পুনঃপ্রকাশ


বীরঙ্গনাদের নিয়ে মার্কিন কবি তার্ফিয়া ফৈজুল্লাহর কাব্যগ্রন্থ SEAM
মোস্তফা তোফায়েল

তার্ফিয়া ফৈজুল্লাহ্ মার্কিন কবি। তাঁর পূর্ব-পুরুষরা বাংলাদেশের মানুষ, যাঁরা মার্কিন মুলুকে প্রবাসী হয়েছেন ১৯৭৮-এ। তার্ফিয়া ফৈজুল্লাহর জন্ম সেখানে ১৯৮০ তে। সে-হিসেবে এখন এ-প্রবাসী কবির বয়স ৩৪। তিনি ক্রাব অর্চার্ড সিরিজের পোয়েট্রি ফাস্ট বুক অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন Seam নামের কবিতাসংকলনের জন্য। এই সিম-এ ১০ পৃষ্ঠার একটি ধারাবাহিক কবিতা আছে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর গণধর্ষণ বিষয়ে। অমীমাংসিত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বলা হয়ে থাকে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালি ধর্ষিতার সংখ্যা দুলক্ষ থেকে চার লক্ষের মাঝামাঝি। কবিতায় পরিসংখ্যানগত সঠিকতা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় না, এখানে মুখ্য উপাদান মানবতার বিপর্যয় এবং ক্ষরণ ও দহনের উপলব্ধিকে সভ্যতার সমকালীন চেতনায় ধরিয়ে দেয়ার শৈল্পিক উপস্থাপনা। তার্ফিয়া ফৈজুল্লাহর কবিতায় এটাই প্রত্যাশিত। তিনি তাই করেছেন।

সিমইংরেজি শব্দ। Seam অর্থ জোড়ালাগানোর জন্য সেলাইকর্ম। কারিগরি জীবনকর্মের প্রতীকে কবি তার্ফিয়া ফৈজুল্লাহ তাঁর সিম কবিতাগুচ্ছে যৌন অপরাধ ঘটেছে বা ঘটেনি; স্মৃতিতে আছে বা বিস্মরণে ঢেকে গেছে; ধর্মীয় মূল্যবোধ লংঘিত হয়েছে বা হয়নি অথচ দোষারোপ করা হচ্ছে-এমনতর সূক্ষ্ম অনুভবসমূহের প্রান্তিকতাকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেছেন। একটা মেটাফোরের ব্যবহারও করেছেন ফৈজুল্লাহ্, অনুভব-উপলব্ধির জায়গাটির ক্ষীণ অস্তিত্ব পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরতে; গদ্য উপক্রমণিকার শেষের দিকে তিনি বলেন, কবরস্থানে একটির ওপর আর একটি কংকাল উপস্থাপিত, যেন “Pressed like flowers in a book, thinning over time under the weight of new bodies”, “বইয়ের পাতার ফাঁকে ফুলের পাপড়ি লম্বা সময়ের ব্যবধানের যেমন শীর্ণ হয়ে যায়, কবরের পুরনো কংকালগুলোও তেমনই নবতর কংকালদের চাপে শীর্ণকায় হয়ে গেছে।বস্তুগত অস্তিত্বের পাশাপাশি মানসলোকের স্মৃতিও হয়ে গেছে বিস্মৃতির বিশীর্ণতায় জীর্ণ; যা ছিল একদা জ্বলন্ত অনল, সময়ের ব্যবধানে সে অনুভব এখন জীর্ণ কিংবা প্রায়-লুপ্ত একটি জিরজিরে ও দুরাগত উপলব্ধি। কেউ কেউ হয়তো বলবেন দুরাগত এবং আরোপিত। ফৈজুল্লাহ্ চান সেই দগ্দগে দহনের সাথে এখনকার জিরজিরে স্মরণের মেইলবন্ধন ঘটাতে। এর সাথে অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে তার কবিতাভাষ্যে আসে ঘাতক-ধর্ষকদের অপরাধ সংঘঠন অথবা তা হয়নি বলার দোটানা; ধর্মীয় মূল্যবোধ লংঘিত হয়েছিল বা ধর্ম রক্ষার্থেই ধর্ষণে লিপ্ত হয়েছিল তারা-এমন সব দ্বৈত To be or not to be! ফৈজুল্লাহ্ যখন বইয়ের পাতার ফাঁকে রেখে দেওয়া ফুলের পাপড়ির উৎপ্রেক্ষায় বিষয়টিকে কবর খুঁড়ে হৃদয়ে নিয়ে আসেন, তখন ফুল ফুটে ওঠে সুন্দর ও পবিত্র অবয়বে, বইয়ের পাতার চাপ ধর্মরক্ষার দোহাইয়ের মতো!Book of life এবং Book of Injustice মুদ্রিত হয় জীবনখাতার একই পাতায়; মানব সভ্যতার চরণযুগল এগিয়ে চলে জীবন কংকাল মাড়িয়ে মাড়িয়ে। ধর্ষণ বিষয়ক লোকলজ্জাজনক অপ্রীতিকর বিষয় নিয়ে বাংলার কবিকুল খুব কমই লিখেছেন, কেউবা লিখেছেন দুএক পৃষ্ঠা প্রতীকী ভাষায় (সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল…….. কপাল পুড়লো….); কিন্তু ফৈজুল্লাহ্ তা বলেছেন নিজের দাদীর মুক্তিযুদ্ধ অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে, তার কথা স্মরণ করে, যদিও সে-দাদী স্বয়ং কোনো ধর্ষণ অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়েনি। দাদীর প্রসঙ্গ উঠিয়ে কবি ফৈজুল্লাহ্ বরং সৎ-সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, যা আমাদের দেশের লোকলজ্জাভয়ে ভীত অনেক কবির পক্ষেই সম্ভব হয়নি।
বিদেশী নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের মতে, অন্তত দু/তিন লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন। কিন্তু আসল সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে হয়। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ষণের কথা পরিবার গোপন করেছে, বিশেষ করে ভদ্রলোকেরা। কোনো কোনো স্বামী আবার স্ত্রীকে ধর্ষণের জন্যে এগিয়ে দিয়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। কোনো কোনো সামরিক কর্মকর্তা আবার নির্দিষ্ট রক্ষিতা রেখেছিলেন। এই রক্ষিতারা একটু ভালো অবস্থায় ছিলেন।
কোনো ইতিহাসসুলভ বৃত্তান্ত ফৈজুল্লাহ্র নিরীখে ছিল না; তিনি বীরাঙ্গনা ক্যাম্পে গিয়েছিলেন ধর্ষণ-ইতিহাসের তথ্য-পরিসংখ্যান সংগ্রহের জন্য নয়। বরং তার কবিতায় পাই নারীভূষণ লাজরক্তের যে-বিভীষিকাময় পদপিষ্টতা এবং সভ্যতাবিধ্বংসী পাষণ্ডতা ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ খন্ডে, তারই একটি সূক্ষ্ম এনাটমি এবং ক্লিনিক্যাল প্যাথোলজি। যে-নারীরা বীভৎস ধর্ষণ-কবলে পতিত হয়েছিলেন, তাদের লজ্জাসম্পদ হয়েছিল ভূলুন্ঠিত; ঢাকার রাজপথে এবং মুক্তিযুদ্ধ খন্ডের বাংলাদেশের সব জেলায় উপজেলায় এই মানবিক সম্পদ দস্যুরা লুট করে নিয়েছিল। ফৈজুল্লাহ্ প্রতিতুলনার কাব্যশৈলীতে উপস্থাপন করেন মুক্তি যুদ্ধ-উত্তর ঢাকা সফর কালে রাজপথে তাঁর নিজের সম্ভ্রম হারানোর আশংকা ও দুশ্চিন্তার কথা!
Reach for anyone
Willing to wrap his good arm tight
Around me for as long as the ribboned
darkness allows.
অন্ধকারের রেশমিফিতা যতক্ষণ ঝুলে থাকবে
এবং সুযোগ তৈরি করে রাখবে,
সঙ্গীদেরই কেউ হয়তো পেতে চাইবে আমাকে
তার সুঠাম পেলব বাহুর বাঁধনে চাপ দিতে চাইবে
border=0এই আশংকা ও লাজরক্তভূষণ একান্তই নারীসুলভ, যা ফৈজুল্লাহ্ জানেন ও মানেন, কিন্তু বীরাঙ্গনা বাঙালি নারীরা মুক্তিযুদ্ধকালে তা হারিয়ে ফেলেছিল! তারা হয়েছিল বিবস্ত্র ও লজ্জাহীনা; সে-মুহূর্তে মানবসভ্যতাও হয়েছিল বিবস্ত্র ও নির্লজ্জ।
লুটেরা ধর্ষকদের সেই লজ্জাহীনতা মানবজাতির সভ্যতামুখী অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিয়েছিল! ফৈজুল্লাহর কবিতার যৌন আবেদনময় অংশটুকু সে-কারণেই নয় বিলাসী কবিতাচর্চা। বরং তা দেখিয়ে দেওয়া সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ অনুভব ও উপলব্ধিকে, ক্লিনিক্যাল সীমারেখা এঁকে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। আধুনিক কবিতার দুই প্রতিভূ কর্তা পাউন্ড ও ইলিয়ট ক্লিনিক্যাল বস্ত-দৃশ্য বর্ণনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। তাদের এই বর্ণনা-কৌশলের পরবর্তী নামকরণ হয় অব্জেক্টিভ কোরিলেটিভ।
Reading Celan at the liberation War Museum নামক কবিতাটি প্রভু যীশুর প্রতি প্রার্থনাসঙ্গীতের ভঙ্গীতে একটি ব্যঙ্গ কবিতা। এতে আমাদের হাতের কাছের চেনাজানা, প্রায় ছুঁয়ে-দেখা গৃহস্থালি দ্রব্যসামগ্রীর বিবরণ আছে, যথা: স্বচ্ছ কাগজে মোড়ানো বিস্কিট; কাঁচের বোতল, কাপ-পিরিচ ইত্যাদি; কিন্তু এদেরই পাশাপাশি বর্ণিত হয়েছে যুদ্ধে নিহতদের হাড়ের টুকরা, নিতম্বের পাঁজর, করোটি, চোয়ালের হাড় এবং যুদ্ধঘোষণার খবর সম্বলিত পত্রিকার কাটিংসবকিছু জাদুঘরের গ্যালারিতে সাজানো। প্রভু যীশুকে লর্ড সম্বোধন করে বলা হয়েছে প্রার্থনার সামগ্রীরূপে এগুলোকেও যেন গ্রহণ করা হয়!
একটা মূল্যবান খোঁড়া যুক্তি আছে: মুক্তিযুদ্ধকালের ধর্ষণের বর্ণনা দিলে জাতির কলংক ছড়ানো হবে! ফৈজুল্লাহ্ সে খোঁড়া যুক্তিতে কান দেননি। প্রকৃতপক্ষে এই খোঁড়াযুক্তিদাতারা ধর্ষক-ঘাতক পক্ষের লোক। ধর্ষণ তো একটি অবলম্বন মাত্র, একটি উপাদান। মূল বিষয় সভ্যতানিধন, সভ্যতার অগ্রগতির পথে কুঠারাঘাত। ফৈজুল্লাহ্ এই কুঠারাঘাতকেই তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে।
(৬ আগস্ট ২০১৪ সালে The slate lake book review পত্রিকায় প্রকাশিত জোনাথন ফার্মার-এর আলোচনা অবলম্বনে)
*কৃতজ্ঞতাঃ আর্টস, বিডি নিউজ ২৪ থেকে।


==================
তোলাবাক্সেই থাক ছিঁড়ে যাওয়া পুথির মালাটা
জিনাত জাহান খান

প্রিয় পুথির মালাটা যেদিন চোখের সামনে ছিঁড়ে যেতে দেখলাম, হতবাক আর কষ্ট মিলেমিশে চোখকে প্রায় ঝাপসা করে দিয়েছিলো তারপর ধৈর্যহারা না হয়ে পুথিগুলো কুড়িয়ে এনে একটা একটা করে গেঁথে ফেললাম ছিঁড়ে যাওয়া থেকে মালাটা গেঁথে ফেলার সময়টুকু কি কখনো কোন কবিতা হয়ে উঠতে পারে? কবিতাতো বাস করে শব্দের বুকে, শব্দ নিয়েই খেলা আমি মালা গাঁথিআমি কবিতা লিখি এইসব বাক্য যখন ভাঙি আর গড়ি তখন সমস্ত দায় যেন এই আমিটার আমি’– আত্মা বা সত্তা, অহমিকা, আমিত্ব ব্যাকরণগতভাবে উত্তম পুরুষ আমি’ – অহম ছাড়াও হয়ত আরও কিছু আছে যাইহোকআমি’ – আমিত্ব,আমার চিন্তা এবং তা আমারই  অস্তিত্ব, তাহলেআমিঅর্থ সেখানে মৃত কেউ নয় প্রথাগত চিন্তার খোসা ছিঁড়েআমিআমাকে নিয়ে গেলাম চিন্তানদীর কাঁধেবোধের মাঝে প্রবাহিত সকল অতীত থেকে আগামী পর্যন্ত.. .সব উৎসব এবং আনন্দময় মুহূর্তকে এক একটা সাজানো ফুল ভেবেই উদ্যান সাজাতে ব্যস্ত না হয়ে, একটু মনোযোগী কোন তস্করের ধারালো চিন্তাকে ধার করে এতটুকু ভাবতে পারি যে, জন্মহীন কি কোন মৃত্যু কল্পনা সম্ভব? তাছাড়া মৃত্যু শব্দটা আমার অপছন্দের, যেন দুঃখ প্রকাশের প্রচার মিডিয়ার একমাত্র শ্রুতিমধুর শব্দ আমিঅর্থাৎ আমার অহমকে এখানেই কাজে লাগাতে চাই যে, অপছন্দের মাঝে অনুপস্থিত থাকাটাকে মানুষ হিসাবে বুদ্ধিবৃত্তির অংশিদার ভাবনা ছাড়া আর কিছুই না কারণ - এড়াবার কি কোন উপায় আজো আবিষ্কৃত হয়েছে?  ‘আমি’ - যতই অহমিকা সম্পন্ন শব্দ হোক না কেন, জীবনে আসা আর যাওয়া কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট কোন বুমেরাং নয়...‘সকল খেলায় করব খেলা এই আমি’ – রবিঠাকুরআমিনিয়ে কতই না ভালো বলেছেন সকল খেলাকেআমিএকা একাই যাব মলে, তবেই না জয় জয়কার হবে আমার আমিত্ব আমার সত্তা যখন ঘুমে যাবে, স্বপ্ন আসবে, দেখবে, ছিপ ফেলে কেউ ধরছে নিজেই নিজের ছায়াকে কিংবা অশান্ত আঙুলগুলো হাঁটছে উদ্দীপ্ত করতে কোন মৃত শরীরেতখন সেখানে সম্পূর্ণআমিউপস্থিত থাকে কতটুকু?     
    
 একটা মালায় কি সবসময় একই রঙের পুথি থাকে? না নাতা কেন? কত কত রং বেরঙের রঙিন মালা হয় শুধুআমিনিয়েই তো চিন্তা, চেতনা বা কাব্য হয় না, ’তুমিকে নিয়েও ভাববার আছে তুমি’ – ব্যাকরণগতভাবে মধ্যম পুরুষ, সম্বোধিত ব্যাক্তিসূচক সর্বনাম যা সাধারণত স্নেহপাত্র, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, বন্ধু পিতা-মাতা সৃষ্টিকর্তার প্রতি উচ্চারিত হয়ে থাকে ত্বমতুমহে ইত্যাদি তোমাকে আমি যখনতুমিকরে ভাবছিসমস্ত স্থিরতা পল্লবিত হয়ে ওঠে তুমি যখনতুমিহও মাথার উপর এক ক্রোশ রোদ না পুড়িয়েই অনেকটা মৌল করে তোলে খলবলিয়ে ওঠা জল অবুঝ হয়ে মিশে যেতে চায় আদিজলের সমুদ্রে সভ্যতার চরম উৎকর্ষে নতুন অভিষেকতুমিএক আশ্চর্য প্রদীপ যা তৈরী করছে রক্ত-মাংসের কেবল এই  ‘আমিকে...তবে  ‘আমি’  যতটাই অহমিকারতুমিততটাই স্নেহপরায়ণ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেরবুকের মাঝে টনটনে ব্যথা ঝুঁকে গিয়ে দেখা না গেলেও,ব্যথায় ব্যথিত হয়ে হয়ত অনুভবটাই করা সম্ভব

 জন্ম-মৃত্যু এবং যাপিত জীবনের ভেতরে বেঁচে থাকার সময়ে, পাতাঝরা আনন্দে নেচে ওঠে যখন এইতুমিআরআমিমিলেমিশেআমাদেরশব্দবাড়ি পৌঁছায় এবং অদ্ভুত ক্রীড়ানুভূতি জন্ম দেয় দ্যুতিময় আলোতে আমাদের”– ব্যকরণে সর্বনাম, আমিসহ এক বা একাধিক ব্যক্তির মিলিত প্রকাশ মাত্র আমিআরতুমিহলে সারাদিন তবেআমাদেরহবে সন্ধ্যাটা দিনশেষে সন্ধ্যার নিয়ন আলোতে আলোকিত হয়ে এমন কোন সংজ্ঞা উপস্থাপন করবেচারিপাশ খুব মায়া ছড়াবে চায়ের কাপ আর চামচের নাচানাচি, প্রেমিক প্রেমিকার বন্ধ আয়েশি চোখ নিজেদের ডুবিয়ে দেবে কোন সূর্যের তেজদীপ্ত শোষিত আমেজে –  গিটার আর হেরে গলা হবে গানের এক মেলবন্ধন তবেই জমে গিয়েআমি’ – ‘তুমিএক হয়েআমাদেরহব... 
জোড়া দেয়া পুথির মালাটা সিদ্ধান্ত নিলাম আর গলায় পড়ব না, খুব যত্ন করে গুঁজে রাখব তোলাবাক্সে কেননা বিশেষ থেকে সার্বিকীকরণ যাত্রা পথ এই মালাটাই তো দেখিয়ে দিল... 

.. 
=========
তসলিমা নাসরিনের পর্ণোগ্রাফি

ইন্টারনেটে ভালো মন্দ নানা কিছু পাওয়া যায়। সত্য অসত্য, ধর্ম অধর্ম সব। বিস্তর সেক্সও। তথ্য খেতে পারো, মিউজিক খেতে পারো, সেক্স খাবে না কেন? খাবে না মানে? সেক্সের মতো সুস্বাদু খাদ্য আর কী আছে? সেক্স খাওয়ানোর এবং খাওয়ার লোকের অভাব নেই জালের জগতে। কিন্তু সেদিন তো আমি হাঁ হয়ে বসে রইলাম, ভারতের অবাঙালি ছেলেরা তো বটেই, বাঙালি ছেলেরাও বউএর সঙ্গে নিজেদের হার্ডকোর যৌনতার ভিডিও জালের জগতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। পাঠিয়ে দিচ্ছে মানে বিক্রি করছে। সেসব ভিডিও দেখলে যে কোনও অন্ধও বুঝতে পারবে যে বউ কি জানে না ভিডিও কী কারণে করা হয়েছে। বউ যদি জানতে চায়, শান্ত-সুবোধ-চমশা পরা ভালো ছাত্র-ভালো চাকুরে-বর বলে, ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য। ব্যক্তিগত সংগ্রহটি যে দুদিন পর আপামরজনতার সংগ্রহের বস্তু হয়ে উঠেছে, তা বর জানলেও বউটি জানে না। বরের নির্দেশ সে লক্ষ্মী বউএর মতো পালন করছে। কারণ, বর বলে কথা। শাস্ত্রে আছে, ভগবানের আদেশও অমান্য করে সত্যমিথ্যে বলে পার পাওয়া যায়, কিন্তু বরের আদেশ না মানলে নির্ঘাত নরক। লজ্জা একটু একটু করে দূর করতেই হয় বউকে, বর ছাড়া ঘরে তো আর কেউ নেই। কিন্তু বউ-বেচারা লক্ষ্য করে, বরের ব্যবহার আজ মোটেও স্বাভাবিক নয়। বর তার নিজের বড় ছোট সব অঙ্গকেই চর্বচোর্ষলেহ্যপেয় হিসেবে বিবেচনা করতে বউকে আদেশ দিয়ে দিয়েছে। ক্যামেরাকে এমনভাবে বসিয়েছে যেন বিছানায় শুয়ে থাকা বউএর অলিগলিতস্যগলি অবধি দেখা যায়। এরপর বউটির শরীর অাঁচড়ে কামড়ে যেমন ইচ্ছে ভোগ করে বর। চৌষট্টি কলার শিল্প জগতসুদ্ধ বিখ্যাত হলেও বেশির ভাগ বাঙালি এক কলাতেই তৃপ্ত। যৌনশিল্পে পারদর্শীদের ভিডিওর কাতারে এখন এই শিল্পে অল্পবিদ্যে অল্পজ্ঞান সম্বলিত প্রায় অনভিজ্ঞ বাঙালির ভিডিও রীতিমত এঙ্ােটিক। লজ্জা, দ্বিধা, সংকোচ মিঙ্ড। খাবে না মানে লোকে? উপুড় হয়ে পড়ছে।

আমার প্রশ্ন, ওই পতিব্রতা মেয়েরা কি কোনওদিন টের পাবে তাদের পতিদেবতারা কী ভয়ংকর অন্যায় কাজ করছে! শুধু বউদের ক্রীতদাসী বানিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছে না, যৌনদাসী বানিয়েও শান্ত হচ্ছে না, পর্নোগ্রাফির ব্যবসা করছে তলে তলে? বিকৃত রুচির কথা বাদই দিলাম, আইন বিরোধী এই অপরাধটি করে স্বামী নামক ক্রিমিনালগুলো কী করে পার পাচ্ছে! এই প্রশ্নটা পাড়ার লাট্টুও শুনলে বলবে যে বোকার মতো করেছি! পার তো পুরুষেরা চিরকালই পেয়ে যাচ্ছে, ক্রাইম করে পার না পাওয়ার যে ৪৯৮ রয়েছে, সেটাকেই এখন শুনি চোখ রাঙাচ্ছে, নির্দোষরা ফেঁসে যাচ্ছে বলে চারদিকে এখন সদলবলে 'মানি না, মানবো না' হুমকি। ৪৯৮ ছাড়া যত আইন আছে দেশে, ওসবে বুঝি নির্দোষদের ফাঁসানো হয় না? শুধু ৪৯৮এ (নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভারতীয় আইন) ফাঁসলেই এর বিরুদ্ধে খিস্তি করতে হবে! আসলে চুলচোখ মুখ বুকপেট তলপেট সর্বস্ব পণ্যের পক্ষে আইনের কড়াকড়ি দেখলে পুরুষদের বড় গা জ্বলে!

বাঙালির সেক্স ভিডিও দেখে আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো, যে মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তারা ইচ্ছে করলে কি পারে না লোরেনা ববিট হতে? লিন্ডা বোরম্যান হতে? আমেরিকার মেয়ে লিন্ডা বোরম্যানকে দিয়ে জোর করে তার স্বামী পর্নো ছবি করাতো। মেরে ধরে, মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে, কাপড় খোলাতো আর সেক্স করাতো, সেসবের ভিডিও বিক্রি করতো বাইরে। মৃত্যুভয়ে স্বামীর নির্দেশ মানতে বাধ্য হতো লিন্ডা। কিন্তু ভয় ডর বিদেয় করে একদিন সে রুখে দাঁড়ালো। আইনের দ্বারস্থ হলো, স্বামীকে ডিভোর্স দিল। পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে আন্দোলনে লিন্ডা বোরম্যান এখন বিখ্যাত এক নাম। আশির দশকে বোরম্যান-মামলা পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো রাষ্ট্রে পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে আইন পাস করিয়েছে। পর্নোগ্রাপিকে নিষিদ্ধ করার জন্য আইনের লড়াই চালিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাথরিন ম্যাককিনন। তিনি কিন্তু বলেননি পর্নোগ্রাফি অশ্লীল জিনিস, অসভ্য জিনিস, সুতরাং নিষিদ্ধ করো। তাঁর কথা, পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ করতে হবে, কারণ এতে মেয়েদের বিরুদ্ধে সেক্স ডিসক্রিমিনেশন বা লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতন শুধু নয়, মেয়েদের নাগরিক অধিকারও লঙ্ঘন হচ্ছে। প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর তিন আগে ক্যাথরিন ম্যাককিননের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো। পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই কেমন চলছে জানতে চাইলে বললেন, তাঁকে এখনও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে নারী বিরোধী পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ করার জন্য লড়তে হচ্ছে এবং এ লড়াই বড় কঠিন লড়াই। পণ্য নিয়ে পর্নো করার সুবিধেয় কেউ বাদ সাধলে, পর্নো ব্যবসায়ীরা সাফ সাফ বলে দিয়েছে, রক্ষে নেই। তাঁকেও তাঁর নিজের দেশে চলতে ফিরতে নিরাপত্তা রক্ষীর সাহায্য নিতে হয়।

লোরেনা ববিটকে মনে আছে? যে মেয়ে স্বামীর অত্যাচারে প্রতিদিন অতিষ্ঠ হতে হতে এক সময় প্রতিবাদ করেছিলো! তার প্রতিবাদের ধরনটা একটু ভিন্ন রকম। একরাতে ঘুমন্ত স্বামীর পুরুষাঙ্গ ধারালো ছুরিতে ঘচাং করে কেটে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল লোরেনা। এক হাতে তার ছুরি, আরেক হাতে কাটা পুরুষাঙ্গ, গাড়ি চালাতে অসুবিধে হচ্ছিলো বলে ওটাকে জানালার কাচ নামিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। কোনও এক গমক্ষেতে বা আলুক্ষেতে গিয়ে পড়লো সেই অঙ্গ। খানিক পরে লোরেনা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছিলো কী কাণ্ড সে করেছে। ঘটনা জানার পর তাড়াতাড়ি করে ক্ষেতে ছুঁড়ে ফেলা ওই অঙ্গ খুঁজে এনে বরফে ডুবিয়ে রেখে উরুসন্ধিতে জোড়া লাগিয়ে জন ববিটের পুরুষত্ব কায়ক্লেশে রক্ষা করেছিলো তার বন্ধুরা। লোরেনা ববিটের কোনও জেল ফাঁসি হয়নি। লোরেনকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গিয়ে আদালতে বলা হয়েছিলো, 'লোরেনার মনে হতো, স্ত্রীকে গালি দেওয়ার, মারার, কাটার, যখন ইচ্ছে স্ত্রীর ওপর চড়াও হওয়ার সমস্ত শক্তি ওই ছোট্ট অঙ্গটি থেকে আসে। ওটি কেটে ফেলে দিলেই স্বামী মানুষ হবে।' এই মনে হওয়া যে অস্বাভাবিক নয়, তা লোরেনের জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করেছিলো। স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে লোরেন দিব্যি সুখে আছে এখন। নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে মার খাওয়া মেয়েদের উদ্ধার করছে। পুরুষাঙ্গ কর্তন করার উপদেশ জনসমক্ষে না দিলেও মেয়েদের কানে কানে দিচ্ছে কি না কে জানে।

পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে পশ্চিমের নারীবাদীরা সেই সত্তর দশক থেকেই আন্দোলন করছেন। পর্নোগ্রাফি নারীপাচার আর পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি অপরাধের পৃষ্ঠপোষক, এতে কারও দ্বিমত নেই। নারীবাদীরা মনে করেন, পর্নো ছবিতে যে যৌনতা সাধারণত দেখানো হয়, তা হল পুরুষেরা দাপট দেখাবে, মেয়েরা মেনে নেবে। অথবা পুরুষেরা মারবে, মেয়েরা মার খাবে। নারীবাদীদের ভাষায়, 'পর্নোগ্রাফির মানেই হচ্ছে, মেয়েরা মানুষ নয়, নিতান্তই যৌনবস্তু। এটি সবরকম শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণায় আনন্দ পাবে। ধর্ষণে আনন্দ পাবে। বেঁধে, মেরে, চাবকে, চড়িয়ে, উল্টিয়ে পাল্টিয়ে যা খুশি করা হবে, আনন্দ পাবে। যত তাদের মান, সম্মান, অধিকার আর স্বাধীনতাকে পায়ে মাড়ানো হবে, তত তারা আনন্দ পাবে। যত তারা নির্যাতিত হবে, আনন্দ পাবে।' পর্নোবিরোধী নারীবাদীরা কিন্তু যৌনতা বা ইরোটিসিজমের বিরুদ্ধে নন। এঁরা ভায়োলেন্সকে ইরোটিসাইজ করার বিরুদ্ধে।

হিউমিলিয়েশনকে, অসম্মানকে, অপমানকে, যন্ত্রণাকে ইরোটিসাইজ করার বিরুদ্ধে। পর্নোগ্রাফির পক্ষে নারীবিরোধী পুরুষ আর পর্নোব্যবসায়ীরা যোগ দিয়েছে সেক্স পজিটিভ নারীবাদীরা, নিন্দুকেরা তাদের নাম দিয়েছে 'ফিমেল শোভেনিস্ট পিগ।' এঁরা নারীর যৌন-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। যৌন-স্বাধীনতার নামে মেয়েদের সবচেয়ে নিকৃষ্ট যৌন-পরাধীনতা পতিতাবৃত্তির পক্ষেও এঁরা দাঁড়িয়েছেন। ক্যাথরিন ম্যাককিনন, আন্দ্রিয়া ডোরকিন, রবিন মরগান, ডরচেন লেইডহোল্টদের পর্নোবিরোধী আন্দোলনকে এঁরা যাচ্ছেতাই ভাষায় নিন্দা করেছেন। আশির দশকে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছিল দু দলে। বিতর্কের নাম লোকে শখ করে দিয়েছে, 'নারীবাদীদের যৌন যুদ্ধ।'

যুদ্ধে কারা জিতে যাচ্ছে, তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি। চারদিকে যৌনবিকৃতিরই জয়জয়কার। ইতালির ছেলে রকো সিফ্রেদি খুব নামকরা পর্নো অভিনেতা। এ পর্যন্ত তেরোশরও বেশি পর্নোয় অভিনয় করেছে। নিজেই সে বলে, ওসব তো সেক্স নয়, সে ফ ভায়োলেন্স। সেক্সে নামে মেয়েদের যত ভোগানো হয়, যত যন্ত্রণা দেওয়া হয়, তত জনপ্রিয় হয় পর্নো। তত জনপ্রিয় হয় অভিনেতা। যে মেয়ে মুখ বুজে যত ভায়োলেন্স মেনে নেবে, সে মেয়ের তত আদর। পর্নোছবির দর্শক মূলত পুরুষ। যা দেখতে পুরুষের আনন্দ হয়। তাই দেখানো হয়। পর্নোয় কখনও কোনও মেয়ের স্বাভাবিক যৌনাকাঙ্ক্ষার মূল্য দেওয়া হয় না। বিশেষ করে নারীপরুষের যে পর্নো। মেয়েদের যৌন সুখের জন্য বানানো হয় না পর্নো। মেয়েদের দাসীবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি, পর্নোবৃত্তি সবই পুরুষের ভোগের জন্য। মেয়েদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে এসব বৃত্তি তাদের নিরাপত্তার জন্য বা মঙ্গলের জন্য বা অর্থোপার্জনের জন্য। কিন্তু নিজের সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে, নিজেকে নির্যাতিত হতে দিয়ে নিজের গ্লানির বিনিময়ে যাই উপার্জিত হোক না কেন, কোনও অর্থেই তার নাম নিরাপত্তা নয়।কী করে রোধ করা যাবে পর্নোগ্রাফিসমাজের সঠিক চিত্রটাই তো রাখঢাক না করে দেখানো হয় ওসবে। সমাজে যদি পুরুষেরা ওপরে থাকে আর নারীরা তলায় থাকেপুরুষেরা মাতব্বরি করে আর নারীরা মাতব্বরি সয়পুরুষেরা কামড় দেয় আর নারীরা মুখ বুজে থাকেতবে পর্নো কেন ভিন্ন হবে। বিকৃতি যদি লোকের মনে এবং মাথায় গোপনে লুকিয়ে থাকেভদ্রতার মুখোশ আজ না হোক কাল খসে পড়েই। তবে বিকৃতি চিরস্থায়ী বলে আমি বিশ্বাস করি না।

সুস্থ-সুন্দর-সমাজ গড়ার মিছিলে নারী ও পুরুষ উভয়কে যোগ দিয়ে বিকৃতি বিলুপ্তির চেষ্টা বিরতিহীনভাবে করে যেতেই হবে। মন্দ আছে বলে ভালোকে তো হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না! মন্দে ছেয়ে যাবে তবে জগত। আইন প্রণয়ন করেমানবাধিকার বা সমানাধিকার সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষিত করে এ পর্যন্ত অনেক বৈষম্য আর বিকৃতি বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। মনে রাখতে হবেযতদিন না জাতবর্ণধর্মশ্রেণী নির্বিশেষে সকল নারীই মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সম্পূর্ণ অধিকার না পাচ্ছেযতদিন না নারী শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর হচ্ছে এবং যতদিন না নারীবিরোধী কুসংস্কারের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি হচ্ছেততদিন নারীর শরীর নিয়ে পুরুষের বিকৃত উৎসব চলতেই থাকবে। বাংলার মুখচোরা হীরেন বা তপনও রকো সিফ্রেদি হওয়ার স্বপ্ন দেখবে

* বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে

===========

আপনার বাবাকে আরামে মরতে দিয়েন


[এবং মা'কেও শান্তি দিয়েন]
রেজাউল করিম

১।
ডাক্তার বলছিলো ১৫ দিন; ১৩ দিন পর আব্বা মরেন। স্টোম্যাক ক্যান্সার হইছিলো আব্বার; প্রথমে বরিশাল, পরে ঢাকায় হসপিটালে ছিলো। রিপোর্ট নিয়া ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসতেই ভাইয়ার চেহারা দেইখা আব্বা বুঝতে পারছিলো মনে হয়। আব্বা জিগাইলো, কী অবস্থা? ভাইয়ার অস্বস্তি হচ্ছিলো নিশ্চই। পরে বললো, “ক্যান্সার। আনকিউরেবল অবস্থায় চইলা গেছে। ডাক্তার বলছে যে সিংগাপুর নিয়া দেখতে পারেন। কিন্তু কোন লাভ নাই; অলৌকিক কিছু না ঘটলে ১৫ দিনের মধ্যেই মারা যাবেন।ভাইয়া জিগাইলো, সিংগাপুর নিয়া যাবো নাকি ঢাকার হসপিটালে থাকবেন? আব্বা বললো, “আমারে বাড়ি নিয়া যা।
আব্বারে বাড়ি নিয়া যাওয়া হইলো। আমি মনে হয় পটুয়াখালী ছিলাম, জুবিলী স্কুলের হোস্টেলে। বাড়ি গেলাম। বহু লোক আসে আব্বারে দেখতে; তাঁর পুরানা কলিগরা, গ্রামের মানুষ, আত্মীয়রা। সবাই কিছু না কিছু নিয়া আসে; ফল, মিষ্টি ইত্যাদি। আব্বা খাইতে পারে না কিছুই। আমি খাই। একদিন আব্বা কাছে ডাকলো। শুইয়া আছেন, চামড়া আর হাড়ের মাঝে মাংস নাই কোন; চামড়া খুললেই ল্যাবরেটরির উপযোগী নগদ কংকাল পাওয়া যাবে একটা! ফ্যানের বাতাসে একটু শুকাইয়া নিতে হবে কেবল। আমার হাত ধরলো আব্বা; আমি বসলাম পাশে। বললো, ‘চিন্তা করিস না; আমি যা রাইখা গেছি তাতে তোরা মাস্টার্স পর্যন্ত ভালোভাবে পড়ালেখা করতে পারবি।
আব্বা সত্যই কইছিলেন। আমি পড়ালেখা না কইরা, পরীক্ষা না দিয়া দুই বছর খুয়াইয়া ফেলি; ফলে মাস্টার্স করছিলাম লোন কইরা। নাইলে পাশ করার পরেও এক বছরের টাকা থাকতো চাকরি খোঁজার জন্য। তো, আমার আসলে কোন চিন্তা হয় নাই কখনো! বরং আব্বা মরার পরে আমার হাতে টাকা-পয়সা বাড়ছিলো। ১৯৯৩ সালের ২১ অক্টোবর রাত সাড়ে তিনটার দিকে আমারে কেউ একজন ঘুম থেকে তুললো। আমি ঘুম চোখে লইয়া পিছে পিছে গেলাম; দেখলাম আমাদের ঘরের মাটির ফ্লোরে তোশকের উপর আব্বা শুইয়া আছে; তাঁরে ঘিরে সবাই বসা। আমারে সবাই মাথার কাছে পাঠাইয়া দিলো। দশ ভাই-বোনের মধ্যে সবচে ছোট আমি; বিশেষ অগ্রাধিকার। মরার সময় অবশ্য এক বোন কাছে ছিলো না। যাই হোক, পায়ের দিক থেকে উপরের দিকে আইতেছিলো মরা; সবাই চামচে কইরা মুখে পানি দিলো একটু করে। শেষে আমার কাছে আসলো পানি আর চামচ। আমি মুখে পানি দিলাম একটু। আমার মুখের দিকে চাইলেন আব্বা। আমার মুখ ছিলো তাঁর মাথা বরাবর; তাই চোখ উপরের দিকে উঠাইতে হইছিলো তাঁর, মানে কপালের দিকে। আব্বার মুখের ভিতর তাঁর জিভ নড়তে দেখলাম একটু, মনে হইলো আল্লা বললো। এবং ওইভাবে উপরের দিকে আমার মুখ বরাবর চোখ রাইখাই মরলেন আব্বা। আমি অবশ্য বুঝতেই পারি নাই। কেউ একজন চোখ বুজাইয়া দিলো তাঁর।

২.
কয়দিন আগে আমার এক বন্ধুর বাবা মারা গেলো। সেম। স্টোম্যাক ক্যান্সার। কেম টেমো দিছিলো; অনেক কষ্ট পাইছে। ফুলে গেছিলো। মরার কিছুদিন আগে আমি দেখে আসছিলাম। এই বন্ধুর বাবা, মা, চাচা, বোন, খালা, মামা, খালু, মামী, ভাগ্নিসবাই আমার পরিচিত। এরা সবাই আমার ওই ওই সম্পর্কের রোল প্লে করছিলো একবার। আক্ষরিক অর্থেই। ২০ বছরের বন্ধু আমার। ওর বাবারে খালু ডাকতাম।
তাঁর মরার সময়টার কাহিনী শুনে খুবই খারাপ লাগলো। মরার দিন হসপিটালে নিয়া গেছিলো। ভেইন খুঁজে পায় না; দুই হাতে দুই ঘন্টা বহুবার সুঁই ফুটাইছে ডাক্তাররা! আইসিইউতে নিয়া গেছিলো পরে। কী কী যেনো করবে। সিগনেচার নিয়া গেলো।
কাটাছেঁড়া করছে রাতের বেলা; কিছুই হয় নাই। অপারেশান ফেল করছে। মারা গেছে রাতেই। সকালে জানাইছে হসপিটাল থেকে! মরার আগে বাইরে থাকার সময় এরে খোঁজে, ওরে খোঁজে। কথা বলে, দেখতে চায়। ওভাবেই মরতে পারতো; কথা বলতে বলতে, দেখতে দেখতে সবাইরে। মরার সময় বুঝতে পারতো যে মরছে সে এখনি! মেয়ে, ছেলে, নাতি, বউ, ভাইদের মুখে ভালোবাসা দেখতে দেখতে মরতে পারতো হয়তো। কিন্তু হসপিটাল সিস্টেম তাঁরে নিজের মরার সময়টা জানতে দেয় নাই, আত্মীয়দেরো জানতে দেয় নাই, দেখতে দেয় নাই! হঠাৎ জানা গেলো যে সে মারা গেছে!এই সময়টা হসপিটালে না নেওয়াটা বিরাট ঘটনা; নিজেদের সন্দেহ হইতে পারে যে বুঝিবা আরো বাঁচতো! আত্মীয়রা ছেলে-মেয়ের নিন্দা করতে পারে যে টাকা বাঁচাবার জন্যই আসলে হসপিটালে নেয় নাই! তোদের টাকা লাগবে আমারে বলতি!
এই নিন্দাগুলি নিতে পারতে হয়; নিন্দা নিতে পারা একটা গুণ; ইভেন গ্রেটনেসও! আপনারে নিন্দা করতে না পারলে পাশের লোকগুলির সুখ হবে কেমনে? তাঁরা যে আপনার চাইতে বেটারএইটা ভাবতে দেবেন; তখন তো নিন্দা করবে মাত্র, কিন্তু আপনার যদি কোন দোষই দেখতে না পায় তাইলে সোজা ঘেন্না করবে! আমার পাশের লোকটা আমার চাইতে ভালোএর চাইতে আনকমফোর্টেবল আর কী আছে জগতে?

*Newsnextbd.comএর সৌজন্যে

=========
ছফা ভাইয়ের ক্ল্যাসিকেল রসিকতার স্মৃতি
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

আহমদ ছফাকে অনেক তরুণেরা পীর মনে করে তাঁর মুরিদ হয়ে থাকতেন। আমি কখনোই তা করি না। কারণ, আমি তাঁর অন্ধ ভক্ত নই। দীর্ঘ দিন খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি, জেনেছি, মিশেছি। এক সাথে প্রায় এক দশক সময় কাটিয়েছি। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তিন তলায় আমার অফিস ছিলো ৮৭ তিন তলায়, ছফা ভাইয়ের অফিস ছিলো দ্বিতীয় তলায় ৭১-এ।
আজ আজিজ মার্কেট আরেক গাউছিয়ায় পরিণত হয়েছে। তা নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম দৈনিক সমকালে। যার শিরোনাম ছিলো- বাহারের কাছে বিজুর পরাজয়? বিজু ছিলো বইয়ের দোকান পাঠক সমাবেশএর জনক আর টি-শার্টের বাহার নিত্য উপহারএর জনক।
এখন বই ঢাকা পড়েছে টি-শার্টের আড়ালে। কিন্তু এক সময় আমাদের আজিজ মার্কেট ছিলো সাংস্কৃতিক মার্কেট আর বইপাড়া বলে খ্যাত। কিন্তু সেই বইপাড়া এখন হুমকির সম্মুখীন। কলকাতার নন্দনের আদলে ছিলো আমাদের আজিজ মার্কেট- বইপত্র, লিটল ম্যাগ, চা-আড্ডা, কবিতা পাঠের আসর, নাটকের রিয়ার্সাল, সেমিনার, শর্টফিল্মের কোর্স, আবৃত্তির ক্লাশ, গানের আসর, বিজ্ঞান চেতনায় তাত্বিক আলোচনা, প্রকাশনা, পত্রিকার অফিস, লেখকদের পদচারণা, তরুণদের নানান কর্মকান্ডে জমজমাট থাকতো সারাবেলা, ভ্রাম্যমান নবীন-প্রবীণ সাংস্কৃতিককর্মীদের মিলনমেলায়।
সন্ধ্যা হলেই আরো জমে উঠে আজিজ মার্কেট, জেগে উঠে নতুন মাত্রায়। বই-এর দোকানে ঘুরে গেলেন মুহম্মদ হাবিবুর রহমান কিংবা হাসনাত আবদুল হাই, দোতলায় বসে প্রুফ দেখছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, নিচে নাটক লিখছেন মান্নান হীরা, প্রবাসী এক লেখকের সাথে দেখা করতে এসেছেন নির্মলেন্দু গুণ, সাথে অসীম সাহা, কোনো ঘরে অতিথি হয়ে লেপটপ নিয়ে কাজ করছেন মুহম্মদ নূরুল হুদা, পাবনার সুচিত্রা সেন সম্পর্কিত নতুন তথ্য নিয়ে এসেছেন অনুপম হায়াৎ, কলকাতার জয় গোস্বামী এসে তরুণ কবিদের আড্ডা দিচ্ছেন পারভেজ হোসেনের চা-স্টলে, আস্তে-ধীরে সিঁড়ি ভেঙে দুতলা থেকে নিচে নামছেন ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন, একজোড়া তরুণ-তরুণী এসেছে অন্তরে, শ্রাবণে আসাদ চৌধুরীর দেখা হয়ে গেল নাসির আলী মামুনের, নতুন লিটল ম্যাগ খুঁজছেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন, এভাবে প্রায় সারা সারাবেলায় জমজমাট থাকে আজিজ মার্কেট। (দ্রঃ  দৈনিক সমকালজানুয়ারি ২৪, ২০১০, ঢাকা)
ধান বানতে শিবের গীত গাইলাম, কারণ ছফা ভাই আর আমি ছিলাম অনেকটা স্থায়ী আজিজ মার্কেটে। আমাদের অফিস থাকার কারণে সারাদিনের এ সব বিচিত্র দৃশ্য দেখতে হতো। অনেকেই আসতেন, আড্ডা দিতেন আমার কিংবা ছফা ভাইয়ের উত্থান পর্বে। মধ্য মনি হয়ে উঠতেন ছফা ভাই।..
ছফা ভাইয়ের সাথে দীর্ঘ দশ বছর এক সাথে কাটিয়েছি। কাঁটাবন বস্তিতে শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’, পরে আজিজ মার্কেটে পাঠশালাখুলেন। আমি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পড়শি’, কানাডার মাসিক বাংলাদেশ’,  জাপানের মানচিত্র’, সুইডেনের পরিক্রমাপত্রিকা প্রকাশ করি। তাই একদিন ডেকে নিয়ে বললেন, বিদেশ থেকে কিছু ডনেশন  আনা যায় কিনা। কখন অসীম সাহার সাথে দূরত্ব তৈরির ফলে জার্মানির সাহায্য পাচ্ছিলেন না। আমি তাঁকে তখন যৎসামান্য সাহায্য করতে পেরেছিলাম। জাপানীভাষায় পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ’  উপন্যাসের অনুবাদের পেছনেও আমার সামান্য ভূমিকা ছিলো। তাঁর ওংকারউপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা বানিয়ে ছিলেন শহীদুল ইসলাম খোকন। কিন্তু তাঁর গল্প নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। আমি বিটিভিতে শামসুর রাহমানের সাযযাদ আমিনের কথাগল্প নাট্যরূপ দিলে, শামসুর রাহমান ছাড়া কি আর তোমরা অন্য কিছু দেখো না? আমি বললাম, আপনার হাতগল্প নিয়ে নাটক বানাতে চাই। কারণ, তাঁকে রাজি করানো খুব কঠিন কাজ। চির কুমার এবং প্রথা বিরোধী লেখক ছফা ভাই বাংলা একাডেমী কর্তৃক সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমার তাঁকে আহসান হাবীব সাহিত্য পুরস্কারদিতে চেয়েছিলাম। তিনি রাজি হননি। নাটকের ক্ষেত্রে রাজি হলেন। পরে হাতনিতে জাকির, সাদেকের জীবন ও সাহিত্যনামে নাটক লিখি। যা বিটিভিতে প্রচার হয়। এতে অভিনয় করেছিলেন খলিলুল্লাহ, কেয়া চৌধুরী, ভাস্কর বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ।
তাঁর সাথে নানা যেমন ছিলো আন্তরিকতা, তেমনি ছিলো বৈরিতাও। ছফা ভাই যেমন ছিলেন আওয়ামী বিরোধী, তেমনি ছিলেন প্রচন্ড শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ূন আজাদ বিরোধী। রাহমান ভাই বা হুমায়ূন আজাদ আমার অফিসে এলেই তিনি খোঁচা দিয়ে কথা বলতেন। আর আওয়ামী লীগের কোনো কিছু হলেই আমাকে চা অফার করে বলতে, তোমার আপা এটা করেছেন, সেটা করেছেন। তাই তাঁর প্রবাদতুল্য বক্তব্য- আওয়ামী লীগ জিতলে শুধু আওয়ামী লীগই জিতে আর যদি আওয়ামী লীগ হারলে সারা বাংলাদেশই ডুবে
শামসুর রাহমান  আর হুমায়ূন আজাদ সাথে বিরোধে দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন নূরুল আনোয়ার।
১। কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গেও কাকা একটি বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। ছিয়ানব্বই সালে শামসুর রাহমান বাংলাবাজার পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আহমদ ছফাকে একজন ধান্ধাবাজহিসেবে অভিহিত করেছিলেন। শামসুর রাহমান সাহেবের এমন মন্তব্যে ছফা কাকা খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন
 ২। হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে কাকার একটা কলমযুদ্ধ মানবজমিনে দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল।...হুমায়ুন আজাদ দৈনিক মানবজমিনে (১৯৯৮ সালের ১ ডিসেম্বর) একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেছিলেন।...
তিনি রবি ঠাকুরকে বলেছিলেন সাম্প্রদায়িক, নজরুলকে মৌলবাদী, লালন ফকিরকে পাগল, আহমদ ছফাকে শাহবাগের উন্মাদ। ... ফলে শুরু হয়েছিল দুজনের মধ্যে বিরতিহীন কলমযুদ্ধ। তাঁদের এই কলমযুদ্ধ শালীনতার পর্যায় ছাড়িয়ে গিয়েছিল। (দ্রঃ ছফামৃত, নূরুল আনোয়ার, আর্টস, বিডি নিউজ ২৪, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১০, ঢাকা।)
একবার রিটনের সাথে মহা তর্ক। ছফা ভাই তরুণদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বললেন, তোমরা তো পড়াশোনা করো না! আমি বললাম- অলাতচক্র, বাঙালি মুসলমানের মন, যদ্যপি আমার, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ পড়েছি। আপনি তো আমার কোনো বইটি পড়েছেন?
আমাকে বললেন, আমি তোমার কবিতার বই পড়তে চাই। আমি বললাম, আমি কবিতা বুঝেন না। আমি একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনাপড়ে হতাশ। আর ছড়াও তো ভুল ছন্দে নিখেন!
উল্লেখ্য, জাপান দূতাবাসে প্রেস সচিব পদে যোগদানের আগ পর্যন্ত লুৎফর রহমান রিটনের ছোটদের কাগজের অফিস ছিলো আজিজ মার্কেটে। তাঁকে কেন্দ্র করেও খ্যাতিমান থেকে শুরু করে বিচিত্র ধরনের লোকজন আসতেন। ফলে আমাদের অফিস ছিলো মূলত আড্ডার অফিস। রিটনের ছোটদের কাগজে বড়দের দিয়ে ছোটদের ছড়া লিখাতেন। সেখানে কাইয়ূম চৌধুরী, রফিকুন নবী, আহমদ ছফা, মুহম্মদ জাফর ইকবালেরা লিখতেন। তাঁদের অনেকেই ভুল ছন্দে, ভুল মিল-মাত্রায় ছড়া লিখতেন। আর পরের সংখ্যায় আমাকে দিয়ে রিটন ত্রুটি তুলে ধরে মতামত লিখাতেন। একবার ছফার ছড়া নিয়ে তুমুল ধুলাইখাল তৈরি করলাম। পরে ছফা ভাই আর এ নিয়ে কথা বলতেন নি। আমিও তাঁকে মজা করে বলতাম- ১৯৭১ সালে আপনিও গোলাম আজমের মতো শিবিরমানে (লেখক সংগ্রাম শিবির) গঠন করেছেন। তিনি বলতেন, তুমি শিবিরের সদস্য হয়ে যাও। অফিসে ঘুমুতেন। মাঝে মাঝে দরজা বন্ধ করে নেচে নেচে অদ্ভূত সুরে চিরকুমার আহমদ ছফা গান গাইতেন আমি ঘর করলাম নারে আমি, সংসার করলাম না’... আর ফকির আলমগীরে বিরুদ্ধে বলতেন, আমি ওই বেটাকে খুন করবো। সে আমার গান মেরে দিয়েছে।
একবার দেখলাম, সিলেট থেকে জুয়েল মাজহার শিক্ষকতা ছড়ে ঢাকায় এসেছেন, লেখালেখি করবেন বলে। তখন তার চাকরি-বাকরি নেই। ছফা ভাই বললেন, ‘আমার লেখালেখির সে সব বিল পত্র-পত্রিকায় জমে আছে, তা তুলে আপাতত চলতে থাকো। আমি তো মুগ্ধ হয়ে গেলাম তাঁর উদারতায়।
ছফা ভাইয়ের অনেক অদ্ভূত পাগলামি ছিলো। যেমন, হুমায়ূন আহমেদ, আনিস সাবেত এবং ছফা ভাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন জীবনে বিয়ে করবেন না। পরে হুমায়ূন আহমেদ, আনিস সাবেত বিয়ে করলেও ছফা ভাই ছিলেন চির কুমার। কাক পালতেন। কাকের সাথে কথা বলতেন। কাক নিয়ে ঘুরতেন!
পাগলামির আরও একটা ঘটনার কথা হুমায়ূন আহমেদ বয়ান করেছেন। তাঁরা আনিস সাবেতের বোনের বিয়েতে কুমিল্লা গিয়েছিলেন। সেখানে আনিস সাবেত ছফা কাকার কোন একটি লেখার সমালোচনা করলে তিনি ভীষণ রকম খেপে যান। আনিস সাবেত তাঁর মতে অটল থাকার কারণে ছফা কাকা রাতের বেলা ওঁদের ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। তখন রাত এত গড়িয়েছিল যে রাস্তায় কোন গাড়ি ছিল না। ফলে ছফা কাকা কুমিল্লা থেকে হেঁটে ঢাকা চলে এসেছিলেন। তাতে ছফা কাকার পা ফুলে গিয়েছিল। তাঁর জ্বর এসে গিয়েছিল। পরদিন আনিস সাবেত ছফা কাকার কাছে ক্ষমা চাইতে গেলে তিনি বলেছিলেন, সারা রাস্তা হেঁটে আসার কারণে তাঁর মাথায় একটি উপন্যাসের ধারণা মাথায় এসে গিয়েছে। রাগ করে না এলে এ ধারণাটা আসত না। হুমায়ূন আহমেদের কথায় যে উপন্যাসের গল্পটি তাঁর মাথায় এসেছিল তার নাম- ওঙ্কার
যাহোক, আমার অফিসে একটা পাগলা-ফাইলআছে। সে সব খ্যতিমান লেখকদের ব্যক্তিগত ভাবে আমার সাথে অন্যায় ভাবে কষ্ট দিতেন বা অপকর্ম করতেন, তার প্রতিবাদে আমি সরাসরি কড়া ভাষায় চিঠি লিখতাম এবং তাঁদের কাছে পাঠাতাম। আমার কাছে থাকতো অনুলিপি। আর সব চিঠির স্বাক্ষী থাকতেন রিটন। আমার সেই পাগলা-ফাইলভুক্ত লেখকেরা হলেন- শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, হারুন হাবীব, পূরবী বসু, মোবারক হোসেন খান, আহমদ ছফা প্রমুখ।
ছফা ভাইয়ের ঘটনাটাই বলি। একবার তিনি তিনটা চিঠি দিলেন। তাতে- লুৎফর রহমান রিটনের ছোটদের কাগজের জন্য ছড়া, নিউ ইয়র্কের শামস আল মমীনের জন্য কবিতা আর জন্য সাক্ষাতকার পাঠালেন। তাতে আমাদের তিন জনের নামি ভুল লিখছেন।
আমি তার প্রতিবাদ করে একটি চিঠি লিখলামঃ
......
প্রিয় ছফা ভাই,
পর সমাচার এই যে, আপনি তো তরুণদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। তাদের লেখা পড়েন না। তাদের সম্পর্কে জানেন না। খোঁজ কবর রাখেন না। কি অনেকের নামটাও ঠিক মতো জানেন না।
গতকাল আপনি যে তিনটি চিঠি পাঠিয়েছেন, তাতে আমাদের তিন জনের নামই ভুল। লুৎফার রহমান লিটন (লুৎফর রহমান রিটন), শামসুল মোমীন (শামস আল মমীন) আর সাইফুল্লাহ মোঃ দুলাল (সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল)।
আপনি এই উদাসিনতার পরিপ্রেক্ষিতে যদি, আপনার নাম আহমক ছপালিখি। সেটা কি শোভন হবে?
ইতি
সাহসী ও প্রতিবাদী-
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
[ বি দ্রঃ আপনি সাহসের দিয়ে না দিয়ে ছাগলের দিয়ে ছফা লিখেন কেনো?]
......
চিঠিটা লিখে তাঁর অফিসে পাঠালাম। তিনি ছিলেন না। পর দিন অফিসে ঢুকতেই আমার অফিস সহকারি দীন ইসলাম চা দিতে দিতে বলল- স্যার নিচ থেকে ছফা স্যার ৩/৪ বার ফোন করেছে।
আমি ফোন দিলাম। ফোন ধরে বললেন- দুলাল, উপরে আসো। এক্ষণি। আমি বললাম, চা খেয়ে আসি। তিনি বললেন, না না। আমার এখানে চা খাবে।
দীন ইসলামকে দিয়ে দুকাপ চা নিয়ে নিচে ছফা ভাইয়ের অফিসে গেলাম। ছফা ভাই নাটকীয় ভাবে উঠে এসে আমার দুপা জড়িয়ে ধরে তাঁর কন্ঠের ষ্টাইলেবলেন, “আমার পাপ হইয়াছে। আমি মর্জানা চাই। অক্ষমকে ক্ষমা করো
আমি অবাক! বিব্রত!! কিংকর্তব্যবিমূঢ়!!!
দ্রুত বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম- ছফা ভাই, একি করছেন! কি করছেন?
পরে বললেন, আহমক তো ছপার অপরাধ করেছে। তোমার দুপা পেলাম। রিটনের দুপা পাবো। কিন্তু মমীনের দুটোর জন্য তো আমাকে আমেরিকা যেতে হবে। একটা টিকিটের ব্যবস্থা করো না। মার্কিন-মক্কা যাই।
পরে যখন তিনি ১৯৯৯ সালে আমেরিকা গেলেন, তখন আমাকে ডেকে বলেছিন- এবার মমীন বান্দার কাছে যাচ্ছি। পাপ থেকে পবিত্র হয়ে পূণ্যবান হবো
সেই ঘটনা নিয়ে প এবং ফশিরোনামে একটি কবিতাও লিখেছিলাম। তার আংশিক এরকমঃ

এই সব মাপামাপি কৃতকার্‍্যের জন্য
আমি জাতির কাছে মাফ চাই।
 মাপ এবং মাফ নিয়ে চলছে বিভ্রান্তি
এই এবং নিয়ে গল্প আছে-
আহমদ ছফা এবং তাঁর ছপা-য়
(কবিতাসমগ্র/ সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, প্রকাশকঃ অনন্যা প্রকাশনী, দ্বিতীয় মুদ্রণঃ মার্চ ২০০৬, ঢাকা। পৃ/৩৬৫)
ছফা ভাইয়ের স্মৃতি নিয়ে কবিতা লিখেছি, স্মৃতিকথা লিখছি।  তাঁর এ সব ক্ল্যাসিকেল রসিকতা আমার সারা জীবনের সম্পদ।
(জঃ জুন ৩০, ১৯৪৩ ।। মৃঃ জুলাই ২৮, ২০০১)

=======================================
ভালো নির্মলেন্দু গুণ, মন্দ নির্মলেন্দু গুণ
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

ভালো রবীন্দ্রনাথ, মন্দ রবীন্দ্রনাথএই শিরোনামে নির্মলেন্দু গুণ একটি চমৎকার লেখা লিখেছেন, বহু বছর আগে। তাঁর চেহারায় মুখের অবয়ব, লম্বা লম্বা চুলদাঁড়ি মিলিয়ে অনেকটা রবীন্দ্র আদল প্রতিফলিত হয়। সেই কারণে গুণ ব্যাখ্যা করেছেন তিনি সকাল দুপুর সন্ধ্যা রাত্রি অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টাই রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত। নিজেকে মন্দ রবীন্দ্রনাথহিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। এবার রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর আরো একটি মিল পাওয়া গেল- চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ, চিত্রকর নির্মলেন্দু। এ সম্পর্কেও গুণদা মজাদার মন্তব্য করলেন, করলেন আত্মসমালোচনা। ০১৭১৭১১৬৬১৩ থেকে তিন বার ফোন এলো, ‘দুলাল, তোমার জন্য কাটাবনে অসীম সাহার ইত্যাদিতে বসে আছি। দ্র্বত চলে এসো। সোরহাব (হাসান) ও আছে। আমার ছবি দেখবে।আজিজ মার্কেট থেকে গেলাম। দেখলাম, আড্ডা চলছে। বিষয় কবির শিল্পকর্ম। যোগ দিলাম। বল্লাম, প্রথম আলোর গুণের নতুন গন্তব্যভালো লাগেনি। 
তিনি বললেন, সমালোচনা ভালো না লাগলেও চলবে। ছবি ভালো লাগলেই হলো। এই দেখো পোস্টার, এই দেখো ব্রুশিয়ার। ২৫ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরীতে তার চিত্র প্রদশর্নী চললো। ছবি বিক্রি হয়েছে ২৪টি, অর্থের পরিমাণ ৩ লক্ষ টাকা। বাকীগুলো বিভিন্ন জন এসে দেখছেন, কিনছেন। তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় নিজ নামানুসারে নির্মলেন্দু গুণ পাঠাগার ও সংগ্রহশালার কাজ শুরু করেছেন, বিক্রিত ছবির অর্থ দিয়ে। উল্লেখ্য, তিনি তাঁর আত্মকথা ১৯৭১গ্রন্থের জন্য সম্প্রতি দুই লাখ টাকা মূল্যমানের জেমকন পুরস্কারপেয়েছেন। সেই টাকাও ব্যয় করবেন উক্ত পাঠাগার এবং গ্রন্থশালার জন্য। তিনি কিছুটা খুব মিশ্রিত রসিকতা করে জানালেন, একমাত্র লতিফ সিদ্দিকী ছাড়া আওয়ামী লীগের আর কেউ আসেনও নি, ছবিও কিনেন নি। আসাদুজ্জামান নূর ফোন করেছিলেন- ১৫ আগস্টের লেখার জন্য। তিনি এড়িয়ে গেছেন। 
বলেছেন, তোমাদের দরকার হলেই গুণকে খোঁজো।... বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যা লিখেছি, সেগুলোই ভাঙিয়ে চলো।... তোমার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তো কাউকে পাঠাতে পারতো! ছবিতে বঙ্গবন্ধুকী এসেছে? গুণ দা বললেন, না। চেহারাটা চেষ্টা করেও আনতে পারিনি, আঁকতে পারিনি। আঁকলে হয়ত: শামীম শিকদারের বিকৃত বঙ্গবন্ধু হতো। কবি এ্যালেন গিন্সবার্গ, শামসুর রাহমান এসেছে, এসেছে রবীন্দ্রনাথ। তবে সরাসরি নয়, ভিন্ন ভাবে ভিন্ন মাত্রায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্র অবলম্বনে মা ও শিশুর পূনঃবিন্যাস বা পুন:নির্মাণ। আমার কাছে ভালো লেগেছে- রঙদানি!নানা রঙের বাটিগুলো উপস্থাপনায় গুণ দার শিল্পবোধের স্বাক্ষর পাওয়া যায়। নিজের ছবি সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য: আমি রাত জেগে ক্যানভাসে ছবি আঁকবো, আমার চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হবে- প্যারিস ভ্রমণকালেও এরকম ভাবনা আমার মাথায় আসেনি। এ হচ্ছে নিজের সম্পর্কে আমার নিজের ধারণা। কিন্তু প্রকাশ্য আমির বাইরেও যে আমার একটি গোপন আমি রয়েছে- আমাকে সেই চিত্রকর-আমির সন্ধান দিলেন অনুজপ্রতিম আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। সত্তর বছরের রবীন্দ্রনাথের পাশে পঁয়ষট্টি বছরের এই আমাকে চিত্রকররূপে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তিনি স্রষ্টার ইচ্ছাকেই পূর্ণ করলেন কিনা- সেই বিচারের ভার এখন ভবিতব্যের হাতে। কাব্যকলার পাশাপাশি আরও একটি আনন্দকলায় আমার হাতে-খড়ি হলো- ভেবে আমি বেশ আনন্দবোধ করছি। কপট বিনয় আমার চরিত্রের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হবে বিধায় বলি, আমার চিত্রকর্ম দেখে আমি নিজেই মুগ্ধ। আমার এই আত্মমুগ্ধতা সহজে যাবার মতো সামান্য নহে। মনে হচ্ছে, বর্তমান চিত্রপ্রদর্শনীটিই শেষ নয়, আমার প্রতিভার পীড়ন হয়তো আরও কিছুকাল বাংলাদেশের
মানুষকে সইতে হবে। আপনারা তার জন্য প্রস্তুত থাকবেন। তবে, আমার চিত্রকর্ম নিয়ে যদি বেশি নিন্দামন্দ হয়, যদি আশানুরূপ প্রশংসা এখানে না জোটে, তাহলে রবীন্দ্রনাথের মতোই আমার চিত্রকর্মের পরবর্তী প্রদর্শনী হবে ইউরোপে বা আমেরিকায়। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান চিত্রশালা হচ্ছে মানুষের মন। সেখানে স্বজনপ্রীতি বা গায়ের জোরের স্থান নেই। সেই চিত্রশালায় যদি আমার একটি-দুটি ছবিও স্থান লাভ করে, তবেই আমার হাতে-পায়ে-গায়ে রঙ মাখানো দিবানিশির শ্রম সার্থক হবে।আড্ডার পর্ব শেষ। আড্ডা থেকে উঠতে উঠতে জানালেন- ছোটবেলা চক্, চুন, ইট, মাটি, গাছের পাতার রসরঙ দিয়ে কাঁচা হাতেছবি এঁকেছেন, এবার আঁকলেন প্রকৃত শিল্পীদের মতো পাকা হাতে। 
তারপরও তিনি তার শেষ ভাষ্য, চিত্র সাধনা স্থায়ী হবে কিনা জানেন না। তবে অনেকটা ইনভেস্ট আর ইনভল্ব-এর কথাও বললেন। দেখা যাক, গুণের গন্তব্য কতদূর? পুনশ্চ: কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদও ছবি আঁকেন। তবে নিজের জন্য। ছবি এঁকে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে বিতরণ করেন। তাঁর চিত্রকর্ম প্রদর্শনী হলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না!
আগস্ট ১৭, ২০০৯ ঢাকা থেকে।
 .

কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে রবীন্দ্রনাথ
====================

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল 

Canada must believe in great ideals. She will have to solve… the most difficult of all problems, the race problem.

— Rabindranath Tagore, Vancouver, 1929





রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে ১৭ বার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু একবারও অস্ট্রেলিয়া যান নি; তাই নিয়েই কলাম লিখেছেন বন্ধুবর অজয় দাশগুপ্ত। আমাদের সৌভাগ্য যে, তিনি অন্তত একবার কানাডায় এসেছিলেন। কানাডা নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, বিবৃতিও দিয়েছেন। তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে চিত্রকর্ম প্রদর্শনীও হয়েছে। কানাডায় এখন তো রীতিমত নানা ভাবেই রবীন্দ্রচর্চা হচ্ছে।
শতবর্ষ আগে ভ্রমণ এখনকার মত এত সহজ জলভাত ছিলো না। জল-জাহাজের ভ্রমণ ছিল খুবই সময় সাপেক্ষ এবং কঠিন ব্যাপার। তারপরও তিনি ১৯১৬ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরই বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে কাটান। ফলে তাঁর রচিত ভ্রমণ-সাহিত্যও সমৃদ্ধ।
১৯১৩-এ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর সারা বিশ্ব ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে আসতে থাকে আমন্ত্রণের পর আমন্ত্রণ। অধিকাংশ আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ; জাহাজযোগে বহু দেশে গেছেন ; পরিচিত হয়েছেন বিভিন্ন দেশের বিদ্বজ্জন ও রাজ-রাজড়াদের সাথে। বহু স্থানে, বহু বিদ্যায়তনে, বহু সভায় স্বকণ্ঠে কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁর জীবনোপলব্ধি ও দর্শন এবং তাঁর কাব্যের মর্মবাণী এভাবে কবি সরাসরি বিশ্বমানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। প্রবাসের জীবনে তাঁর হাতে পূরবীর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাব্য রচিত হয়েছে। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের ফলে বহুজন তাঁর কবিতা অনুবাদে উদ্যোগী হয়েছেন।
১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচটি মহাদেশের তেত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন।(১) তবে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাস্ট্র বাদ দিলে অন্যান্য দেশসমূহ ভ্রমণ করেছেন ১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর।
দেশগুলোহলোঃ ফ্রান্স, হংকং, চীন, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, জার্মানী, ডেনমার্ক, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, আর্জেন্টিনা, ইতালি, নরওয়ে, হাঙ্গেরী, যুগোশ্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, গ্রীস, মিশর, সিঙ্গাপুর,ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, বার্মা, হল্যান্ড, সোভিয়েট রাশিয়া, ইরান, ইরাক এবং শ্রীলংকা। (উইকিপিডিয়ার এই তালিকায় ভ্যাঙ্কুভার ভ্রমণের কথা উল্লেখ নেই!)
যাহোক, তাঁর বিদেশ ভ্রমণ শুরু হয় ১৮৭৮ সালে প্যারিস হয়ে লণ্ডন গমনের মাধ্যমে। ১৯৩৪-এ শ্রীলংকা (সিংহল) ভ্রমণ শেষে কবি শান্তিনিকেতনে ফেরেন ২৮ জুন। এরপর তিনি আর বিদেশভ্রমণে যান নি। এই ভ্রমণগুলির মধ্যে অনেকগুলিই রবীন্দ্রনাথের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এর মাধ্যমে তিনি ভারতের বাইরে নিজের রচনাকে সুপরিচিত করে তোলেন এবং প্রচার করেন তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ। একই সঙ্গে বহু আন্তজার্তিক সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংগে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।(২)

আধুনিক ভারতের শুভেচ্ছা দূত রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ভ্যাঙ্কুভার ভ্রমণ ছিলো ১৯২৯ সালে। তিনি এসেছিলেন শিক্ষা শীর্ষক বক্তৃতা দিতে | As one of the earliest educators to think in terms of the global village, Rabindranath Tagore’s educational model has a unique sensitivity and aptness for education within multi-racial, multi-lingual and multi-cultural situations, amidst conditions of acknowledged economic discrepancy and political imbalance. তাই এই বক্তৃতা সম্পর্কে টরন্টো বিশ্ব বিদ্যালেয়ের রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ বিষয়ক শিক্ষক ক্যাথলিন এম ও’কনেলের মূল্যায়নঃ In 1929 Rabindranath Tagore came to Vancouver to address a conference of the National Council of Education of Canada. This article analyzes his reception as reported in the news media, but primarily examines the educational priorities he chose to elaborate. One major theme that he emphasized was ‘freedom’ in education: physical, mental, spiritual, and moral freedom, and freedom from racial and national prejudice. In particular he stressed the role of leisure in education and human life at large, in contrast to relentless competition for material advantage. He urged that imagination and creativity, especially artistic creativity, be nurtured, reflecting his own experience of growing up in a remarkably creative Bengali Indian family.(৩)
সেই সময় ভ্যাঙ্কুভারে তাঁর একটি চিত্র প্রদর্শনীও হয়েছিলো। ভ্রমণ শেষে ভারতে ফিরে গিয়ে ‘অভিযান (কানাডার প্রতি)’ নামে একটি কবিতা লিখেন। তা কবি কর্তৃক ইংরেজি অনুবাদ প্রচার হয় অটোয়া রেডিওতে ১৯৩৬ সালে। কবিতাটি হচ্ছে:

বিশ্ব জুড়ে ক্ষুব্ধ ইতিহাসে
অন্ধবেগে ঝঞ্ঝাবায়ু হুংকারিয়া আসে
ধ্বংস করে সভ্যতার চূড়া।
ধর্ম আজি সংশয়েতে নত,
যুগযুগের তাপসদের সাধনধন যত
দানবপদদলনে হল গুঁড়া ।
তোমরা এসো তরুণ জাতি সবে
মুক্তিরণ-ঘোষণাবাণী জাগাও বীররবে ।
তোলো অজেয় বিশ্বাসের কেতু ।
রক্তে-রাঙা ভাঙন-ধরা পথে
দুর্গমেরে পেরোতে হবে বিশ্বজয়ী রথে,
পরান দিয়ে বাঁধিতে হবে সেতু ।
ত্রাসের পদাঘাতের তাড়নায়,
অসম্মান নিয়ো না শিরে, ভুলো না আপনায় ।
মিথ্যা দিয়ে, চাতুরী দিয়ে, রচিয়া গুহাবাস
পৌরুষেরে কোরো না পরিহাস ।
বাঁচাতে নিজ প্রাণ
বলীর পদে দুর্বলেরে কোরো না বলিদান।(৪)

কবিতা, বক্তৃতা ছাড়াও তিনি স্বদেশী অভিবাসীদের জন্য বিবৃতিও দিয়েছেন, শুরুতেই বলেছি। ‘বঙ্গ রমণীর জাপান যাত্রা’ সম্পর্কে আমরা জানি, তবে বঙ্গীয় পুরুষ কখন কবে প্রথম কানাডায় আসে, তার তেমন কোনো তথ্য জানা নেই। প্রায় একশ বছর আগে ভারতীয়দের কানাডায় প্রবেশের নানা ধরনের বাধা ছিল। তা সত্ত্বেও বহু ভারতীয় প্রশান্ত মহাসাগর-তীরস্থ বিশেষ করে ভ্যাঙ্কুভারে জীবিকার জন্য বসতির চেষ্টা করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রাজ অশ্বেতাঙ্গদের অবদান অস্বীকার করতে না পারায় কানাডা অভিবাসনের ক্ষেত্রে সরাসরি আপত্তি না করে কিছু নতুন আইন করে। যদি কোনো জাহাজ কোনো বিদেশের বন্দর থেকে সোজাসুজি ভাঙ্কুভারে পৌঁছায়, তবে সেই জাহাজে করেই শ্রমিকেরা কেবল আসতে পারবে, অন্যথায় নয়। ভারতের নিজস্ব জাহাজ না থাকায় কোনো জাহাজই সোজাসুজি কানাডায় পৌঁছাতো না। ১৯১৪ সালের এপ্রিল মাসে কোমাগাটা মারু নামে একটি জাহাজ চার্টার ভাড়া করে পাঞ্জাবিদের একটি দল গুরদিৎ সিংহের নেতৃত্বে কানাডা রওনা হয়। তাদের কানাডায় নামতে দেওয়া হয়নি এবং দেশে ফিরতে বাধ্য করা হয়। কোমাগাটা মারু কলকাতার বজবজঘাটে পৌঁছালে শিখদের বিরুদ্ধে কৃত আচরণের কঠোর সমালোচনা করা হয়। রবীন্দ্রনাথ এসব ঘটনা জানতেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাস্ট্র যাচ্ছেন এই সংবাদ পেয়ে কানাডা হতে একটি প্রতিষ্ঠান তাঁকে ভাঙ্কুভারে আসার জন্য নিমন্ত্রণ জানায়। কবি নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে বলে পাঠান যতদিন তাঁর স্বদেশবাসীকে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় অপমান ও নির্যাতন করবে, ততদিন তিনি তাদের দেশের মাটি মাড়াবেন না। (৫) অবশ্যই তার পাচঁ বছর পর কানাডার আমন্ত্রণে তিনি এসেছিলেন সেই শিক্ষা বিষয়ক বক্তৃতা দিতে।
এ সম্পর্কে ইউর্ক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর অনন্যা মুখার্জি রেড লিখেনঃ Few Canadians know of him today but thousands of Canadians did 80 years ago, turning out in droves to see and hear Rabindranath Tagore, the first non-European Nobel laureate (Literature, 1913), and Asia’s iconic poet and humanist whose 150th birth anniversary fell on May 7. The event was celebrated widely, including in Toronto and, very appropriately, in Vancouver, which he visited in 1929. He went there after having declined several invitations in protest against the Komagata Maru incident of 1914, when 376 Indian immigrants were denied entry to Canada.
When Tagore finally accepted the invitation of the National Council of Education to address its triennial conference, the Vancouver Sun reported in April 1929: “Thousands sought to see and hear Tagore . . . but could not gain admission. They stood in long lines for hours outside . . . even after he had commenced speaking, they waited before the theatre doors reluctant to leave. More than any other delegate he had seized their imagination.”(৬)
‘দ্য ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ আডুকেশনে’র আমন্ত্রণে স্টিমার করে ১৯২৯ সালের ৭ এপ্রিল ৪৩ বছর বয়সে ১০ দিনের সফরে তিনি ভ্যাঙ্কুভারে এসেছিলেন। উঠেছিলেন ভ্যাংকুভার হোটেলে। পরদিন রোববার ভ্যাঙ্কুভারের ঢাউন টাউনে ‘দ্য প্রিন্সিপাল অফ লিটারেচার’ শীর্ষক সম্মেলনে বক্তৃতা দেন। দুই হাজার আসনের হল কানাকানায় ভর্তি হয়ে শত শত দর্শক-শ্রোতার ভীড় বাইরে আপেক্ষা করেছিল। যারা অনুষ্ঠানে ঠাঁই পান নি বা প্রবেশের সৌভাগ্য জুটেনি, তাদের দীর্ঘ সারি থিয়েটার হল থেকে গ্রান ভিল স্ট্রিট হয়ে হোটেলে ভ্যাঙ্কুভারের পাশ দিয়ে ওয়েস্ট জার্জিয়া স্ট্রিট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। পরে তাদের অনেকেই হোটেলে সাক্ষাৎ করেন। ১৪ এপ্রিল ‘ট্রায়েন্নিয়াল কনফারেন্স অফ দ্য ন্যাশনাল এডুকেশন অব কানাডা’তে ম্যাসেজ অব ফ্যায়ারওয়েল’এ ভাষণ দেন। ১৬ এপ্রিল ভ্যাঙ্কুভারের গভর্ণর জেনারেল লর্ড উইলিংডনের সাথে দেখা করেন এবং সে দিনই লস এঞ্জলেসের উদ্দেশে রওনা হন। যাবার পথে পাসপোর্ট হারানোর কারণে আমেরিকায় ঢুকতে পারেন নি। পরে জাপান যান। তিনি জাপান সফর করেছেন পাঁচ বার। ভ্যাঙ্কুভার সফরের সময় স্থানীয় পত্র-পত্রিকাগুলো প্রতিদিনই তা গুরুত্ত্ব দিয়ে প্রচার করে। যেমনঃ
১। ভ্যাঙ্কুভার সান, ৯ এপ্রিল ১৯২৯-এ টরন্টো ভার্সিটির প্রবীণ প্রফেসর জর্জ এম রং কবিকে ‘প্রিন্স অফ বেঙ্গল’ এবং ‘মহাকবি আর বিশ্ব শান্তি প্রেমিক’ আখ্যা দেন, তার সচিত্র সংবাদ ছাপা হয়।
২। দ্য ডেইলী প্রভিন্স, ১১ এপ্রিল ১৯২৯-এ সাংবাদিক ক্লিফফোর্ড ডলিং-এর নেয়া সাক্ষাৎকার ছাপা হয়।
৩।ভ্যাঙ্কুভার সান, ১২ এপ্রিল ১৯২৯-এ ছাপা হয় আগের দিন স্থানীয় শিখ টেম্পল পরিদর্শনের খবর।
৪। ভ্যাঙ্কুভার সান, ১২ এপ্রিল ১৯২৯-এ সাংবাদিক নোয়েল রবিন সন-এর নেয়া সাক্ষাৎকার ছাপা হয়।
৫।দ্য ডেইলী প্রভিন্স, ১৫ এপ্রিল ১৯২৯-এ তাঁর নিয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ মন্তব্য প্রতিবেদন উপস্থাপন করে।
৬। এদিকে, ভ্যাঙ্কুভারে প্রথম বাঙালি তারকা বলে খ্যাত তারাকানাথ দাশ ১৯০৮ সালে ‘ফ্রি ইন্ডিয়া’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। এটিই উত্তর আমেরিকায় দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পত্রিকা বলে মনে করা হয়। যা বঙ্গ ভঙ্গরদ আন্দোলনের ভূমিকা পালন করে। এই ফ্রি ইন্ডিয়ায় কবির লেখা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’… ইংরেজি অনুবাদ ছেপেছিলো।
রবি ঠাকুরের ভ্যাঙ্কুভার সফরের ৭০ বছর পর অর্থাৎ ২০০২ সালেকন্স্যুলেট জেনারেল অব ইন্ডিয়ে আর কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশান্সের যৌথ উদযোগে তাঁর স্মরণে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় কবি-মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। এর আগে ২০০৫-এর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত টরন্টো ইউনির্ভাসিটিতে টেগোর সম্মেলনের সময় কবির ভাস্কর্য স্থাপিত হয়। এছাড়াও রয়েছে- ভ্যাঙ্কুভার টেগর সোসাইটি।
রবি ঠাকুরের ভ্যাঙ্কুভার ভ্রমণ নিয়ে বইও লেখা হয়েছে। বইটি হলোঃ Rabindranath Tagore’s visit to Canada & Japan by Prasanta Chandra mahalanobis / Publisher : Haskell House Pub, NY 1929. (এ ছাড়াও লেখাটি ছাপা হয়েছিলোঃ Issue 57 of Studies in Asiatic Literature Issue 14 of Bulletin - Visva-Bharati, Visva-Bharati, India ).

লুৎফর রহমান রিটন বলেছেন, কানাডার আকাশে আমি রবীন্দ্রনাথকে খুঁজি। পাই না। এখানকার ঝকঝকে আকাশে মেঘের পুত্র-কন্যারা অবিরাম নির্মাণ করে চলে অ্যানিমেশন মুভির অসাধারণ ক্যারেক্টারগুলোকে। ওই তো মিকি মিনি আর ডোনাল্ডডাক! ওই যে সিন্ডারেলা! পিনোকিও সাতবামন আর নিমো। লায়ন কিংয়ের সিম্বা পুম্বা আর টিমোনও আছে। কিন্তু কানাডার আকাশে রবীন্দ্রনাথ নেই।(৭)
প্রিয় রিটন, এক হিসাবে রবীন্দ্রনাথ নেই; আরেক হিসাবে আছে। আছে- বাঙালিদের চেতনায়। তাই বহুসংস্কৃতির দেশ কানাডার মূলধারার সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মতিথিতে নানান কর্মসূচি পালিত হয় । টরন্টোর প্রাচীন থিয়েটার প্রতিষ্ঠান ‘প্লিইয়াডিস থিয়েটার’ ৭ মে থেকে ৪ জুন ২০১১ পর্যন্ত রবি ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ গল্প অবলম্বনে জুরি মেহতার অনুদিত ইংরেজি নাট্যরুপ ‘দ্য পোষ্ট অফিস’ মঞ্চস্থ করছে । জন ভ্যানবুরেকের পরিচালিত এতে যারা অভিনয় করছেন তারা হলেন কানাডিয়ান শিল্পী- প্যাট্রিসিয়া মার্সিইউ, মিনা জেমস, জেনিফার ভিলাভারডি, স্যাম মোসেস, এরল সিথাল, সুগিথ ভারোগিস এবং ডিলন স্কট স্মিথ ।(৮) উল্লেখ, সঞ্জত পরিচালক দেবাশীষ সিনহা এ নাটকে ইংরেজি ভাষান্তরে যুক্ত করেছেন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জনপ্রিয় সেই গানটি- ‘ভালো আছি ভালো থেকো/আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও’। ইতোপূর্বে ক’বছর আগে আরেক গ্রুপ ‘বার্কলি স্ট্রিট থিয়েটার’ সমকালীন কানাডার উপযোগী করে ‘শকুন্তলা’ মঞ্চায়ন করেছিলো ।
রবি ঠাকুরের ১৫০তম জন্মতিথি উপলক্ষে ভারত সরকার ২০১১ সালকে ‘ইয়ার অব ইণ্ডিয়া ইন কানাডা’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। খোলা হয়েছে ওয়েব সাইড- www.tagore150.toronto.ca. এদিকে টেগোর এনিভারসারি কমিটি টরন্টো’র উদ্যোগে টরন্টোর ডিস্ট্রিক স্কুল বোর্ডের আওতাধীন স্কুলগুলোর প্রাথমিক পর্যায়ে গ্রেড ৩ থেকে গ্রেড ৮ পর্যন্ত রবি ঠাকুর পাঠ্য হচ্ছে। ।

তথ্যসূত্রঃ

১. (Krishna) Datta & Robinsob. Pulisher : Bloomsbury, London. 1995. ISBN 0747520046. Page/ 374-376
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভ্রমণ, উইকিপিডিয়া৩. University of Toronto Quarterly/Volume 77, Number 4, Fall 2008. pp 980-991.
E-ISSN: 1712-5278 Print ISSN: 0042-0247, University of Toronto Press, Canada.
( Kathleen M. O’Connell teaches courses on South Asia at New College, University of Toronto, Toronto, Ontario. Her research interests include Rabindranath Tagore; Satyajit Ray; and Bengali literature and cultural history.)
৪. http://www.rabindra-rachanabali.nltr.org/node/12651
৫. কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রতি/ মুহম্মদ হাবিবুর রহমান/বাংলা বইমেলা স্মরণিকা, টরন্টো, ২০০৮, পৃ-১৪৬. Rabindranath Tagore: Much More Than a Mystic by Ananya Mukherjee-Reed, Daily Toronto Star, May 08, 2011. Toronto, Canada.
৭. কালের খেয়া, দৈনিক সমকাল, ডিসেম্বর ০৯, ২০১১, ঢাকা 

. http://www.bdcan.ca/bangladeshievents/event_details.php?eid=202&type=i

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন