘৃণা করি। একজন লেখক সত্য ও মিথ্যের ফারাক বুঝবেন, আর সকলের চাইতে বেশি করে বুঝবেন, এটিই প্রত্যাশিত।
সাতদিনঃ সাহিত্যের বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শত্রুকে কি ভাবে মূল্যায়ন করেন?
হারুন হাবীব: বন্ধু ছাড়া জীবন পূর্ণ হয়না, শত্রু ছাড়াও নয়। এরা এতোটাই যুক্ত যে অনেক সময়ই মনে হতে পারে এরা একে-অপরের পরিপূরক। এদের মধ্যে মিলও খানিকটা আছে, তবে কে কখন কতোটা স্থায়ী বলা দুস্কর। আমি বন্ধুর মতো শত্রুকেউ অবমূল্যায়ন করিনে।শর্তসাপেক্ষে কেন, নিঃশর্তভাবেও লেখালেখি ছেড়ে দিতে পারি
সাতদিনঃ নিজের লেখালেখিকে আপনি কি ভাবে মূল্যায়ন করেন?
আলম খোরশেদঃ প্রথমেই
ধন্যবাদ এই অধমকেও লেখক হিসাবে স্বীকৃতি দেবার জন্য। লেখালেখি করতাম হয়তবা কোন এক
কালে এবং নেই নেই করেও কুড়িখানি গ্রন্থও বেরিয়েছে বটে ইত্যবসরে, তবু নিজেকে এখনও ঠিক সেভাবে লেখক পরিচয়ে ভাবতে পারি না। বাংলা ভাষাকে
ভালোবাসি, ভালোবাসি বিশ্বসাহিত্য। সেই সুবাদে টুকটাক আলোচনা,
অনুবাদের ভেতর দিয়ে
সাহিত্যের দূর
বিশ্বটাকে চারিয়ে দিতে চেয়েছি প্রিয় বাংলার শিরায় শিরায়। এক ধরণের সাহিত্যিক
দূতিয়ালি ছাড়া একে আর কীইবা বলা যেতে পারে!
সাতদিনঃ আপনার প্রথম
লেখা এবং প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
আলম খোরশেদঃ প্রথম লেখার কথা খুব স্পষ্ট করে মনে নেই। সম্ভবত সেটি ছিল সদ্য কৈশোরে, প্রিয় পোষা ময়না পাখিটার আকস্মিক মৃত্যুতে, অপটু পদ্যে রচিত একটি শোকগাথা।
আমার প্রথম বই একটি সম্পাদিত গ্রন্থ, লাতিন আমেরিকার কুড়িজন প্রতিনিধিত্বশীল লেখকের গল্পের বঙ্গানুবাদ সঙ্কলন, নাম: “যাদুবাস্তবতার গাথা: লাতিন আমেরিকার গল্প সঙ্কলন”। প্রকাশিত হয়েছিল সম্ভবত ১৯৯০ সালে, তৎকালীন জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, অধুনা সাহিত্যপ্রকাশ থেকে। এই গ্রন্থটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য: এর মাধ্যমে লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের বহুলালোচিত ধারা ম্যাজিক রিয়ালিজমের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের একটি সুদৃঢ় ও অন্তরঙ্গ পরিচয় ঘটানো সম্ভব হয়েছিল। এর বাংলা পরিভাষা হিসাবে যাদুবাস্তবতা শব্দটাও বোধ হয় সেই প্রথমবারের মতই ব্যবহৃত হয় বাংলা ভাষায়। এই বইটির আরও একটি বড় বৈশিষ্ট্য, সেই সময় উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত প্রায় সকল উল্লেখযোগ্য বাঙালি লেখককেই, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে, সম্পৃক্ত করা গিয়েছিল এই উদ্যোগটির সঙ্গে। শুনতে পাই এটি বাংলাদেশের তৎকালীন তরুণ কথাসাহিত্যিক মহলে ও সুবেদী পাঠক-সম্প্রদায়ে বেশ সমাদৃতও হয়েছিল। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বইটি আজ বহুদিন হলো ছাপা নেই।
আমার প্রথম বই একটি সম্পাদিত গ্রন্থ, লাতিন আমেরিকার কুড়িজন প্রতিনিধিত্বশীল লেখকের গল্পের বঙ্গানুবাদ সঙ্কলন, নাম: “যাদুবাস্তবতার গাথা: লাতিন আমেরিকার গল্প সঙ্কলন”। প্রকাশিত হয়েছিল সম্ভবত ১৯৯০ সালে, তৎকালীন জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, অধুনা সাহিত্যপ্রকাশ থেকে। এই গ্রন্থটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য: এর মাধ্যমে লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের বহুলালোচিত ধারা ম্যাজিক রিয়ালিজমের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের একটি সুদৃঢ় ও অন্তরঙ্গ পরিচয় ঘটানো সম্ভব হয়েছিল। এর বাংলা পরিভাষা হিসাবে যাদুবাস্তবতা শব্দটাও বোধ হয় সেই প্রথমবারের মতই ব্যবহৃত হয় বাংলা ভাষায়। এই বইটির আরও একটি বড় বৈশিষ্ট্য, সেই সময় উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত প্রায় সকল উল্লেখযোগ্য বাঙালি লেখককেই, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে, সম্পৃক্ত করা গিয়েছিল এই উদ্যোগটির সঙ্গে। শুনতে পাই এটি বাংলাদেশের তৎকালীন তরুণ কথাসাহিত্যিক মহলে ও সুবেদী পাঠক-সম্প্রদায়ে বেশ সমাদৃতও হয়েছিল। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বইটি আজ বহুদিন হলো ছাপা নেই।
সাতদিনঃ বাংলা
সাহিত্যের কোন শাখা তুলনামুলক ভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন?
আলম খোরশেদঃ সম্ভবত
ছোট গল্প। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আজকের অদিতি ফাল্গুনী পর্যন্ত অসংখ্য লেখকের
হাতে অজস্র শক্তিশালী ও শিল্পোত্তীর্ণ ছোট গল্প লেখা হয়েছে বাংলা সাহিত্যে, যার তুলনা বিশ্বের আর কোন সাহিত্যে রয়েছে বলে আমার জানা নেই। সত্যি বলতে
কি, কোন এক রহস্যময় কারণে ছোটগল্প বস্তুটাই আজকাল আর
তেমনভাবে চর্চিত হয়না অপরাপর বিশ্বভাষায়,
উঠতি লেখকদের শিক্ষানবিশীর পর্বটুকু ছাড়া।
সাতদিনঃ বিজ্ঞান এবং
প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
আলম খোরশেদঃ প্রশ্নটা
ঠিক বোঝা গেলো না। কীসের ’প্রতিফলন’?
সাতদিনঃ আপনার প্রিয়
লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
আলম খোরশেদঃ সর্বকালীন
ও সার্বক্ষণিক প্রিয় লেখক রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সম্পর্কে এই বহুশ্রুত ক্লিশেটুকু
পুনর্বার উচ্চারণ করাটাই বোধ হয় যথেষ্ট হবে যে, রবীন্দ্রনাথকে
ছাড়া এই মরজীবনের কথা কল্পনাও করতে পারি না।
সাতদিনঃ আপনার নিজের
প্রিয় লেখা কোনটি এবং কেনো?
আলম খোরশেদঃ নারীবাদী
সাহিত্য-সমালোচনার বাইবেল হিসাবে পরিচিত ভার্জিনিয়া উলফ্-এর অত্যন্ত দুরূহ ও
দুঃসাহসিক গ্রন্থ A
Room of Ones Own-এর অনুবাদ কর্মটিকেই অদ্যাবধি আমার প্রিয়তম
সাহিত্যকর্ম বলে জ্ঞান করি। এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৯ সালে ’অন্যপ্রকাশ’ থেকে ’নিজের একটি
ঘর’ নামে। গেলো বছর এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ’সংহতি’ থেকে ’নিজের একটি কামরা’
শিরোনামে। কোলকাতার ’এবং মুশায়েরা’ পত্রিকায় এটির একটি দীর্ঘ প্রশস্তিবাচক আলোচনা লিখেছিলেন স্বনামধন্য
সাহিত্যিক কেতকী কুশারী ডাইসন।
সাতদিনঃ আপনার
লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা কি?
আলম খোরশেদঃ এক্ষণে
মূলত সম্পাদক প্রজাতির অনুরোধ, অনুনয়, উপরোধ, ফরমাশ, হুকুম এবং
ক্ষেত্র বিশেষে প্রচ্ছন্ন হুমকি!
সাতদিনঃ শর্ত
স্বাপেক্ষে লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে বললে কি ছাড়তে পারবেন?
আলম খোরশেদঃ শর্তসাপেক্ষে
কেন,
নিঃশর্তভাবেও ছেড়ে দিতে পারি। তাছাড়া ছেড়ে দেবার বাকিইবা রইলোটা কী,
পুরোপুরি ছেড়েই তো দিয়েছি বলা চলে। এখন যেটুকু লিখি, সেটা কোন আভ্যন্তর সৃষ্টির তাড়ণা থেকে নয় বরং এক ধরণের বহিঃস্থ অনাসৃষ্টি
তথা চাপের মুখে।
সাতদিনঃ এক জন লেখকের
ভেতরের ‘মানুষস্বত্তা’ কে আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করেন?
আলম খোরশেদঃ তাঁর ’মনুষ্যত্ব’ দিয়ে।
সাতদিনঃ মৃত্যুকে
আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
আলম খোরশেদঃ রীতিমত
ভীতি ও আতঙ্কের দৃষ্টিতে।
সাতদিনঃ লেখালেখি
ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয়?
আলম খোরশেদঃ প্রিয়:
সঙ্গীত,
চলচ্চিত্র, সুস্থ বিতর্ক, অমলিন আড্ডা, প্রিয়সঙ্গ, প্রকৃতিমগ্নতা,
সংগঠন-তৎপরতা
অপ্রিয়:
সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, ভাষাবিকৃতি,
অর্থলিপ্সা, পণ্যকাতরতা, দ্বিচারিতা, অসৌজন্য।
সাতদিনঃ সাহিত্যের
বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শ্ত্রুকে কি
ভাবে মূল্যায়ন করেন?
আলম খোরশেদঃ বন্ধুকে
উদ্বাহু আবাহন আর শত্রুকে নিরঙ্কুশ উপেক্ষার মাধ্যমে।
============
আমরা একটা বিপর্যস্ত সময় পাড়ি দিচ্ছি,
নীতিনৈতিকতা মূল্যবোধ কর্পোরেট ও পুঁজির আগ্রাসনে জবুথবু
আমার কোনো শত্রু নাই। আমার একটি বন্ধুও নেই। সবাই বন্ধুর ভাণ করে আছে।
সাহেব বিবি গোলামের কারসাজি আঙুলে এসে যখন একসাথে সমর্পিত হয় তখন তো সবচেয়ে উত্তেজনাকর সময়। আবার এই তাস দেউলিয়াও করে।
আমি
ট্রেনের দিকে সেই শৈশব থেকে আজঅব্দি তাকিয়ে থাকি। কোথায় হারায় ট্রেন, আজও কেবল রহস্য মনে হয়।ওহ! নিঃসঙ্গ রেললাইন। সেই যে
শৈশবে গ্রামের নদীর কূলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়টানা নৌকা দেখেছিলাম, কলের গানে মাতিয়ে মাতিয়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ছইয়ের নাওগুলো
ভেসে গেছে জলে কোনখানে সেইসব মায়া লেগে আছে চোখের কোণে, মনে।
সাতদিনঃ নিজের লেখালেখিকে আপনি কি ভাবে
মূল্যায়ন করেন?
আহমেদ স্বপন মাহমুদঃ লেখালেখি একটা সক্ষমতার ব্যাপার, দক্ষতার ব্যাপার। বাতাস গাছের পাতাকে নাড়াতে পারে এটা বাতাসের দক্ষতা। পাখি উড়তে পারে, সেটি পাখির দক্ষতা বা ক্ষমতা। কিন্তু লক্ষ্য করবেন যে, বাতাসের সৃজনশীলতা নেই, তার গতি ও মাত্রা আছে কেবল। যেমন স্রোতের কোনো সৃজনীপ্রতিভা নেই। তারও গতি ও মাত্রা আছে। বাতাসের বা স্রোতের বা পাখির ওড়ার গতির মাত্রার হেরফের আছে। অবশ্য, পাখির সৃজনশীলতা আছে, প্রাণী তো। আমি তো বাবুই পাখির বাসা দেখে অবাক হই। ও হ্যা, যা লিখছিলাম, মানুষ অসীম প্রতিভাধর, অসীম তার সৃজনপ্রভা। ওই অর্থে, মানে একজন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে আমি লিখছি; নিয়মিত লিখছি, পড়ছি, গল্প দিচ্ছি, আড্ডা করছি। কিন্তু নিজের লেখার মূল্যায়নটা করছি না।সেটা সম্ভবত, লেখকের মূল কাজ নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন লেখালেখি করার কারণে প্রতিবেশ ও পরিবেশের ধারণা কিছুটা পাকাপোক্ত তো বটেই। অর্থাৎ চারপাশে কীসব লেখালেখি হচ্ছে, কারা লিখছেন ইত্যাদি নিয়ে চোখ কান তো খোলাই রাখছি। ফলে নিজের সৃজনশীলতার প্রতি আমি যথেষ্ট আস্থাবান। এই অর্থে যে, জীবন ও জগতের, এই মহাপ্রকৃতির বা মহাজীবনের রূপরসগন্ধবর্ণসৌন্দর্য নিয়ে যখন দীপ্ত হয়ে ওঠে মন, আবার মন ছুটে যায় অন্য কোনো খানে তখন যা লিখি সেগুলো হেলাফেলার নয়। কখনো উদাস, কখনোবা সিরিয়াস সব বিষয়আশয়, মানুষের বহুমাত্রার জীবনের আনন্দআহলাদবিষাদ, সবমিলে এমন এক ঘোর ও রহস্য তৈরি করে, নিজেকে তখন মহাকালের কাছে অতি তুচ্ছাতুচ্ছও মনে হয়। মূল্যায়ন তখন বাতুলতামাত্র। তথাপি, আমি যা বলতে চেয়েছি, আমি যা বলেছি, যেসব লিখেছি, সব কিছুরতো শিল্পের জায়গা থেকে কোনো না কোনো অভিজ্ঞান আছে। সেইসব অভিজ্ঞানের মাত্রা ও ভেদ জীবন চরাচরে কত যে খেলা করে! তারা আর হিসেবে করে দেখে না, জীবনের রেখা কতটা সরল বা বক্র। আমি প্রকৃতির প্রতি বিশ্বস্ত, আমার নিজের প্রতি আস্থাবান। দেখা ও না দেখা অভিজ্ঞতা লিখে যাই, নিজের সামর্থ ও দক্ষতায়। কেবল সুদূরে তাকিয়ে থাকি, ভাবি অথৈ মায়া ও মুখেদের ভাব। প্রজাপতির পাখা সুন্দর না ফড়িংয়ের তা ভাববার অবকাশ কই!
সাতদিনঃ আপনার প্রথম লেখা এবং প্রথম বইয়ের
অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

আমাদের সময়ে মানে সেই আশি-নব্বই’র শুরুতে হুট করে আমরা বই করতাম না।
একটা বই বের করার আগে কত যে সাহস সঞ্চয় করতে হতো মনে। বুক যেন কাঁপত ধুর ধুর করে।
প্রথম পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলাম ১৯৮৮-৮৯ সালে ‘স্নাতকোত্তর বোধের প্রকৃতি’ নামে। তো, সেই পাণ্ডুলিপি আলোর মুখ দেখেনি, কোনোদিন দেখবেও না আর। কী যে নিরপরাধ
কবিতাগুলো। আফসোস লাগে তা ভাবলে।তার আরও এক যুগ পরে প্রথম বই প্রকাশিত হয় আমার। ২০০০
সালে ফেব্রুয়ারি। কবিতার বই, ‘অতিক্রমণনের রেখা’ নামে। ছোট ছিমছাম বই। চমৎকার অভিজ্ঞতা
তখন। বইটি বেশ আলোচনায় চলে আসে। টেলিভিশনে ইন্টাভউ দেই; পত্রিকাগুলোয় প্রকাশ পায়, বইটি নিয়ে বেশ কয়েকটি আলোচনা করা হয়
নানা লিটল ম্যাগাজিনে।বিশেষ করে, ঘোড়া সিরিজ নিয়ে, মানে ঘোড়া বিষয়ক কয়েকটি কবিতা বেশ সুনাম কুড়াতে সক্ষম হয়। তাছাড়াও
বইয়ের প্রথম কবিতাটি ‘রেখা’ শিরোনামের কবিতাটি আলোচিত হয়ে ওঠে।শুরুটা ছিল এইরকম ‘রেখা বিস্তৃর্ণ হলে বর্ণ ক্রমাগত নীল
হয়।’ আরও
একটি কবিতার লাইন অনেকের মুখে শুনি আজো, যেমন: ‘লোভ সেতো সংবরণের নাম।’ বলা যায়, প্রথম কবিতার বইয়ের অভিজ্ঞতা বেশ
ভালো। তখন হয়তো রেস কম ছিলো, রেষারেষিও। প্রথম কিবিতার বই, হ্যা, প্রথম ও টাটকা, বেশকিছু ভালো কবিতা নিয়ে পাঠকের সামনে
হাজির হয়েছিলো।
সাতদিনঃ বাংলা সাহিত্যের কোন শাখা তুলনামুলক
ভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন?

তারপরও তো সাহিত্যের একটা ইতিহাস আছে, ইতিহাসের মর্যাদা আছে। অনেক জ্ঞানীগুণী
তাপস আছেন যারা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। সেটা অতীতকাল। আমি বলি, বাংলাসাহিত্যের সমৃদ্ধি হচ্ছে
অতীতকালে। সেটি পুঁথিসাহিত্য থেকে শুরু করে পল্লীসাহিত্য। আমি যদিও পল্লীসাহিত্য
আখ্যায়িত করার সপক্ষের লোক নই। বাংলাকাব্য বলতে পারেন, পদাবলী যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল
করে আছে বাংলাসাহিত্যে। বাংলাসাহিত্যের কথাসাহিত্যের সুনাম থাকলেও বেশ নড়বড়ে ও
নাজুক অবস্থা এখন। আর প্রবন্ধসাহিত্য নাই। মানে প্রবন্ধ, সমালোচনাসাহিত্য নাই, একদম নাই। এই নিয়ে কোনো ডিসকোর্সই
দাঁড়ায়নি আজঅব্দি। এটা বাংলাসাহিত্যের সবচেয়ে দুবর্লতার দিক। রীতিমতো মরণাপন্ন
অবস্থা আর কি! এই মরণের সাথী আমরা সবাই। সাপ ও ব্যাঙের চরিত্র এখানে একইরকম। সাপ ও
ব্যাঙ যে আলাদারকম, আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের এই কথা বলার মতন সাহসী লোক নাই
সাহিত্যসমাজে। সবাই এমনভাবে নিজের ঢোল পেটাচ্ছে যে, ঢোল এখন ফেটে যাচ্ছে। মননশীলতার অভাব
এর পেছনে বড় কারণ। আবেগী বলে এখানে যাও কমবেশি কবিতা লেখা হয়, কিন্তু মনন চর্চা ও ধৈর্য একদম নাই।
তাছাড়া, চড়ুই
পাখির সাহস ও শক্তি দিয়ে তো আর প্রবন্ধ বা সমালোচনার কাজ করা যায় না। পিট
চুলকানিতেই সার!
সাতদিনঃ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য
জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে।

সাতদিনঃ আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন
কি?

সাতদিনঃ আপনার নিজের প্রিয় লেখা কোনটি এবং
কেনো?

সাতদিনঃ আপনার লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা কি?

আমার সামনের রাস্তায় একটা কৃষ্ণচূড়া ও কড়ই গাছ
আছে, এবটা
বড় মাঠ আর উঁচু উঁচু দালানগুলো ছাপিয়ে বিশাল বিস্তৃত আকাশ। আমি মেঘ দেখি, মেঘেদের শাদাকালো রূপ দেখি, মানঅভিমান দেখি। মন আক্রান্ত হয়, আপ্লুত হয়। ভাবি। বৃষ্টি হয়। কড়ই গাছে
কাকের দুটি বাসা আছে।কাক তাদের বাচ্চা নিয়ে জবুথবু থাকে। আমি দেখি। আর কড়ই পাতা
যেন বৃষ্টিতে ধুয়ে আরো সরু হয়, যেন তাক করে আছে আমার চোখে। এইস্ব সত্যিই প্রেরণা আমার। রাস্তা দিয়ে
বহু বহু মানুষ আনাগোনা করে, তাদের দেখি। ট্রেনে চেপে কত কত মুখ দেখি, প্লেনে দেখি, মায়া ও প্রেমে পড়ি। প্রেরণা হয়ে ওঠে
আসে সেইসব মুখ, মুখেদের
ছায়া, মায়া
ও অভিব্যক্তি। আমি ট্রেনের দিকে সেই শৈশব থেকে আজঅব্দি তাকিয়ে থাকি। কোথায় হারায়
ট্রেন, আজও
কেবল রহস্য মনে হয়।ওহ! নিঃসঙ্গ রেললাইন। সেই যে শৈশবে গ্রামের নদীর কূলের দিকে
তাকিয়ে দাঁড়টানা নৌকা দেখেছিলাম, কলের গানে মাতিয়ে মাতিয়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ছইয়ের নাওগুলো ভেসে গেছে জলে
কোনখানে সেইসব মায়া লেগে আছে চোখের কোণে, মনে। কার মুখ ভালোবেসে আজো রাতবিরাতে ঘুম
হয় না, কতশত
আড্ডার মুখ, ভ্রমণের
মুখ—শৈশবের, কৈশোরের, তারুণ্যের— অতীতের, বর্তমানের, ভবিষ্যতের মুখ সবই যেন প্রেরণা হয়ে
আসে। আরো আসে, গ্রামের
পথ দিয়ে, মাঠ
পেরিয়ে, বিল
ছাড়িয়ে, বনজঙ্গল, ঝড়বৃষ্টি, আলো ও গহীণ অন্ধকার ছাপিয়ে পথচলার
কাহিনি ইত্যাদি সবকিছু প্রেরণার নাম। আরও আরও কত যে লেখক, জানা অজানার কত মহাপ্রাণ, পাঠ ও পাঠের অভিজ্ঞতাগুলো, শৈশবে দেখা মাও সেতুঙ এর লাল বই পকেটে
নিয়ে ঘোরাফেরা, গ্রাম
পেরিয়ে বই সংগ্রহ করে রাতভর পড়া, রাতে অন্ধকারে চুপিসারে খড়ের গাদায় মুখ লুকিয়ে রূপবানের যাত্রা দেখতে
গিয়েও তো মায়ায় পড়েছি।সেইসব কেন যে প্রেরণা হয়ে আসে। আরও কত কত মুখ, মুখের অসুখ, প্রেম ইত্যাদি সবকিছু আজ মনে বাজে, প্রেরণার সাজে হানা দেয় মনে, মননে, গোপনে, কবিতায়।
সাতদিনঃ শর্ত স্বাপেক্ষে লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে
বললে কি ছাড়তে পারবেন?
আহমেদ স্বপন মাহমুদঃ হুম
না; একদম
না। কবিতা লেথা তো তালুকদারি করা না যে, তালুক চাইলেই ফেরত দিয়ে ঘরে মুখ ভার
করে বসে থাকব। শর্ত মেনে যেমন লেখালেখি করতে আসি নি, সুতরাং শর্তসাপেক্ষে তা ছেড়ে দেয়ার
কথা্ তো অবান্তর। আর লেখালেখি কেউ ছেড়ে দিতে পারে না। ধরেন, কেউ বললো, বাপু, নদীতে সাঁতরাচ্ছো কেন, সাঁতার ছেড়ে দাও। তো, কস্মিনকালেও কেউ সাঁতার ছাড়তে পারবে
না। কেননা, সাঁতার
জানা এমন এক অর্জিত ও অভ্যস্ত সক্ষমতা যা চাইলেই ছাড়া যায় না। আর লেখালেখি তো আরও
অনেক উপরের ব্যাপার।ধরা বা ছাড়ার ব্যাপার না। ঘোর। লেখা তো ঘোরের মাত্র।ঘোরগ্রস্ত, বা ভুতগ্রস্তও বলতে পারেন। তো, তাকে ঝাড়ফুঁক দিয়ে সারানো সম্ভব না।
আপনার হাড় থেকে মাংস আলগা করলে যে অবস্থা হবে, মানে আপনার মরণমাত্র সম্ভাবনা তখন, লেখা ছাড়ার বিষয়টা আমার কাছে সেইরকম। সম্ভবত
জগতসংসারের এত ভার আমি বহন করতে পারতাম না যদি না আমি কবিতা লিখতাম। কবিতা আমাকে
ভারমুক্ত কেরে, ঘোরগ্রস্ত
করে, জগতে
আরো আরো নতুন নতুন জগত তৈরির প্রেরণা ও রসদ যোগায়।আমি জীবিত থাকি, লিখি, কাব্য করি।
সাতদিনঃ একজন লেখকের ভেতরের ‘মানুষস্বত্তা’ কে আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করেন?
আহমেদ স্বপন মাহমুদঃ ‘স্বত্তা’ দার্শিনিক প্রজ্ঞা ও প্রতীতির বিষয়।
মানুসস্বত্তা মানে তো মানুষের সত্তা। সত্তা নিয়ে তো দর্শনে মত ও ব্যাখার শেষ নেই।
ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না দেখা যায় না এমন কী যে তাকে স্বত্তা বলি। তাও মানুষের
আবিষ্কার।বিড়ালের কি স্বত্তা নেই? বিড়ালস্বত্তা। সুতরাং স্বত্তার বিষয়টি পাত্রভেদে আলাদা হয়। স্বত্তা
আবার স্বরূপেরও নাম। ধরেন, আমি বললাম, কবিসত্তা, বা একধাপ এগিযে বললাম, কবিতাসত্তা। কী বোঝা যয় তাতে। রূপ, আকার, প্রকৃতি ইত্যাদি তো। লেখকের তো
সেইগুলান বড় গুণ, বড় সত্তা। আর মনুষত্ত বললে আমরা বুঝি মানুষ কিনা, মানে মানুষের গুণাবলী, মানে কৃষ্টিসংস্কৃতি ও সমাজ চাপিয়ে
দেয়া কতগুলো উপাদান যেগুলোর উপর আমারাই গুলাগুণ আরোপ করেছি, দোষগুণ আরোপ করেছি, সেইসব গুনাগুণকে বুঝিয়ে থাকি। লেখক তো
মানুষ, মানুষের
দোষগুণ তার। হাসে, কাদে, রক্ত লাল, সমগুণে বশ। কিন্তু লেখক, মনে করা হয়, অনুভূতিপ্রবণ বেশি। সেটি কিন্তু সাধারণ
মানুষও হতে পারে। মৌলিক পার্থক্য, প্রকাশশক্তি বা প্রকাশশৈলী। লেখক তার দেখা ও না দেখা অভিজ্ঞতাগুলো
বণর্না করেন তার লেখায়, গল্প কবিতায় গানে চিত্রে। একজন মানুষ যিনি লেখক নন, সে হয়তো কেবল মন ভাঙে, মন পুড়ে, আর লেখক সেইসব মনভাঙা মনপুড়াদের নিজের
মনের সঙ্গে নিয়ে কাঁদে আর কান্নার কাহিনি বলে যায়, হাসে আবার হাসির কাহিনি বলে যায়। আর
দোষগুণের ব্যাপার, সৎ ও অসসতার ব্যাপারগুলো নিয়ে একক কোনো মান নেই, কালে কালে বদলায়, সমাজে সমাজে একেক রকম। স্থির ও একক
কোনো মনুষত্তের সত্তা নাই মানুষের।এই না থাকাটাই বৈচিত্র্য, মানুষের বিশেষত্ত্ব তাই, লেখকেরও। যে অর্থে, লেখকের ওপর দোষগুণ চাপাতে চাই, সেটা ঠিক আবার ঠিক না-ও হতে পারে।
সৃজনশীলতার নানা মুখ- বিনয় যেমন আছে তার, দুর্বিনীতও কম নয়- নিরহংকার বা
অহংকারীও কম নয়। এটা নির্ভর করে ব্যক্তি-লেখকের ওপর।
সাতদিনঃ মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেব?
আহমেদ স্বপন মাহমুদঃ সে
এক অনিবার্য নিয়তি। আহা যদি হাত থাকতো। মৃত্যু জৈবিক ও সামাজিক ক্রিয়াও বটে, যা ধার্য করা, যেমন জন্ম, যার উপর নিজের হাত নেই। মৃত্যু আমার
কাছে ভয়াবহ ঘটনাও আবার খুব সাধারণ। এই রূপরসগন্ধবর্ণের, রিপুর জগত থেকে অন্য কোনোখানে যাওয়া বা
কোথাও না যাওয়ার বিষয়টি মনে এলেই তো চমকে চমকে যাই, ভড়কে যাই।হাতের সাথে আঙুলের সম্পকের্র
মতো মৃত্যুও তো আমার সাথে ঘুমায়, জেগে থাকে, খায়, আড্ডা দেয়, আকাশ দেখে ইত্যাদি সেব আচারেই আমার জন্মের ক্রিয়াগুলোর মতো মৃত্যুও
ক্রিয়াশীল।আমি মানতে পারি না, আবার অসহায় হয়ে মেনে নেই। আহা, আরো কিছুদিন যদি প্রকৃতির গন্ধগুলো
পাওয়া যেত এই রকমের কত না আক্ষেপ ফুটে ওঠে মনে। একটা সময় বিশেষ করে তারুণ্যেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমাকে
মৃত্যুচিন্তা পেয়ে বসে, নিজের অজান্তেই। সে এক বিভীষিকাময় সময়। চিন্তা এমন এক জায়গায় নিয়ে
যায়, এমন
গহন শূন্যতায় যে, খেই হারিয়ে শেষপযর্ন্ত সম্বিৎ ফিরে আসে- পীড়া দেয়। কত রাত অনিদ্রায়
কেটে যায়, মৃত্যুচিন্তায়, বা মৃত্যুভয়ে। কেন এই ভয়? মৃত্যু জন্মের মতোই জৈবিক।সম্ভবত মরে
যাওয়াটাই আনন্দের, কেননা, বেঁচে থাকার জঞ্জাল জগতে খুব বেশি সহ্যসীমর মধ্যে থাকে না। আমরা তো
প্রতিনিয়তই মরে যাচ্ছি। মৃত্যুই যেন আমাদের বিশ্বস্ত অভিজ্ঞতা। না-বুঝা বয়ষ থেকেই মৃত্যু দেখে দেখে বড়
হচ্ছি, আর
নিজে যেন একটু একটু করে মরে যাচ্ছি। বিশেষ করে তারুণ্যের পরে পৌঢ়েত্বে মৃত্যু
বিষয়ক নানা চিন্তাভাবনা মনে চলে আসে। শরীরের কোষগুলো ক্ষয় হতে থাকে, দুর্বল হতে থাকে শরীর, স্মৃতি ও বিস্মৃতির প্রতিযোগিতায়
স্মৃতিগুলো মুছে যেতে থাকে, মস্তিষ্কের শক্তিও যে কমে যায়। এই প্রতিনিয়ত মৃত্যুর কথা মরা ভাবি
না। মুথের আকৃতি যেভাবে নিজের অজান্তেই বদলে যেতে থাকে সেইরকম জীবনও ধীরে ধীরে
অন্যপারের দিকে যেতে থাকে। কখনো কখনো মৃত্যুকে বড় দার্শনিক মনে হয়। সমাজের
সংস্কৃতির ভাবনা ও দায়গুলো মনে চলে আসে। ঘুমের মধ্যে যেমন আমরা বস্তুজগতের ক্রিয়া
থেকে মুক্ত থাকি, মনে হয় কখনো, এই জগত ইল্যুশন মাত্র।ঘুমসদৃশ।সবকিছুর পর, এই স্বজন বন্ধু পরিবার, আপন মানুষদের থেকে, মায়া থেকে, আবেগ থেকে, প্রকৃতি থেকে নিজেকে মহাকালের কাছে
সঁপে দেয়ার যে ভাবনা তা অস্থির করে তোলে আমাকে। আমার কবিতায় একটা বড় জায়গা জুড়ে
মৃত্যুচিন্তা ও ভাব হাজির-নাজির।
সাতদিনঃ লেখালেখি ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয়
এবং অপ্রিয়?
আহমেদ স্বপন মাহমুদঃ মানুষের
মুখ আমার প্রিয়। প্রতিটা মুখ আহা কী যে স্বাতন্ত্র! প্রতিটা মুখের ভিন্ন ভিন্ন
অভিব্যক্তি দেখে আমি বিস্ময়ে দোল খাই। প্রকৃতি লতাগুল্ম প্রিয় আমার; পাতাদের নাচন, গাছেদের দোলা, পোকামাকড়ের চলনবলন এসব আক্রান্ত করে।
লেখালেখি আমি নিয়মিত করি; নিয়মিত আড্ডা দেই, গল্প করি, পান করি। আড্ডা সম্ভবত সবচেয়ে প্রিয় আমার, বন্ধুত্ব ও কাহিনি ছাড়া লেখা মনে হয়
প্রায় অসম্ভব।পড়া তো কিছু না কিছু নিয়মিত হয়। এই জীবন জগত ও মানুষের ভাব, ভাবনা ক্রিয়াগুলো নিয়ে ভাবতে ভালো
লাগে। আরও কিছু যেমন তাস খেলা। এই রঙের উত্তেজনা যেন আর কোথাও নাই। সাহেব বিবি
গোলামের কারসাজি আঙুলে এসে যখন একসাথে সমর্পিত হয় তখন তো সবচেয়ে উত্তেজনাকর সময়।
আবার এই তাসের বৈসাদৃশ্য হাতে ওঠে এলে নিস্তরঙ্গ একেবারে, যেন সব চুপসে যায়। দেউলিয়া করে। এই
বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা তো সবসময় পাওয়া যায় না, বিশেষ করে, খেলুড়েদের এটিচুড, মনোভঙ্গি কত কত ধারণা দেয়; কত কত গল্প হয় খেলায়; এইগুলো বেশ প্রিয় আমার।
অপ্রিয় তালিকা তেমন কিছু না। মানুষের চিন্তা ও
ভাবনার মুক্তি দরকার, ভাবের মুক্তি দরকার। আমাদের সমাজে, সাহিত্যে সত্যি বলতে কী, এখনো রূচি নির্মিত হয় নি, শিক্ষা নেই, মান নেই। পুরো জাতি ডুবে আছে, যে যার মতো জীবন বাঁচাও। সরকার ও
রাষ্ট্র একেবারে দউলিয়া; কবিসাহিত্যিক সংস্কৃতিকর্মীরা সংকীর্ণ, দুপয়সার স্বার্থে দলীয় রাজনীতির কাছে
সঁপে দিয়ে সত্যমিথ্যার নীতিনৈতিকতার কোনো ধার ধারছে না; ব্যভসাবাণিজ্য সম্পদ তৈরিতে তারা
ব্যস্ত। এমন উচ্ছন্নে যাওয়া সমাজের গল্প খুব কমই আছে ইতিহাসে।মুক্তিসংগ্রামের
মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী জাতি এত দ্রুত ও সহজেই যে নিজের বিনাশ ডেকে আনে, এই নজির বিরল। অথচ কত না সম্ভাবনাময় দেশ এখনো।
কবিসাহিত্যিকশিল্পীরাও মাথা থেকে পা পযর্ন্ত যেন পচে গেছে। এতটা বিভক্তি, আপন মানুষে মানুষে আপন জাতিতে এতটা
বিভেদ ও হিংসাপ্রতিহিংসা দেখা যায় না আর। এইসব অনাচারক্রিয়া মন বিষিয়ে দেয়, নিজেকে অনেক নীচে নামিয়ে দেয়, অবশ করে দেয় শক্তিসামর্থ্য। এইসব
ক্রিয়াকাণ্ড— হিংষা, রেষারেষি, বিদ্বেষ এবং মানুষেদের সংকীর্ণতা অরূচি
লাগে আমার।
সাতদিনঃ সাহিত্যের বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শ্ত্রুকে কি ভাবে
মূল্যায়ন করেন?
আহমেদ স্বপন মাহমুদঃ ধ্যুর, কী যে বলেন। আমার কোনো শত্রু নাই। এই
প্রকৃতি সত্যিই বন্ধুবৎসল। তবে সত্যি কি, আমার একটি বন্ধুও নেই। সবাই বন্ধুর ভাণ
করে আছে। একদিন মনে হবে, হায়, কোথায় কী, সব দেখি স্বার্থের সারথী। নগরে বন্ধু হয় না প্রকৃতপক্ষে, নগরে ঘনিষ্ট মানুষ থাকেন, পরিচিত অনেকেই থাকেন, অনেকের সাথে আড্ডা গল্প কতকিছুই না হয়।
তবুও তো শেষপযর্ন্ত একাকী ঘরে ফিরতে হয়, বা হয় না। আমি অনেকটা নিরপরাধ চলাফেরা
করি; সাহিত্যঅঞ্চলে
যেসব নামযশের প্রতিযোগিতা চলে সেসবে থাকি না, নগরের প্রান্তে থাকি, ফলে আমি গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্টেক না; ফলে শত্রু নাই, আমার লেখাটা আমি লিখতে পারি, গল্প আড্ডা ও নেশার ফাঁকে ফাঁকে, নেশাগ্রস্ত হয়ে। তবুও তো শুনি, কত যে কথা! কত কত জনের অপার সচলতা, বাচালতা! অনেকে হয়তো পছন্দ করেন না-, অনেকে সহ্যও দেখছি করে না, অধঃস্তন যারা। কারণ অনেকের কাছেই আমি
ঈর্ষণীয় জীবনযাপন করি, স্বাধীন জীবনযাপন করি। পরাধীন অন্তরের মানুষদের কাছে আমাকে
নিয়ে ঈর্ষা করা অস্বাভাবিক না। লিখছিও তো নিয়মিত, দেশে দেশে ঘুরছিও নিয়মিত। খাচ্ছি
দাচ্ছি, কাউকে
তেলাচ্ছি না, তেল
দিচ্ছি না, এমন
মানুষদের সমাজ আর কতটুকু নেয়? তো, আবার পছন্দ তো করেন অনেকে, দেখছি। আমাদের দরকার সৎ সমালোচনায়
মনোনিবেশ করা, ব্যক্তির
বা নিজের পাছা চুলকানির চেয়ে সাহিত্যের চুলকানি যত বেশি করব তত বেশি মঙ্গল; সাপ ও ব্যঙের তখন আলাদা আলাদা চরিত্র ও
বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে উঠবে।
আমি জগতকে আপন ভাবি, মানুষেকে আপন ভাবি, বিশ্বাস করি। তাতে আমি ঠকি না, জিতে থাকি। প্রকৃতির সন্তান হিসেবে
মানুষকে আপন ভাবা ছাড়া গত্যন্তর নাই। জগত বন্ধু আমার, শত্রু নহে।
শুভমস্তু।*লেখকের গ্রন্থসমূহ
-------------------- কাব্যগ্রন্থ
অতিক্রমণের রেখা ;
সকল বিকেল আমাদের অধিকারে আছে;
অবিচল ডানার উত্থান;
আদিপৃথিবীর গান;
আগুন ও সমুদ্রের দিকে;
আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল;
প্রেম, মৃত্যু ও সর্বনাম ;
অতিক্রমণের রেখা নির্বাচিত কবিতা;
ভূখণ্ডে কেঁপে ওঠে মৃত ঘোড়ার কেশর;
রাজার পোশাক;
অনেক উঁচুতে পানশালা।
অতিক্রমণের রেখা ;
সকল বিকেল আমাদের অধিকারে আছে;
অবিচল ডানার উত্থান;
আদিপৃথিবীর গান;
আগুন ও সমুদ্রের দিকে;
আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল;
প্রেম, মৃত্যু ও সর্বনাম ;
অতিক্রমণের রেখা নির্বাচিত কবিতা;
ভূখণ্ডে কেঁপে ওঠে মৃত ঘোড়ার কেশর;
রাজার পোশাক;
অনেক উঁচুতে পানশালা।
--------------------গদ্যগ্রন্থ
সমূহ সংকেতের ভাষা;
কলমতালাশ : কবিতার ভাব ও বৈভব।
সমূহ সংকেতের ভাষা;
কলমতালাশ : কবিতার ভাব ও বৈভব।
-----------------অন্যান্য
কর্পোরেট বিশ্বায়ন ও কৃষির রাজনীতি;
Facing the Challenges of Corporate Globalization: Role of Media, Information and Communication Technology;
স্বাধীন সাংবাদিকতা: গণমাধ্যম ও সুশাসন;
Monga: the art of politics of dying;
কর্পোরেট বিশ্বায়ন: তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক উন্নয়ন।
কর্পোরেট বিশ্বায়ন ও কৃষির রাজনীতি;
Facing the Challenges of Corporate Globalization: Role of Media, Information and Communication Technology;
স্বাধীন সাংবাদিকতা: গণমাধ্যম ও সুশাসন;
Monga: the art of politics of dying;
কর্পোরেট বিশ্বায়ন: তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক উন্নয়ন।
আমাদের আনন্দের অংশটুকু সাহিত্যের কাছে জমা
আমার একজনই বন্ধু, তার নাম হাবীবুল্লাহ সিরাজী। আমার
একজনই শত্রু তার নাম হাবীবুল্লাহ সিরাজী।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: মূল্যায়নের বিষয়টিই
আপেক্ষিক। আর নিজের লেখালেখি নিয়ে মন্তব্য করা কিংবা মূল্যায়নের পর্যায়ে যাওয়া তো
রীতিমতো দুরূহ ব্যাপার। যে দু-টি মান নির্ধারণের ভার নেয়, তা নিয়েই সংকট চলছে। তাই মানদন্ড যেরূপ
দোদুল্যমান, তেমনি
মূল্যায়ণও প্রায় মূল্যহীন হ’তে ব’সেছে। লেখালেখির বয়স দীর্ঘ বা হ্রস্ব হোক, তা কোনো বিষয় নয়, ঘটনা হলো কী লেখা হ’চ্ছ? হ’চ্ছে, ছাতুর সঙ্গে জল মিলছে, তেলের মধ্যে আলু পড়ছে! এই মিলমিশের
ভেতর দিয়েই শর্করা ও সব্জি — আমিষের খোঁজে ছুটছে। ‘খাচ্ছে, কিন্তু গিলছে না!’
সাতদিন: আপনার প্রথম লেখা এবং প্রথম বইয়ের
অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: প্রথম লেখা বালক বয়সের, কালীদাস রায়ের একটি কবিতার অনুকরণে
পংক্তি সাজানো। ১৯৬০ সাল থেকে আজ অব্দি দেশি-বিদেশি ছায়ার মধ্যেই তো আছি। আর প্রথম বই ‘দাও
বৃক্ষ দাও দিন’ ১৯৭৫
সালে মুক্তধারা প্রকাশ করে। বইটির কবিতা নির্বাচনের জন্য কবি আহসান হাবীব এবং
প্রকাশনার জন্য কবি আবদুস সাত্তারের কাছে আমার ঋণ অপরিসীম।
সাতদিন: বাংলা সাহিত্যের কোন শাখা তুলনামুলক
ভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন ?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: বাংলা সাহিত্যের চর্চা
বর্তমানে পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে গেছে। তবুও বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষকে কেন্দ্রে
গ্রহণ ক’রে
বলা চলে — কবিতাই
নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের কবিতার শরীরে যে লবণ ও পলির মিশ্রন তা
তাকে দিয়েছে — সংগ্রামের
লাবণ্য এবং প্রেমের সুষমা। আমাদের মাইকেল যে কপোতাক্ষে স্পন্দিত — তাতে কি লালনেরও সাড়া মেলে না?
সাতদিন: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য
জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের
কোনো ভেদ নেই। প্রযুক্তি ও সাহিত্য হাত ধরাধরি ক’রে মূল থেকে ফল পর্যন্ত জীবনকে অধ্যায়ণ
করে। আমাদের আনন্দের অংশটু তাই সাহিত্যের কাছে যেমন জমা, তেমনি বিজ্ঞানের সঙ্গেও যুক্ত। বিষয়টি
নিয়ে তাই সংশয় ও সন্দেহের অবতারণা না ক’রে — যার-যার অবস্থান থেকে চর্চা থেকে
অনুসন্ধান পর্যন্ত প্রবাহিত হ’তে দেয়াই জীবনের জন্য উত্তম।
সাতদিন: আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন
কি?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: লেখক ও পাঠ নিয়ত বদলে
যাচ্ছে। সহসা কোনো নতুন পাঠেই উঠে আসতে পারে একজন প্রিয় লেখক। ডিলান টমাস থেকে
জীবনানন্দ দাশ — কিংবা
আমার সময় থেকে অরুন্ধতী — তারা যে পরিভ্রমণের অংশীদার, তারও কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই!
সাতদিন: আপনার নিজের প্রিয় লেখা কোনটি এবং কেনো?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: ওরে বাবা, আমার প্রিয় লেখা? আমি লিখতে-লিখতে হয়তো লেখক (!), তার আবার প্রিয় লেখা নিয়ে বলা। যা লিখি
তা কবিতা কীনা বুঝি না। আর এ জন্মে বুঝি স্পর্শ করার স্পর্ধাই হলো না, আর তো আলিঙ্গন!
সাতদিন: আপনার লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা কি?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমার লেখালেখির পেছনে মূল
প্রেরণা ‘আমি’, আর দৈনিক পত্রিকার পাতায় কিংবা সাহিত্য
পত্রিকায় মুদ্রিত হরফে নাম দেখার আকাক্সক্ষা! তবে এর বাইরে, এক ধরণের প্রতিযোগিতাও আছে— অমুকের ঠোঁট কিংবা তমুকের আঙুল
পর্যন্ত পৌঁছানো। মনোহরের মঞ্জু থেকে কুমারের কৈবর্ত্য পর্যন্ত সে গন্ধ বিস্তৃত।
সাতদিন:: শর্ত সাপেক্ষে লেখালেখি ছেড়ে দিতে
বললে কি ছাড়তে পারবেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমার লেখালেখিতে কোনো শর্ত
নেই। কোনো লোভ নেই, কোনো প্ররোচনা নেই। তাই ছাড়ার প্রশ্ন বাতুলতা।
সাতদিন: এক জন লেখকের ভেতরের ‘মানুষস্বত্তা’ কে আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: একজন ভালো লেখক মানে একজন ভালোমানুষ।
কোনো মন্দমানুষ ভালো লিখতে পারে— তা আমি কল্পনাও করতে পারি না। মনুষ্যসত্তা আছে বলেই তিনি মানুষের
লেখক হ’য়ে
ওঠেন। ‘মানুষ’ ও ‘লেখক’ একই নৌকার দুই গলুই!
সাতদিন: মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখবেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: জন্মের পর থেকে যে সত্যটি
প্রথম দাঁড়ায় তা মৃত্যু। অতএব মৃত্যু নিয়ে ভাবনা, মৃত্যুচিন্তা নিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করা
আমার পছন্দ নয়। যে অর্থে আমার জন্ম সত্য, সে অর্থে আমার মৃত্যু মহাসত্য। মৃত্যুর
পর আর কিছু নেই, তাই
চাওয়া-পাওয়ার পরবর্তী বিষয়গুলো নিয়ে মথা ঘামাই না। যীশু ক্রুশকাঠে ছিলেন, যীশু কবরে শায়িত ছিলেন— এই পরমসত্যের পাশাপাশি অলৌকিক অন্য
কোনো ধারণা করার জ্ঞান আমার নেই। আবার মৃত্যু আমার জন্য কোনো ‘শ্যাম’ও নয়। সত্যের জন্য কোনো চিন্তা থাকে না, নিত্য গ্রহণের একটি অপেক্ষা থাকে
মাত্র।
সাতদিন: লেখালেখি ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয়
এবং অপ্রিয়?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: পড়া এবং লেখা আমার কাছে
কতোটা প্রিয়, ঠিক
বুঝতে পারি না। তবে পানশালা প্রিয়, প্রিয় টিভিতে খেলা দেখা, প্রিয় অনির্ধারিত ভ্রমণ। এবং অপ্রিয়, যতোটুকু জানি তার চেয়ে বেশি বলা। অভিনয়
ও বাস্তব একই রাস্তার উল্টো-সিধা-মানি, তারপরও রস খেতে চাই না — ফলটিই চাই !
সাতদিন: সাহিত্যের বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শত্রুকে কি ভাবে
মূল্যায়ন করেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমার একজনই বন্ধু, তার নাম হাবীবুল্লাহ সিরাজী। আমার
একজনই শত্রু তার নাম হাবীবুল্লাহ সিরাজী। বন্ধু ও শত্রু শব্দ দু’টিই ভুয়া।====================
আমি তো মাছ-মাংস বিক্রেতা নই যে,
নিজের লেখালেখিকে বাজারের সেরা বলে প্রচার করবো
----------------------------------
শত্রু তাকে আমি বুঝতে দেই না যে সে আমার শত্রু। আমি বুঝি এবং জানি যে আমি নিজে থেকে শত্রু সৃষ্টি করি নি বা করি না, ফলে যে আমার শত্রু সে শত্রুতা তারই সৃষ্টি। এ থেকে যেটা হয়, সেই শত্রু একদিন নিজে থেকে এসে ক্ষমা চেয়ে নেয় বা বন্ধুর মতো হয়ে যায়। আমার জীবনে এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। নামও জানানো যায় সেইসব শত্রুদের। থাক্, এই ছোট্ট পৃথিবীর সময়কালে বিভেদ বাড়িয়ে লাভ কি?
সাতদিনঃ নিজের লেখালেখিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
শাহাবুদ্দিন নাগরীঃ নিজের লেখালেখির মূল্যায়ন করা খুব কঠিন কাজ। আমি তো বাজারের মাছ-বিক্রেতা বা মাংস-বিক্রেতা নই যে, নিজের লেখালেখিকে বাজারের সেরা বলে প্রচার করবো। লিখি, মনের আনন্দ-বেদনায় লিখি, সেই লেখা প্রকাশও করি পত্র-পত্রিকায়, পাঠকের ভালো-মন্দটাই আসল। পাঠক যদি একটুও আনন্দ পান, তবে সেটা খুশিই করে। বছর দশেক আগে একবার একজন সিনিয়র কবি আমাকে বলেছিলেন কবিতা না লিখতে। তার চেয়ে নাকি আমার শিশুসাহিত্য করাই ভালো। দশ বছর পর তিনি যখন সিদ্ধান্ত পাল্টান তখন এক ধরনের আনন্দ পাই। মূল্যায়ন করা খুব কঠিন কাজ, এখানে মূল্যায়ন করার মতো একজনও খুঁজে পাই না। আরেকজন মান্নান সৈয়দ প্রয়োজন।
সাতদিনঃ আপনার প্রথম লেখা এবং প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
শাহাবুদ্দিন নাগরীঃ আমার প্রথম লেখা নিয়ে অনেক জায়গায় বলেছি। অনেক সাক্ষাৎকারে। প্রথম বইয়ের কথাও। আমার একটি বইয়ের ভূমিকা থেকে তা আবার উদ্ধৃত করে দিলাম।
‘১৯৬৮ সালে ঢাকায় চলে আসি। বাসায় দুটো পত্রিকা রাখা শুরু হলো তখন থেকে- দৈনিক ইত্তেফাক এবং দৈনিক আজাদ। আমার জন্য অবশ্যপাঠ্য হয়ে উঠলো ‘কচি কাঁচার আসর’ এবং ‘মুকুলের মহফিল’। শুরু হলো লেখা পাঠানোর কাজ। ১৯৬৯-এর আন্দোলনের দিনগুলোতে লিখতে শুরু করি আরো নতুন নতুন ছড়া। লেখা পাঠাই নিয়মিত, কিন্তু ছাপা হয় না কোনো পত্রিকাতেই। দু’এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে আবার নতুন লেখা পাঠাই। ছাপা হয় না। শেষ পর্যন্ত ৩০ জুলাই, ১৯৬৯ আমার লেখা ছাপা হয়ে প্রথম বেরুলো দৈনিক আজাদের ‘মুকুলের মহফিলে’, পরের বছর চার লাইনের ছড়া ছাপা হলো দৈনিক ইত্তেফাকের ‘কচি কাঁচার আসরে’। ............... প্রথম বই ‘নীল পাহাড়ের ছড়া’ (১৯৭৮) প্রকাশ করে ‘মুক্তধারা’ [স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ]। ১৯৭৬ সালে আমি দুটো ছড়ার বইয়ের পা-ুলিপি তৈরি করে স্বর্গীয় চিত্তরঞ্জন সাহার (আমি ডাকতাম দাদা বলে) কাছে সাহস করে পাঠাই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষ অনার্সের ছাত্র তখন। ঢাকায় কখনো এলেও ফরাশগঞ্জের ৭৪ নম্বর বাড়িটি ভয়েই মাড়াই না। বছরখানেক পরে একদিন মুক্তধারা’র খামে একটি চিঠি আসে। চিত্তদা’র স্বাক্ষরে প্রেরিত চিঠিটি পেয়ে হাত-পা কেঁপে উঠেছিলো তা আজ অস্বীকার করবার জো নেই। ছড়ার বই প্রকাশ কতো যে ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার তা এর প্রকাশকমাত্রই অবগত আছেন। চট্টগ্রাম থেকে পাঠানো পা-ুলিপি ‘মুক্তধারার’ মতো সুখ্যাত ও বৃহৎ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের আনুকুল্য পাবে, তা ছিলো আমার কল্পনার বাইরে। দাদা লিখেছিলেন যে, দু’টি পা-ুলিপি থেকে ছড়া বাছাই করে একটি পা-ুলিপি তৈরি করে একটি বই প্রকাশ করা যায়। আমি রাজি থাকলে তাঁকে যেন জানাই। সময়ক্ষেপণ না করে তাতেই সম্মত হয়ে যাই এবং ছড়া বাছাইয়ের দায়িত্বটিও মুক্তধারা’র হাতে ছেড়ে দেই। পা-ুলিপি তৈরি হয়, আমার দেয়া নামটাই রাখা হয় -‘নীল পাহাড়ের ছড়া’। চুক্তিপত্র আসে, ৫০০০ কপি ছাপা হবে প্রথম সংস্করণে, আমি বই বিক্রয়ের ওপর রয়্যালটি পাবো ৫%, বইয়ের দাম ৫.৫০ টাকা। সবকিছু আমি দ্রুততার সাথে করলেও ঢাকায় কাজ এগুচ্ছিলো নিয়মমাফিক। পা-ুলিপি যায় শিল্পী প্রাণেশ ম-লের কাছে। চার রঙের প্রচ্ছদ এবং ভেতরে পাতায় পাতায় গাঢ় সবুজ রঙের ইলাসট্রেশন, ২৪ পৃষ্ঠার বই, ডেটলাইন ডিসেম্বর ১৯৭৮-‘নীল পাহাড়ের ছড়া’র ২৫ কপি বই আমার হাতে আসে ডিসেম্বর, ১৯৭৮-এর মাঝামাঝি। আমার জীবনের আনন্দময় সময়গুলো এসে জড়ো হয়েছিলো তখন। সবচেয়ে খুশি হয়েছিলো আব্বা-আম্মা এবং ভাইবোনেরা।’
সাতদিনঃ বাংলা সাহিত্যের কোন শাখা তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন ?
শাহাবুদ্দিন নাগরীঃ বাংলাসাহিত্যের (এবং তা যদি হয় বাংলাদেশের) কথাই যদি বলেন তবে আমার মনে হয় আমাদের কথাসাহিত্য (উপন্যাস) এবং কবিতা সবচেয়ে সমৃদ্ধ। উপন্যাসের কথাটা মাথায় এলো এই কারণে যে, এটা ভুরি ভুরি লেখা হয় না, একটা নিজস্ব গতিতে এর চলা, যারা লেখেন তারাও নিয়ম করে লেখেন। এইসব লেখালেখির ভেতর থেকে আমরা কিছুদিন পরপর পেয়ে যাই ভালো ভালো উপন্যাস। মনে রাখবার মতো মনে দাগ কেটে যায়। তরুণ কথাসাহিত্যিকরাও এ ব্যাপারে খুব সজাগ। হুমায়ূন আহমেদ এক ধরনের উপন্যাস লিখতেন, তার প্রখর রসবোধ এবং কাহিনী বলার সক্ষমতা আমাদের ঐ ধারাটিকেও উজ্জীবিত করেছে। আর যারা সিরিঅস উপন্যাস লেখেন তারা তুলে আনেন সমাজ, কাল, মাটি, মানুষের গল্প। ভাষায় ভিন্নতা আছে, ভালো লাগে। আর কবিতার কথা যদি বলি, তবে বলতেই হবে, হাজার হাজার অকবিতার ভেতরও নির্মিত হচ্ছে ভালো কবিতা। অসম্ভব ভালো কবিতা।
সাতদিনঃ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
শাহাবুদ্দিন নাগরীঃ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি চলিষ্ণু পৃথিবীর ফসল। একে বাদ দেয়া যাবে না। অনেকেই দীর্ঘকাল ধরে কম্পিউটারে লেখালেখি করেন। অভ্যাস হয়ে গেলে মাধ্যমটি চমৎকার, ইচ্ছেমতো তাৎক্ষণিক সম্পাদনা করে নেয়া যায়। তাছাড়া, ইন্টারনেট প্রযুক্তি আমাদের সামনে বিশাল পৃথিবীকে নিয়ে এসেছে আঙুলের ডগায়। ক্লিক করলেই নিজের তথ্যভা-ার পূর্ণ করে নিতে সময় লাগে না। এই প্রযুক্তি আসার আগে আমরা যখন কোনো গবেষণার কাজ করতাম, তখন জার্নাল আর বই খুঁজে খুঁজে তথ্য আহরণ করতে হতো। এখন সেই শ্রম আর লাগে না। তাছাড়া, বিশ্বের কোথায় কী বই বের হচ্ছে, কে কী লিখছেন, সেটা এখন সহজেই জানা যায়। ভাবনাচিন্তার দরোজাগুলো খুব সহজেই খুলে যায় আমার সামনে। পৃথিবীর বেশ ক’টি কবিতা পত্রিকা আমি ই-মেইলে পাই, সেগুলো পাঠ করতে পারি, কিছু শেখা হয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণেই। তবে নিজের কথা বলি, এতো সুবিধের পরও আমি কাগজে-কলমে না লিখলে শান্তি পাই না। ব্যাকডেটেড রয়ে গেলাম বোধহয়।
সাতদিনঃ আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি ?
শাহাবুদ্দিন নাগরীঃ প্রিয় লেখকের তালিকা আমার দীর্ঘ। কলেজ-ভার্সিটিতে পড়বার সময় খুব পছন্দ করতাম শহীদ কাদরীর কবিতা। তার ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ আমার টেবিলেই থাকতো। পছন্দ করতাম শামসুর রাহমান-আলমাহমুদকে। ‘এক ধরনের অহংকার’-এর অনেক কবিতা আমি এখনও মুখস্ত বলে যেতে পারি। এদের কবিতা ভালো লাগতো বলে যে আর কারো কবিতা বা লেখা ভালো লাগে না তা না। ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাট্ল ট্রেনে যেতে যেতে একটি পত্রিকায় সানাউল হক খানের একটি কবিতা খুব ভালো লেগে যায়। আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘আপন যৌবন বৈরী’ বেরুবার পর তার অন্ধভক্ত হয়ে যাই কবিতাগুলো পড়ে। আবিদ আজাদের প্রায় সব কবিতাই আমার প্রিয়। ১৯৭২ সাল থেকে ময়ুখ চৌধুরীকে আমি চিনি, তার কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয়। তার সম্প্রতিকালের প্রায় সব কবিতাই অসম্ভব ভালো লাগে। মনোযোগ দিয়ে পড়ি। নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরীর কবিতা আমার প্রিয়, এরা অনেকেরই প্রিয়। মহাদেব সাহার কিছু কিছু কবিতা মাঝে মাঝে ভালো লেগে যায়। রুদ্রের বেশ কিছু কবিতা আমার প্রিয়। আর আবদুল মান্নান সৈয়দের মননশীল লেখাকে এখনও কেউ পেরিয়ে যেতে পারে নি। আরো অনেকেই প্রিয়, শিশুসাহিত্যে লুৎফর রহমান রিটন প্রিয় আগে থেকেই, ইদানিং তার গদ্যের বইগুলো পড়ে আনন্দ পাচ্ছি। এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ অনেক কিছু লেখেন, কিন্তু তার রাজনৈতিক ছড়ার এবং সুকুমার বড়–য়ার উদ্ভট ছড়ার তুলনা নেই। আন্দালিব রাশদীর উপন্যাস একটা পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করছে, আমিও তাদের একজন।
সাতদিনঃ আপনার নিজের প্রিয় লেখা কোনটি এবং কেনো?
শাহাবুদ্দিন নাগরীঃ আমার প্রিয় কোনো লেখা নেই, অথবা হতে পারে সব লেখাই আমার প্রিয়। যাচাই-বাছাই করে দেখি নি। তাছাড়া, দেশের বড় কোনো সাহিত্য পুরস্কার আমি পাই নি, পেলে হয়তো নিজেকে বিশ্লেষণ করে দেখতাম।
সাতদিনঃ আপনার লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা কি?
শাহাবুদ্দিন নাগরীঃ আমার লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা যে কী তা আমি বলতে পারবো না। আনন্দ পেলে লিখি, কষ্ট পেলে লিখি। অবসর পেলে লিখতে ইচ্ছে করে। বন্ধুদের লেখা পড়লে নতুন কিছু লিখতে আগ্রহ জাগে। আসলে বোধহয় আমার মনই আমার প্রেরণা। মন না চাইলে কিছুই লেখা হয় না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাগজ সাদা পড়ে থাকে।
সাতদিনঃ শর্ত স্বাপেক্ষে লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে বললে কি ছাড়তে পারবেন?
শাহাবুদ্দিন নাগরীঃ শর্ত দিয়ে যখন লেখা শুরু করি নি, তখন শর্ত সাপেক্ষে ছেড়ে দেয়ার প্রশ্ন আসবে কেন? যেদিন শরীর ও মাথায় কুলোবে না, সেদিন শর্ত লাগবে না, এমনিই কলম বন্ধ হয়ে যাবে।
সাতদিনঃ একজন লেখকের ভেতরের ‘মানুষস্বত্তা’ কে আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করেন?
শাহাবুদ্দিন নাগরীঃ লেখক তো একজন মানুষই। তার চারপাশেও পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়স্বজন আছেন। এদের সবার আনন্দ-বেদনার সঙ্গী হয়েই লেখককে জীবনযাপন করতে হয়। বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে নিয়েই তার বসবাস। লেখক তো এদের এড়িয়ে থাকতে পারেন না। বোহেমিয়ান জীবনযাপন করে অনেকে অভ্যস্ত, কিন্তু আমার মনে হয় না লেখক হতে হলে বোহেমিয়ান হবার প্রয়োজন আছে। লেখকের মন যদি অন্যের আনন্দে-কষ্টে সমভাবে দোলায়িত না হয়, তবে সে আর লেখক কি ? কথায় আছে না, কবিই তো বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’, আমিও তাই মনে করি।
সাতদিনঃ মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
শাহাবুদ্দিন নাগরীঃ মৃত্যু সেতো আসবেই। ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’ এটা সারাক্ষণ মাথায় থাকা উচিৎ। আমার তো প্রতিনিয়তই মনে হয় - আল্লাহ্ কখন কীভাবে আমাকে নেন সেই অপেক্ষায় আছি।
সাতদিনঃ লেখালেখি ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয়?
শাহাবুদ্দিন নাগরীঃ গান পছন্দ করি। বেড়াতে, বিশেষ করে দেশের বাইরে, ভালো লাগে। বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগে, উপভোগ করি। শহরে জোছনা দেখা যায় না, দেখতে পেলে ভালোই লাগে, বিশেষ করে পূর্ণিমা রাতের জোছনা। বন্ধুরা মিলে জমজমাট আড্ডা দিতে ভালো লাগে, পান্তা ভাত খেতে ভালো লাগে, রাস্তার পাশের ফুটপাথের দোকানের দুধ-চা খেতে ভালো লাগে। ফেসবুকে আড্ডা দেয়াও আজকাল প্রিয় বিষয় হয়ে উঠছে। সবচেয়ে অপ্রিয় কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারা এবং কেউ কথা দিয়ে কথা না রাখলে। আমার যেটা প্রিয় সেটা আমি খেয়ে নিই, কিন্তু যেটা পছন্দ করি না সেটা খাবার জন্য বারবার কেউ অনুরোধ করতে থাকলে বিরক্ত হই।
সাতদিনঃ সাহিত্যের বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শত্রুকে কি ভাবে মূল্যায়ন করেন?
শাহাবুদ্দিন নাগরীঃ বন্ধু বন্ধুই, তার মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যে শত্রু তাকে আমি বুঝতে দেই না যে সে আমার শত্রু। আমি বুঝি এবং জানি যে আমি নিজে থেকে শত্রু সৃষ্টি করি নি বা করি না, ফলে যে আমার শত্রু সে শত্রুতা তারই সৃষ্টি। এ থেকে যেটা হয়, সেই শত্রু একদিন নিজে থেকে এসে ক্ষমা চেয়ে নেয় বা বন্ধুর মতো হয়ে যায়। আমার জীবনে এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। নামও জানানো যায় সেইসব শত্রুদের। থাক্, এই ছোট্ট পৃথিবীর সময়কালে বিভেদ বাড়িয়ে লাভ কি?
শাহাবুদ্দিন নাগরীর জন্ম : শিবনগর, কানসাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ০৬ অক্টোবর, ১৯৫৫ (দাপ্তরিক জন্মতারিখ ০২ মার্চ, ১৯৫৬)। প্রকাশিত গ্রন্থ : কবিতা : ভালোবাসা আমার ঠিকানা (১৯৯৩), ঘাতক তুমি সরে দাঁড়াও, (১৯৯৩), এক মুঠোতে দুঃখ আমার এক মুঠোতে প্রেম (১৯৯৫), ও দেবী ও জলকন্যা (১৯৯৮), করতলে চুমু দেয় চাঁদ (১৯৯৯), মধ্যরাতে পায়ে দিলাম চুমো (২০০১), কবিতাসমগ্র (২০০২), আগুনের ফুল ফোটে ঠোঁটে (২০০৩), দরোজায় দাঁড়িয়ে আছি (২০০৪), চড়বসং (২০০৫), দুলে ওঠে রূপালি চাদর (২০০৬), বৃষ্টি ও জোছনার কবিতা (২০০৯), মুছে যায় জলরং ছবি (২০০৮), প্রেমের কবিতা (২০০৯), জলের নিচে জলছায়া (২০১০), ), Midnight Locomotive and Other Poems (২০১০), ভেঙে যায় মধুর পেয়ালা (২০১১), The Black Cat and Other Poems (2011, Published by Authorhouse, USA), কবিতাপুর (২০১২), নির্বাচিত ১০০ কবিতা (২০১৩), যেখানে খনন করি সেখানেই মধু (২০১৪);
ছড়াগ্রন্থ : নীল পাহাড়ের ছড়া (১৯৭৮), মৌলি তোমার ছড়া (১৯৮৬), রকম রকম ছড়া (যৌথ ১৯৮৬), ছেলেবেলার দিন (কিশোর কবিতা, ১৯৮৮), প্রতিদিনের ছড়া (১৯৮৯), ছড়ার হাট (১৯৯০), স্বাধীনতার ছড়া (১৯৯০), রাজপথের ছড়া (১৯৯১), আজকালের ছড়া (১৯৯৩), খেয়ালখুশির ছড়া (১৯৯৮), নকশীকাটা ছড়া (১৯৯৯), ছড়ার পালকি (২০০২), ছড়ায় জানে লড়তি (২০০২), ছড়ার বাড়ি (২০০৬), ছড়ার ঘুড়ি উড়োউড়ি (২০০৯), কালের ছড়া (২০০৯), মজার ছড়া (২০১০), নির্বাচিত ছড়া (২০১১), পাঁচমিশালি ছড়া (২০১২), সাত রকমের ছড়া (২০১৩), আজগুবি ছড়া (২০১৪);
শিশুসাহিত্য : ডেটলাইন টেকনাফ (কিশোর উপন্যাস, ১৯৮৭), বিলু মামার গবেষণা (কিশোর গল্প, ১৯৯৩), হুলোবিড়ালের হুকুমনামা (কিশোর ফিকশন, ২০০২), কিশোরসমগ্র (২০০২), টুটুলের মোনাসা (কিশোর ফিকশন, ২০০৬), বিলু মামার নিউ প্রজেক্ট (কিশোর গল্পগ্রন্থ, ২০০৬), আমার বন্ধু এবিসি (কিশোর গল্পগ্রন্থ, ২০০৬), রুশি (কিশোর ফিকশন, ২০১৪);
প্রবন্ধ/গবেষণা : মহাকালের বাতিঘর (১৯৮৬), শাহাবুদ্দীন নাগরীর কলাম (কলাম, ১৯৯৩), নারীবাদ (কলাম, ২০০২), পেরেকবিদ্ধ কবিতা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০১০)।
সম্পাদিত গ্রন্থ : বাংলাদেশের ছড়া (১৯৮৭), বাংলাদেশের কবিতা (১৯৮৭), কবিতা এ্যালবাম (১৯৮৮), শুধুই রবীন্দ্রনাথ (২০১০), আবদুল মান্নান সৈয়দের নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০১১) ইত্যাদি।
ভ্রমণ কাহিনি : হেমিংওয়ের দেশে (২০১৪);
পুরস্কার : কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার, ২০১১, সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার, ২০১২।
==================
লেখালেখির মূল্যায়নটা পাঠকের হাতেই দেয়া উচিত: ওমর কায়সার
"আমার
ব্যক্তিগত
কোনও
শত্রু নেই।
তবে
আমার
দেশের,
আমার
পৃথিবীর,
আমার
ভাষার,
আমার
সংস্কৃতির,
আমার
ঐতিহ্যের
শত্রু আছে।"
সাতদিন: নিজের লেখালেখিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন
করেন?
ওমর কায়সারঃ লেখার সময় মনে হয় আমি পৃথিবীর সেরা
একটা কিছু লিখছি। লেখা শেষ হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ বা কিছুদিন পর যখন সে লেখাটা নিয়ে
উত্তেজনা থাকে না, মোহটা কেটে যায় তখন সেই লেখার কড়া সমালোচক বনে যাই আমি। মাঝে মাঝে এ’ও মনে হয়, আমারই দুর্বলতার
কারণে বহু বিষয়কে আমি বিনষ্ট করেছি। ঠিক যেভাবে ফুটিয়ে তোলার কথা ছিল সেভাবে
পারিনি।
তবে নিজের লেখালেখির মূল্যায়ন করা লেখকের পক্ষে
খুবই কঠিন। মূল্যায়নের ভারটা শেষ পর্যন্ত পাঠকের হাতেই দেওয়া উচিত।
সাতদিন: আপনার প্রথম লেখা এবং প্রথম বইয়ের
অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
ওমর কায়সারঃ আমার প্রথম লেখা ছাপা হয় দৈনিক
সংবাদ এর খেলাঘর পাতায়। সেটি ছিল চারলাইনের একটি ছড়া। সত্তর দশকের শেষ অথবা আশি
দশকের প্রথম দিকে। তারিখটা ঠিক মনে নেই।
আমার প্রথম বইটি কবিতার। প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ।
প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। অচিরা পাঠচক্র প্রকাশিত এই বইটি ছাপা হয়েছিল ঢাকায়। আমার
বন্ধু শ্যামল দত্ত (ভোরের কাগজের সম্পাদক) সেই বইয়ের দায়িত্ব নিয়েছিল। আমি শুধু তাঁকে
কতগুলো কবিতা দিয়েছি। এরপর কবিতাগুলোকে একটি বইয়ের ভেতর সাজানোর যাবতীয় কাজ
করেছি। শ্যামল। খুব পরিশ্রম হয়েছিল তার। এখনকার মতো বই করার জন্য তখন এতটা সহজ
প্রযুক্তি ছিল না। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিল উত্তম সেন। ভেতরে শিল্পী শিশির
ভট্টাচার্যের একটি ড্রইং ছিল।
এই বইটি সেসময় খুব আলোচিত হয়। সেই সময়ে অনেক
পত্রিকায় এই বইয়ের ওপর দীর্ঘ আলোচনা প্রকাশিত হয়। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ
পত্রিকায় কবি দেবাঞ্জলী মুখোপাধ্যায় এই বইয়ের ওপর আলোচনা লিখেছিলেন। মনে পড়ে
চট্টগ্রামের মুসলিম হলে পাবলিক লাইব্রেরি বইটি নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন
করেছিল।
সাতদিন: বাংলা সাহিত্যের কোন শাখা তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি
মনে করেন?
ওমর কায়সারঃ এরকম তুলনামূলক বিচারের কথা আমার
মাথায় কখনো আসেনি। বাংলা গদ্যের তুলনায় বাংলা কবিতার বয়স ঢের বেশি। পরে আবির্ভূত
হয়ে গদ্যের বিস্তৃতি ও পরিধি পদ্যকে ছাড়িয়ে গেছে কি না ভাবতে হবে। তবে একটা
ব্যাপার আমাকে ভাবায়। গদ্য এবং পদ্য দুটোই সমানতালে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁকে
বিশ্বকবি বলতেই আমরা ভালোবাসি। কাজী নজরুল ইসলামের বেলাও তাই। মৃতু্যর পরে কবি
জীবনানন্দ দাশের অনেক গদ্য আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু তাতে তার কবি উপাধিটা ম্লান হয়নি।
এসবে অবশ্য সাহিত্যের কোনো শাখার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় না। বিভিন্ন মাধ্যমে
বাংলা গদ্য বিকশিত হয়েছে∏ উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ সহ গদ্যের পরিধি দিন দিন
বিস্তৃত হচ্ছে। শুধু গদ্য পদ্য নয়, বাংলা সাহিত্যের আরও শাখা আছে। সেখানে
নাটক একটা বড় জায়গা দখল করে আছে। বাংলা গানেরতো একটা সমৃদ্ধ জগত আছেই।
রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল যার বিশাল ভিত্তি করে দিয়েছেন। সাহিত্যের প্রতিটি শাখার এক
একরকম আবেদন। এগুলোর মধ্যে তুলনামূলক বিচার না করাই ভালো।
সাতদিনঃ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য
জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে?
ওমর কায়সারঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ
সাহিত্যের অন্তরায় হতে পারে না। বিজ্ঞানের অগ্রগতি সাহিত্যকে বরং সমৃদ্ধ করবে।
যুগে যুগে আমরা সময়ের প্রতিফলন দেখেছি সাহিত্যে। সুতারাং মানুষ যদি বিজ্ঞানমনস্ক
হয় তারও প্রতিফলন ঘটবে সাহিত্যে।
সাতদিন: আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন
কি?
ওমর কায়সারঃ আমার প্রিয় লেখক রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর। তার লেখা গীতবিতান আমি প্রায় প্রতিদিন পড়ি। ‘আমার সকল কান্না গান হয়ে ভাসে/
শ্রাবণের জলে ভেজা রাবীন্দ্রিক বাতাসে বাতাসে’।
সাতদিন : আপনার নিজের প্রিয় লেখা কোনটি এবং
কেনো।
ওমর কায়সারঃ আমার লেখালেখির সংখ্যা খুব কম।
ওখানে বিশেষ কোনো লেখা আমার বিশেষভাবে প্রিয় নয়।
সাতদিন: আপনার লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা কি?
ওমর কায়সারঃ খুব ছোটবেলা থেকে বন্ধুবান্ধবদের
প্রেরণা লেখালেখি করেছি। একন নিজের তাগিদেই লেখালেখি করি।
সাতদিনঃ শর্ত সাপেক্ষে লেখালেখি ছেড়ে দিতে বললে
কি ছাড়তেই পারবেন?
ওমর কায়সারঃ কোনো শর্তেই এই প্রস্তাবে রাজী
হবো না।
সাতদিন: একজন লেখকের ভেতরের ‘মানুষসত্তা' কে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
ওমর কায়সারঃ একজন লেখক তো প্রথমত মানুষই।
সুতরাং লেখকের কাছ থেকে তার মানুষসত্তা তো আলাদা করা যায় না। তাই মানুষের
স্বাভাবিক যে প্রকৃতি তার তার মধ্যেও পাওয়া যাবে। তার ভেতরে নানা দোষ থাকবে, গুণ থাকবে। ক্ষুধা, লোভ, ক্রোধ, ঘৃনা, ভালোবাসা, হিংসা তার মধ্যেও থাকে। তিনি কখনো
পিতা বা মাতা, কখনো
পুত্র বা কন্যা ইত্যাকার মানবিক সম্পর্কগুলো তিনি বজায় রাখেন। তবে সবচেয়ে বড় কথা যিনি লেখক তিনি একজন সৃজনশীল
মানুষ।
সাতদিন: মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
ওমর কায়সারঃ মৃত্যু সকল জীবের স্বাভাবিক
প্রক্রিয়া। এই অনিবার্য নিয়তিকে আমরা কেউ ঠেকাতে পারবো না। লেখকের মতো সৃজনশীল
মানুষেরা তাদের কীর্তির মধ্যে বেঁচে থাকেন।
সাতদিন: লেখালেখি ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয়
এবং অপ্রিয়।
ওমর কায়সারঃ আমি পেশায় সাংবাদিক। আমার চাকরির
বাইরে লেখালেখি ছাড়া অন্যকিছু আমার করা হয়ে ওঠে না। তার পরও গান শুনি, বই পড়ি প্রতিদিন। মাঝে মাঝে সিনেমা
দেখি।
সাতদিন: সাহিত্যের বাইরে আরও একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শত্রুকে কীভাবে
মূল্যায়ন করেন?
ওমর কায়সারঃ আমার ব্যক্তিগত কোনও শত্রু নেই।
তবে আমার দেশের, আমার
পৃথিবীর, আমার
ভাষার, আমার
সংস্কৃতির, আমার
ঐতিহ্যের অনেক শত্রু আছে। তাদের সম্পর্কে আমাদের অনেক সচেতন হতে হবে। #
..............................
কৈশোরে প্রেমে
পড়েছিলাম একটি মেয়ের...
সেই প্রেমই ছিল আমার
মূল প্রেরণাঃ আলতাফ হোসেন
--------------------------
ভাষা কত বদলে গেছে, বদলে যাচ্ছে
আমি শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিই
আমার শত্রু কি কেউ আছেন?
-------------------
সাতদিনঃ নিজের লেখাকে
আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
আলতাফ হোসেন: মূল্যায়ন? হ্যাঁ, বলা যায় বইকি। নিজের লেখাটা লেখা হয়ে গেলে, বারবার পড়ি, বারবার পড়ি, আর ভাবি
কতটা নিজের লেখা হল, অস্বচ্ছ যা, দুঃস্বপ্নের,তা-ও এল কি না। বা, আর কী কী এল, লুকিয়ে ছিল, দেখতে
আমি পাইনি। আবারও
এসে, ফিরে এসে পড়ার মতো কি না।
সাতদিনঃ আপনার প্রথম লেখা এবং প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা জানতে
চাই।
আলতাফ হোসেন: অনেক জায়গায় বলেছি, সেসব কথাই আবারও বলতে হয়,
কোথাও নিশ্চয় সেভাবেই তৈরি আছে, কিন্তু এখন খুঁজতে
গেলে সময় লেগে যাবে, তা ছাড়া বলা কথা আবার বললে ভাল লাগবে না। প্রথম লেখার অভিজ্ঞতা অন্য অনেকের
মতো। উত্তেজনা। বিস্ময়। খুশি। কয়েক রাত নির্ঘুম কাটানো। কোথায় ছাপানো যায় তা নিয়ে ছটফটানি। প্রথম বই প্রকাশের আনন্দ ছিল
অনেক বেশি। অনার্স
শেষ হয়েছে। ফার্স্ট, ইন অর্ডার অব মেরিট। স্কলারশিপের
বেশ অনেক টাকা হাতে, বই প্রকাশ করা কোনও ব্যাপার নয়। প্রকাশক হিসাবে এগিয়ে এলেন চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু জাফর। প্রচ্ছদ এঁকে দিলেন বিখ্যাত শিল্পী
দেবদাস চক্রবর্তী। ক্যালিগ্রাফি, অঙ্গসজ্জায় হাত দিলেন বন্ধু শিল্পী অমিত চন্দ।
আহা, সেইসব দিন! নিজে দিন-রাত প্রেসে
বসে থেকেও নিখুঁত ও সুদৃশ্য বই বার করা সম্ভব হয়নি।কিন্তু নজর কেড়েছিল সে বইটির কবিতা। শামসুর রাহমান যখন তাঁর এক সাহিত্য-বিষয়ক লেখায় সে বইটির প্রশংসা করলেন,তখন আমাকে চিনতেন
না।কবি দাউদ হায়দার তখন খ্যাতিমান
কবি, চিনতেন না আমাকে, বেতার-সাক্ষাৎকারে
প্রিয় কবি হিসেবে আমার নাম বললেন। কবি
হাবীবুল্লাহ সিরাজী লিখলেন রিভিউ দৈনিক বাংলা-র সাহিত্য-পাতায়, ‘নদী নদী বইছে নিরবধি’।
‘কণ্ঠস্বর’ ও আরও কিছু কাগজেও বইটি নিয়ে আলোচনা ছাপা হয়েছিল,
মনে পড়ে। এখন
এসব কথা লিখতে লজ্জা করছে না বটে, কিন্তু আমার স্বভাব এমনই
অদ্ভূত যে, যত আমার বিষয়ে বলা, লেখা হয়েছে
ততই আমি শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছি।
বহুকাল
ধরে সযতনে,সচেতনপ্রয়াসে চলেছে এ দূরত্ব রচনা। এভাবে আমার মিশন আজ অনেকটা সফল
হয়েছে। নিজেকে আড়াল-করা যতটা
সম্ভব, সম্পন্ন হয়েছে।
বোধ
হয় যে,
ফেসবুক আসার পর আমার উল্টোযাত্রা, আমার নিলাজ হওয়া
শুরু...
সাতদিনঃ বাংলা সাহিত্যের
কোন শাখা তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন?
আলতাফ হোসেন: কবিতা অনেক সমৃদ্ধ। অনেক
এগিয়ে। প্রবন্ধও লেখা হচ্ছে কত। ভাষা কত বদলে গেছে। বদলে যাচ্ছে।
নতুন
বেশবাস, পরীক্ষানিরীক্ষা, নতুন চিন্তা নিয়ে গল্পও লেখা হচ্ছে
প্রচুর বাংলা ভাষায়।
সাতদিনঃ জীবন এবং প্রযুক্তির
যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে?
আলতাফ হোসেন: প্রযুক্তি রাখছে সবকিছুতে ছাপ, জীবনে রাখছে, আর সাহিত্য তো জীবনকে ঘিরেই। ভাল কথা, এইসব কথা হচ্ছে সামাজিক না হতে পারাকে ভয় পাই বলে,তা
না হলে, জীবন বলতে কী, সাহিত্য বলতেই কি
তা তো জানি না, সত্যিই জানি না...
সাতদিনঃ আপনার প্রিয় লেখক
সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
আলতাফ হোসেন: অনেকের লেখা পড়তে ইচ্ছা হয়।
ভাল
লাগে। প্রিয় লেখক তো আছেন একজন।
Eugene Ionesco. তাঁর ভাবনা ও আমার ভাবনা হাতে হাতে ধরি ধরি। তাঁর কথা কত জায়গায় যে বলেছি। বেঁচে থাকলে যে আরও বলব কত! এখানে তুলে দিচ্ছি তাঁর লেখা থেকে। স্মৃতি ও মহাবিশ্ব নিয়ে কয়েক
লাইন
:
Memory
The light of memory, or
rather the light that memory lends to things, is the palest light of all. I am
not quite sure whether I am dreaming or remembering, whether I have lived my
life or dreamed it. Just as dreams do, memory makes me profoundly aware of the
unreality, the evanescence of the world, a fleeting image in the moving water.
Universe
The universe seems to me
infinitely strange and foreign. At such a moment I gaze upon it with a mixture
of anguish and euphoria; separate from the universe, as though placed at a
certain distance outside it; I look and I see pictures, creatures that move in
a kind of timeless time and spaceless space, emitting sounds that are a kind of
language I no longer understand or ever register.
সাতদিনঃ আপনার নিজের প্রিয়
লেখা কোনটি এবং কেন?
আলতাফ হোসেন: নিজের লেখা থেকে নিজের প্রিয়? বলা খুব কঠিন। যেমন আজ হয়তো মনে হল, এটা, কাল মনে হবে, ওটা। পরশু হয়তো, হায়, কোনোটাই নয়।
আবার
আজ যেটা প্রিয় কাল হয়তো প্রিয় মনে হবে না।
তবে
ওপরের লেখকটির অনেক লেখা প্রিয় ছিল ধরা যাক ৩০ বছর আগে।
মন
এখনও তেমনই রয়ে গেছে।
সাতদিনঃ আপনার লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা কী এবং কেন?
আলতাফ হোসেন: যখন শুরু করেছিলাম তখন, সেই কৈশোরেই, প্রেমে পড়েছিলাম একটি মেয়ের, সে তখন ষষ্ঠ শ্রেণী,
আমি অষ্টম। চিঠি
পাঠাত একটি বালকের মাধ্যমে, চিঠিতে প্রায়ই থাকত কবিতার লাইন।প্র থম দিককার একটি চিঠিতে ছিল, ‘তোমার কাছে লিখিলাম আমি প্রথম প্রণয়লেখা/এইখানে হোক সান্ত্বনা
মোর, হোক বা না হোক দেখা।’
এই প্রেমই, অতএব, ছিল আমার
মূল প্রেরণা। পরে এসেছে আরও প্রণোদনা। পরে আরও। কেন যে!
সাতদিনঃ শর্তসাপেক্ষে
লেখা ছেড়ে দিতে বললে কি ছাড়তে পারবেন?
আলতাফ হোসেন: কোনও কারণেই লেখা ছেড়ে দিতে পারব না বলেই মনে হয়, যদি-
না লেখা নিজে আমাকে ছেড়ে যায়।
সাতদিনঃ একজন লেখকের
ভেতরের
‘মানুষসত্তা’কে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
আলতাফ হোসেন: ধারণা তো করি, মানুষসত্তা বা মানবতা সব লেখকের মধ্যে
থাকে, তা ছাড়া লেখক হওয়া সম্ভব নয়, তবে
কোনও-কোনও আর্টিস্ট, যেমন পিকাসোকে,
আমরা নিষ্ঠুর হতে দেখেছি, আরও অনেকের মধ্যেও তেমন
প্রবণতার কথা শুনেছি, অতএব, লেখকদের মধ্যেও
তেমন থেকে যাওয়া কী আর তেমন অসম্ভব! আমার নিজের মনটা খুউব নরম
বলেই আমি ভাবি।
সাতদিনঃ মৃত্যুকে আপনি
কোন্
দৃষ্টিতে দেখেন?
আলতাফ হোসেন: ভাল দৃষ্টিতে। একদিন
চিনে নেব তারে। আমি সদাই প্রস্তুত।
কাছের
জনরা তেমন চাইবে না বলেই যা একটু ভাবনা।
সাতদিনঃ লেখালেখি ছাড়া
আর কী আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয়?
আলতাফ হোসেন: প্রিয়: সবার আগে গান। সুরের
গান, শাস্ত্রীয় বিশেষত। বই
পড়া। বেড়ানো।
ক্রিকেট।
সততা।
অপ্রিয়: মানুষের বোধহীনতা, অন্ধ বিশ্বাস।
অসাধুতা।
হিংস্রতা।
সাতদিনঃ সাহিত্যের বাইরে
আরো একটা প্রশ্ন, আপনার বন্ধু ও শত্রুকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
আলতাফ হোসেন: আমার শত্রু কি কেউ আছেন? বলতে পারব না। শত্রুতাকে ঘৃণা করি। বন্ধু হতে চাই। বন্ধু চাই।
……………….
আমি আমার নিজের গল্পটা বলতে চেয়েছি: চিনুয়া আচেবে
ভাষান্তরঃ অজিত দাশ

জেফরি ব্রাউনঃ একটা
দীর্ঘ সময় ধরে আফ্রিকানরা তাদের নিজের ইতিহাস বলতে পারেনি। ইউরোপিয়ানরা নিজেদের মত
করে আফ্রিকার ইতিহাস লিখেছিলো। ১৯৫০ সাল থেকেই বলা যেতে পারে, যখন আফ্রিকা স্বাধীণতা পেল তখন
থেকেই আফ্রিকানরা প্রথম তাদের নিজেদের গল্প বলা শুরু করেছিলো। 'থিংস ফল অ্যাপার্ বইটির কথাই বলা যেতে পারে- ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিলো
যা বিশ্বসাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নিয়েছে। এটা ছিলো নাইজেরিয়ার
একটি ছোট গ্রামের গল্প যেখানে ইউরোপিয়ান মিশনারিরা ইগবো আদিবাসিদের তাদের ধর্মপ্রচারের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলো।
প্রায় ৫০ বছর আগে আসলে কি ভেবেছিলেন?
আচেবেঃ আমার মনে
হয়েছিলো সত্যি আমার কিছু একটা করা দরকার।
জ়ে.বি: শুধু মাত্র
কিছু একটা করার কথাই ভেবেছিলেন?
আচেবেঃ হ্যাঁ।
জ়ে. বিঃ আসলে তখন কি
করেছিলেন?
আচেবেঃ আমি আসলে আমার
নিজের গল্পটা বলতে চেয়েছি। আমার জন্মভূমি, আমার নিজের মানুষের গল্প বলতে চেয়েছি। আমি গল্প বলার জন্য অনেক লোকের
কাছেই তখন পরিচিত ছিলাম।
জ়ে.বিঃ তা অবশ্য
আপনি ইংরেজি সাহিত্য পড়াশোনা করেছিলেন বলেই।
আচেবেঃ ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা ছিলো বলেই অনেক লোককে সন্মোহিত করতে পেরেছিলাম। এবং একটা নির্দিষ্ট জায়গায়
আমি আমার নিজের অনুপুস্থিতির কথা টের পেলাম। সাজানো বইয়ের তাক থেকে একটা বই
সরিয়ে নিলে যেমন ফাকা জায়গা তৈরি হয় আমি ও ঠিক সেরকম একটা ফাকা জায়গার
উপস্থিতিআমার ভিতরে অনুভব করেছিলাম।
জে.বিঃ আর এ কারনেই
আপনি থিংস ফল এপ্যার্ট লিখতে উদ্যত
হয়েছিলেন।
আচেবেঃ হ্যাঁ।
জ়ে.বি: তখন আপনি
আসলে কেন আগ্রহী হয়েছিলেন?
আচেবেঃ তখন আমিও একটি
পরিবর্তন চেয়েছিলাম। একটি ভিন্ন সংস্কৃতির আগ্রাসনে ইগবোদের মধ্যে দ্বন্দ বাড়ছিলো, এবং ভিন্ন কিছু হতে চলছিলো।
জ়ে.বি: ইউরোপিয়ানরা আসার আগে আপনি গ্রামের কোনো আদর্শ চিত্র তুলে ধরেননি। উপন্যাসের প্রধাণ
চরিত্র ওকোনকো চিন্তাশীল কিন্তু হিংসাত্মক। কেন?
আচেবেঃ আমি
ইচ্ছাকৃতভাবেই তা করেছি। তখন তরুন ছিলাম। আমি চেয়েছি সত্যি গল্পটা বলার জন্য।
যেভাবে একটা গল্প সত্য হয়ে উঠবে ঠিক সেইভাবে।
জ়ে. বিঃ একটু স্পষ্ট
করে বলুন?
আচেবেঃ খুব গভীরভাবেই
গল্পটি বলার চেষ্টা করেছি- যেভাবে তুমিও বাস্তব ঘটনা প্রত্যক্ষ করে একটি গল্প তৈরি
করতে চাও ঠিক সেভাবেই। সেখানে তোমার একটা নিজস্ব ভঙ্গি থাকবে। তোমার ভিতরে গল্পটির
চিত্র ভাসতে থাকবে। এটা সত্য, এটা মিথ্যা। এবং আমি তা
পরিহার করতে চেয়েছি। আমি গল্পটিকে একটি উত্তম মাত্রা দিতে চেয়েছি। যা আমার কাছে
খুব গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো।
আচেবেঃ হ্যাঁ।
জ়ে.বিঃ আমি খুব
আনন্দ পেয়েছি এটা জেনে যে আপনার বাবা-মা খ্রীস্টান ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছিলো। এবং
তখন থেকেই মিশনারিরা সারাদেশ ভ্রমণ করতে শুরু করে।
আচেবেঃ আমি বিষয়টিক
প্রশ্নবিদ্ধ করিনি । আমি বিদেশীদের ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি বটে। আমি ভেবেছিলাম
খ্রীস্টানধর্ম আমাদের জন্য ভালই হবে। কিন্তু কিছু সময় পর বুঝতে পারলাম এই ধর্ম
সম্পর্কে আমি যা ধারণা করেছি তা আসলে পুরোপুরি ঠিক ছিলোনা । ইগবো ধর্মকে বোঝার
কোনো প্রচেষ্টাই আমার মধ্যে তখন ছিলো না।
জে.বিঃ আমার মনে হয়
এটা জিজ্ঞেস করা খুব হাস্যকর হবে, আসলে আপনি কি করে জানলেন
'থিংস ফল অ্যাপার্ট' বইটি অনেক
জনপ্রিয়তা পেয়েছে?
আচেবেঃ না আমি সত্যি
জানতে পারিনি তা কতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আমি ধারণা করতে পারি- বিদেশী কিছু পাঠক
আমাকে জানিয়েছে, তারা বইটি পড়ে এমন কিছু পেয়েছে যা তাদের
নিজেদের ইতিহাসে সাথে একেবারে মিলে যায়। একটা উদাহরণ হলো, কোরিয়ার
একটি মহিলা কলেজ থেকে আমাকে অনেক চিঠি পাঠিয়েছিলো। তারা সবাই আমাকে লিখেছে,
'এ ইতিহাস আমাদের ইতিহাস'…
জে.বিঃ কোরিয়ানরাও?
আচেবেঃ হ্যাঁ
কোরিয়ানরা যখন জাপানের উপনিবেশ ছিলো তখন একই রকম ঘটেছিলো তাদের সাথে। আসলে বইটিতে
মানব ইতিহাসে এক চিরন্তন রূপ ছিলো যা অন্য জাতির মধ্যেও প্রভাব ফেলবে। অন্য
জাতিকেও আঘাত দিবে।
জে.বিঃ আফ্রিকার সব
গল্পই ইউরোপিয়ানরা তাদের মত করে বলেছে। তাদের সুবিধা মত করে লিখেছে।
আচেবেঃ হ্যাঁ তাই।
তারা শুধু আফ্রিকার গল্পই বলে গেছে। গভীর ভাবে সেখানেকার সত্যকে তুলে ধরতে চায়নি।
এর একটা কারণ, তাদের দাস বানিজ্য টিকিয়ে রাখা।
জে.বিঃ বর্তমানে
সমস্যাটা কোথায়? আপনি কি আফ্রিকার বর্তমান অবস্থানিয়ে
সন্তুষ্ট?
আচেবেঃ আসলে এটা একটা
প্রস্তুই ছিলো। এটা আরও সময় নিবে। 'থিংস ফল
অ্যাপার্ট' পড়ে সত্যি যদি কেউ তাদের নিজেদের গল্প বলতে চায়,
আফ্রিকার গল্প বলতে চায়, ইগবোদের গল্প বলতে
চায় তাহলে সত্যি সেটা আমার কাছে অনেক আনন্দের মনে হবে।

আচেবেঃ আমাদের
ইতিহাসে এমন কোনো সময় ছিলোনা যা পুরোপুরি নিখুঁত ছিলো। আমি এরকম সময়ের
প্রত্যাশাওকরি না। কিন্তু আমার মনে হয়
প্রতিটি প্রজন্মকেই একটা পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যাওয়া উচিত। আসলে কি করা দরকার। । তাদের অবস্থানের
উপর ভিত্তি করে একটি পরিবর্তনের দিকে আগানো উচিত। এবং এটা সত্যি যে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম একই
রকম হবেনা । ফ্রান্সিস ফাণো বলেছেন- পরিস্থিতি যাই ঘটুক না কেন, প্রতিটি প্রজন্মকে তার নিজের লক্ষ্য খোজে নিয়ে সে অনুযায়ী আগানো
উচিত। এটা এমন কিছু নয় যে তুমি দেওয়ালে
লিখে লোকজনকেক জানালে তা করা উচিত। প্রতিটি
প্রজন্মকেই আবিষ্কার করে নিতে হবে কি করা প্রয়োজন।
এহলিং: আপনি আসলে কবে থেকে লেখা-লেখি শুরু করেছিলেন?
আচেবেঃ আমি আসলে
অনেকবার এই প্রশ্নের সন্মুখিন হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পর থেকেই গুরুত্বসহকারে
লেখালেখি শুরু করি। আমি কখনো লেখালেখিকে আমার পেশা হিসেবে বেছে নিবো এটা কল্পনাও
করিনি। তবে আমি লেখালেখি দিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করেছি। আমার পড়াশোনার
পাশাপাশি কিছু একটা করা দরকার ছিলো, আমি তাই
করেছি। এটা সহজাত ভাবেই আমার মধ্যে জন্ম নিয়েছিলো। আমার মনে হয় তুমি যতই বেড়ে উঠতে
থাকবে, তোমার চারপাশকে নিয়ে প্রশ্নের সন্মুখীন হবে আর আর
সেগুলোর উত্তর খোজার চেষ্টা করবে। তুমি সত্যি খুব ধাঁধার মধ্যে পড়ে যাবে। কেন এটা
ঘটছে, কেনই বা অন্যটা ঘটছেনা। এই প্রশ্নের উত্তর গুলো তুমি লেখালেখির মধ্যে
দিয়ে খুজতে চেষ্টা করবে। আমি জানিনা ঠিক কবে থেকে, তবে এটা
আমার মনে হত যে একটি গল্প মানুষের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি বলতে পারবনা কেন?
তবে এটা সত্যি যে একটি গল্পের মধ্যে তুমি তোমার নিজেকে আবিষ্কার
করবে। যেখানে একটি সংস্কৃতি নির্ণয় করে আসলে মূল জিনিসটা কি। আমি যখন মেডিকেলে
পড়ার জন্য কলেজে যাই, এবং একবছর পর সেখান থেকে যখন পালিয়ে
গিয়েছিলাম কেননা আমি এরকম জীবন এর আগে কখনো দেখিনি। কিরকম গুরুত্বপূর্ণ জীবন এবং
আমি সেখানে যা কিছু করছিলাম তার সবি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আসলে তখনি আমি লেখালেখি
শুরু করি।
এহলিং : গল্প
বলতে আপনি কি চিরাচরিত গল্পের কথা বলছেন?
আচেবেঃ হ্যাঁ।
এহলিং: এটা কি
শিল্পের জন্য শিল্প নয়...
আচেবেঃ যতদূর পর্যন্ত একজন মানুষ তা গ্রহণ করতে সক্ষম
হবে। আসলে আমি নীতিমূলক অর্থে বলছি। গল্পকার তাদের শ্রোতাদের শিক্ষা দিবে। তাদের
সংস্কৃতি নিয়ে, জাতিকে নিয় দেশের জনগনকে নিয়ে, ভাল আর মন্দের কথা বলবে।
এহলিং: আপনি কি বলতে
পারেন,
আপনার লেখায় আপনি সেই নীতিমূলক শিক্ষাটা দিতে পেরেছেন?
আচেবেঃ না, আমার ধারণা নীতিমূলক শব্দটিকে মাঝে মাঝে খারাপ অর্থেও ব্যবহার করা হয়। আমি
সাধারণত এটা বলতে চাই, শিল্প আমাদের জন্যই, পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট মানে তৈরি করতে এর প্রয়োজন। এবং আমি বলবো প্রতিটি
গল্পই শেষমেশ আমাদের ভাল কিছু একটা দেয়। একারনেই আমি বলতে চাই একজন উপন্যাসিক একজন
শিক্ষকও বটে। একারনেই আমি প্রতিনিয়ত নীতির সাথে থাকার চেষ্টা করি। এই শিক্ষকের
মানে এই নয় যে কেউ একজন খড়িমাটি নিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে সামনে দাঁড়িয়ে একজন শিশুকে একে
শিখাবে। আমি এরকম শিক্ষকের কথা বলিনি। আমি
এর চেয়ে কম অধিগম্য কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছি। আমি প্রকৃতপক্ষে এটা দেখতে চাইনা
অন্য মাধ্যোমের চেয়ে শিল্প-সাহিত্য আমাদের কতটা উন্নত করতে চেষ্টা করে, আমি দেখতে চাই শিল্প কিভাবে আমাদের
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তুলে ধরতে চায়।
আচেবেঃ আমার মনে
হয়েছে তা খুব গুরত্বপূর্ণ। বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে গিয়ে আমার অনেক নতুন অভিজ্ঞতা
হয়েছিলো যা আমাদের শিশুদের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে একরকম ধারণা দিবে। আমরা আসলে
আমাদের শিশুদের গল্প বলতে চাইনা। আমাদের বাবা মা তা করেছিলো। আমাদের দাদারা তা
করেছিলো। যখন থেকে গল্প লেখা শুরু হলো, আমরা সত্যি
আমাদের শিশুদের কথা ভুলে গিয়েছি। আমাদের গল্প বলার যে দায়িত্বতার কথা ভুলে গিয়েছি।
ময়ার্সঃ তাহলে কি
ঘটবে?
কি পরিবর্তন আসবে?
আচেবেঃ যা ঘটবে তা
ঘটাবে কতগুলো বাজে গল্প। আবর্জনা। এগুলো বিষের মত। আমরা বাজারে গিয়ে কতগুলো রঙ্গিন
ছবিওয়ালা বই নিয়ে আসি যার ভিতরে কোনো গল্প নেই। আমরা অনেক কম বয়সী,আমাদের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি যা আমাদের বাচ্চাদের ব লতে পারবো। আমরা
কখনো শিশুদের গল্প গুলো পড়ে দেখিনা। তখন হঠাত করেই আমরা আমাদের বাচ্চাদের অদ্ভুদ
ধারণার কথা লক্ষ্য করি।
এহলিং: থিংস ফল
অ্যাপার্টবইটি কিভাবে প্রথমপ্রকাশ করেছিলেন?
আচেবেঃ আসলে অনেক
সুখের ঘটনা ঘটেছিলো তখন। বিবিসিতে আমি প্রথম আমার পান্ডুলিপি পাঠিয়েছিলাম। সেখানে
গিলবার্ট ফেল্পস নামের এক ভদ্রলোক ছিলেন, তার কিছু
উপন্যাস বের হয়েছিলো। আমি প্রথম তাকে আমার পান্ডুলিপি দেখাই। আমি আমার এক বন্ধুর
অনুপ্রেরণায় তাকে পান্ডুলিপিটি পাঠাই। শেষে তিনি পান্ডুলিপিটি পছন্দ করেছিলেন। তবে
অতটা স্পষ্ট করে ছাপানোর কথা কিছু বলেননি। অবশেষে তিনি সম্পাদককে রাজি করে ছাপাতে
রাজি হয়েছিলেন।
এহলিং: বইটি প্রকাশের
পর নাইজেরিয়ায় কেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিলো?
আচেবেঃ আসলে
খুব ধীরেই নাইজেরিয়ানদের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছিলো। কেননা সেটা প্রকাশিত হয়েছিলো
লন্ডনে। শুরুতে বইটি অতটা জনপ্রিয়তা না পেলেও ধীরে ধীরে অনেকেই বইটি পড়তে শুরু
করে। যতদিন পর্যন্ত না তার মলাটওয়ালা সংকলন বের হয়েছিলো।
এহলিং: আপনার বইটি এখনো অনেক উপরের তালিকায় আছে। যে
কেহ আফ্রিকার ইতিহাস জানতে চাইলে তারা এই বইটি পড়ার চেষ্টা করে। আপনি কি এতে
সন্তুষ্ট?
আপনার কি মনে হয় এর চেয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো বই ভবিষ্যতে হতে পারে?
আচেবেঃ এটা গর্বের
বিষয় যে এটা আমার বই। তবে আমি এটা বলতে পারবোনা আর কোন বই এরকম আসবে কি না। কিছু
কিছু স্কটিশ পন্ডিতরা বলেছেন, থিংস ফল এপার্টের মত বই
গত বিশশতকে প্রকাশিত হয়নি।===========
আমি ব্যর্থতা থেকে লিখি,
লেখালেখি ছেড়ে দিলে রক্তহীন
হয়ে পড়বঃ সাখাওয়াত টিপু
লেখা জিনিসটা উড়ন্ত পাখির মত
আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে করতে নিঃশেষ করতে
চাই
==================================
সাতদিনঃ নিজের লেখাকে
আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
সাখাওয়াত টিপু: লেখার
আগে লেখা নিয়ে ভাবি। মানুষ কি ভয়াবহ একা? না না,
নানা ভাব আর বস্তুর ভেতর বাস করে। তবে একাই তো লেখা লাগে। ধারণা
আসে। চিন্তা আসে। আর প্রশ্ন আকারে ভর করে। তবে উত্তর কি লেখা? মানে ধারণা হতে চিন্তা, চিন্তা হতে প্রশ্ন, প্রশ্ন হতে পথ। লেখার পর ভাবি, লেখক ব্যক্তির মৃত্যু
ঘটেছে। লেখক সেখানে একক হিসেবে থাকেন না। তার স্বভাব, ভাব আর
অভাব সমাজে বা পাঠকের ভেতর জারি আছে। লেখক সেখানে একা নন। পাঠক কি আজব! মাঝে মাঝে
মনে হয়, লেখা জিনিসটা উড়ন্ত পাখির মত। নানা ডালে, নানা বৃক্ষে উড়ে উড়ে বসে।
সাতদিনঃ আপনার প্রথম
লেখা এবং প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
সাখাওয়াত টিপু: আমার প্রথম
লেখা হাই স্কুলে পাঠের সময়। পাঠক আমার আব্বা। প্রথমে উৎসাহ দিতেন। ওনার মুখে নানা
নানা কবির কবিতা শুনেছি। পরে কবি জীবন দেখে ভাবছিলেন, ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে! ছোটবেলায় আমার বাবু (মুক্তিযোদ্ধা সফি উল্লাহ
বি.এ.) গ্রে সাহেবের ‘এনাটমি’ কিনে
রেখেছিলেন। বাবু ৮৩ সালে গত হন। ওনার জীবন নানা ধরনের বই পাঠের ভেতর কেটে গেছে। বই
আর ওনার জীবন সমার্থক। ওনার অনেক বই ছিল। ওনার প্রভাব মনে হয় আজও বয়ে বেড়াচ্ছি।
আমার ভেতরের জ্ঞানের বীজ উনিই তো রোপন করেছিলেন। উনি একবার বলেছিলেন, বিত্তবেসাতের দরকার কি! আনন্দ থাকলে মানুষ বটগাছের ছায়ার নিচে একটা জীবন
কাটিয়ে দিতে পারে। ওনার কথা শুনে মনে হয়েছিল, বটগাছের নিচে
সন্ন্যাস ব্রত করাই মানুষের জীবন। সে কি অদ্ভুত ধারণা!
নিছক আবেগের বশে আমি
কবিতার বই করিনি। বই করার আগে শ শ কবিতা লিখেছি। ছাপা হয়েছে অসংখ্য পত্র-পত্রিকা
আর ছোটকাগজে। এই সব কবিতা কখনো বই আকারে প্রকাশ পাবে কি না জানি না। আসলে বই
জিনিসটা কবরে পুতে রাখা মানুষের দেহ। কখন যে ঘাস হয়ে জন্মায়, আর কখন যে ডালিমের ফল হয়ে পাকে, সেটা বোঝা মুশকিল।
আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এলা হি বরষা’।
এটা প্রকাশের অর্থের যোগানদাতা আমার বন্ধুবান্ধব। বইটার ভাষা, বিষয়, নন্দনতত্ব আর আঙ্গিকের কারণে খানিক বিতর্কের
জন্ম দিয়েছিল। যাক সেই কথা। তো, এখন বাজারে বইটির দ্বিতীয়
মুদ্রণ চলছে।
সাতদিনঃ বাংলা
সাহত্যিরে কোন শাখা তুলনামুলক ভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করনে?
সাখাওয়াত টিপু: ঐতিহাসিক কাল
হতে বাংলা সাহিত্যের গোড়া পদ, পদ্য আর পদাবলী। এরপর
কবিতা বা কাব্য বলি আমরা। সবই একই পাঠাতনের বাক্যবিদ্যা। গদ্য সাহিত্য পরে শাখা
গজিয়েছে। গল্প বা উপন্যাস যত না বিকাশ হয়েছে, কিন্তু প্রবন্ধ
সাহিত্যের বিকাশ তেমন হয়নি। মানে বাংলা সমালোচনা সাহিত্য নাই বললেই চলে!
সাতদিনঃ জীবন এবং
প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে?
সাখাওয়াত টিপু: বিজ্ঞান
আর প্রযুক্তি দুটোই পরস্পর সম্পর্কিত। বিজ্ঞান মানুষকে যুক্তি আর প্রমাণের দিকে
নিয়ে যায়। প্রযুক্তি ভোগের দিকে নিয়ে যায়। সাহিত্য আমার কাছে ভাব বা ভাষা। তবে
বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞানের ধারণা সাহিত্য হতে আসতে পারে। কেননা সাহিত্যের কল্পনা তো
বিজ্ঞানের প্রাথমিক ধারণা। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির যুগে ভাষা বিজ্ঞানের আম্মা তো
সাহিত্যই। একটা বলা।
সাতদিনঃ আপনার প্রিয়
লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
সাখাওয়াত টিপু: প্রিয় লেখকের
নাম ‘মনজু আরা বেগম’। উনি সাহিত্য লেখেন নাই। তবে উনার
হাতের লেখা খুব সুন্দর। মাঝে মাঝে উনি চিঠি লিখতেন। উপরে লেখা থাকত ‘এলাহি ভরসা’।
উনি আমার আম্মা। আম্মা খানিকটা দার্শনিক গোছের মানুষ। নানা বিষয়ে এমন এমন
প্রশ্ন তুলতেন, আমরা হা হয়ে যেতাম। উনি খানিকটা যুক্তির উপর
ভর দিয়ে কথা বলতেন।
সাতদিনঃ আপনার নিজের
প্রিয় লেখা কোনটি এবং কেন?
সাখাওয়াত টিপু: বলা কঠিন। আমার
নিজের প্রিয় কোন লেখা নাই। প্রিয় লেখা থাকাটা মনে হয় লেখকের জন্য ক্ষতিকর। সবই
প্রিয় আবার সবই অপ্রিয়। আসলেই না আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে করতে নিঃশেষ করতে চাই।
তবে শেষ কোথায় কে জানে?
সাতদিনঃ আপনার
লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা কী এবং কেন?
সাখাওয়াত টিপু:আসলে আমি
ব্যর্থতা থেকে লিখি। মানে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় আমি চরম একজন ব্যর্থ মানুষ। স্কুলে
বাংলা বইয়ের প্রশ্নের উত্তরে নিজের মত ব্যাখ্যা দিতাম বলে শিক্ষক আমাকে পাশ মার্ক
দিতেন না। কিন্তু বাংলা ব্যাকরণ পরীক্ষায় বাংলা দুই পত্রের মার্ক উঠতো। আমাদের
বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন। নাম শামসুল আলম। ভাল গান গাইতেন। প্রমিত
উচ্চারণে কথা বলতেন। অন্যদেরকে বলতে বাধ্য করতেন। তিনি একবার ভাষায় গুরু-চণ্ডালি
দোষের জন্য বেধড়ক বেত্রাঘাত করেছিলেন। তারপর থেকে আমি ভাষা জিনিসটা বুঝি। আসলে
আমার মূল প্রেরণা ভাষার গুরু-চণ্ডালি দোষ। মানুষের মুখের ভাষা বাদ দিয়ে নতুন
সাহিত্য জিনিসটা হয় না।
সাতদিনঃ শর্তসাপেক্ষে
লেখা ছেড়ে দিতে বললে কি ছাড়তে পারবেন?
সাখাওয়াত টিপু: না।
আমি না রক্তহীন হয়ে পড়ব। সৃষ্টির তাড়না ভয়াবহ। এটা হল ওষুধ উত্তীর্ণ রোগ। মানে
শর্তহীন রোগ। এই রোগের নিরাময় শর্ত দিয়ে হয় না।
সাতদিনঃ একজন লেখকের
ভেতরের ‘মানুষসত্তা’কে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
সাখাওয়াত টিপু:মানুষসত্ত্বা
হচ্ছে মানুষের ধারণা। মানুষ মানুষ হয়ে জন্মায়, পশুর বাচ্চা
হয়ে না। জন্মগতভাবে মানুষ আর পশুর ভেতর ভেদ নাই। তবে ভেদটা হচ্ছে আচরণে। ‘পাশবিক হলে মানুষও পশু তুল্য হয়’ এই ধারণা
আধুনিকদের। আমার তো মনে হয় প্রকৃতির কাছে সবই সমান। মনুষ্য প্রজাতিতে লেখক আলাদা
কোন প্রাণী নয়। মানুষের দেখাও তো এক ধরনের লেখা। পশুও তাই। দেখার ভেদ নাই।
সাতদিনঃ. মৃত্যুকে
আপনি কোন্ দৃষ্টিতে দেখেন?
সাখাওয়াত টিপু: কথাটা রূপকথার
মত। মৃত্যু জিনিসটা পাতা ঝরার মত। খুব ছোটকালে এক দাদী একটা গল্প শুনিয়েছিলেন।
গল্পটা এমন, চাঁদে একটা বিশাল বৃক্ষ আছে। ওই গাছের
পাতা আর দুনিয়ার মানুষের সংখ্যা সমান। ওই গাছে একটা নতুন পাতা গজালে দুনিয়ায় একজন
মানুষের জন্ম হয়। আর একটা পাকা পাতা ঝরে পড়লে একজন মানুষের মৃত্যু হয়। দাদীর সেই
গল্প নিছক গল্পই। তবে মৃত্যু নিয়ে তার যে তুলনা জ্ঞান সেটাই তো সত্য। মানে জন্ম মাত্র মৃত্যুকে আহবান করে।
সাতদিনঃ লেখালেখি
ছাড়া আর কী আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয়?
সাখাওয়াত টিপু: একা একা বসে
থাকা। সাথেও না পাছেও না। একা চিন্তা করা। অপ্রিয় জিনিসটা চিন্তা করতে অবসর না
পাওয়া।
সাতদিনঃ সাহিত্যের
বাইরে আরো একটা প্রশ্ন: আপনার বন্ধু ও শত্রুকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
সাখাওয়াত টিপু: শব্দ দু’টি
আদতে সম্পর্ক উৎপাদন আর রাজনৈতিক। ফলে এটি সাহিত্যের মধ্যে পড়ে। জ্ঞানদেবের
জ্ঞানেশ্বরী বইটা পড়েছিলাম কবে! নিবৃত্তিনাথ বলেছেন, ‘অতি
ভক্তিরসের রাশ টেনে ধরা লাগে মাঝে মাঝে।’ রাশ টানা বন্ধুর
বটে। আর রাশ ছাড়া অভক্তির পর্যায়! দুই রাশই ভক্তিরস। অভক্তিও তো এক ধরনের ভক্তি
থেকে আসে। কেননা ভক্তির বিভক্তি মানে অভক্তি। ইহজাগতিক এই সম্পর্ককে আমরা বন্ধু আর
শত্রু বলে বিবেচনা করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন