সাক্ষাৎকার



======
বোতাম লাগাতে যে গুণ লাগে
কবিতা লিখতে তার চেয়ে বেশি গুণ লাগে

সাতদিনঃ নিজের লেখালেখিকে আপনি কি ভাবে মূল্যায়ন করেন?
আবু করিমঃ বাংলা ভাষাটা আমি মোটামুটি লিখতে পারি।

সাতদিনঃ আপনার প্রথম লেখা এবং প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
আবু করিমঃ প্রথম লেখা একটি ছড়া। ১৯৬৬ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকার মুকুলের মহফিল এ ছাপা হয়। প্রথম প্রকাশিত বই পল্টনে আবার জনসভা হবে । এই বই যখন প্রকাশিত হয় তখন আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙ্গামাটি চাকুরি করি। ১৯৮৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী প্রকাশ পায়। শাহরিয়ার কবির বই এর নাম দেয় এবং প্রকাশের দায়িত্ব পালন করে আর আবেদীন আব্দুল কাদের একটা দীর্ঘ চিঠি লিখে তার প্রতিক্রিয়া জানায়। বইটি জনসমাজে তেমন আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি।

সাতদিনঃ বাংলা সাহিত্যের কোন শাখা তুলনামুলক ভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন?
আবু করিমঃ কবিতা।

সাতদিনঃ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
আবু করিমঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে সাহিত্যের কোন বিরোধ নাই। তোমার মনে হয় আমার লেখা পছন্দ হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে আমি আর উত্তর দিচ্ছি না। ধন্যবাদ।
জীবন নিয়েই তো আমরা লিখি।সু তরাং জীবনের ওপর তার প্রভাব তো থাকবেই। রাজনীতির ওপর তার প্রভাব থাকবে, সর্বক্ষেত্রে সাহিত্যের প্রভাব থাকবে।

সাতদিনঃ আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
আবু করিমঃ বাংলা সাহিত্যে আমার প্রিয় লেখক রবীন্দ্রনাথ । তার সম্পর্কে এত বই লেখা হয়েছে  যে নতুন করে বলার কিছু নাই ।

সাতদিনঃ আপনার নিজের প্রিয় লেখা কোনটি এবং কেনো?
আবু করিমঃ আমার বেশীর ভাগ লেখাই আমার প্রিয়। লেখা হচ্ছে সন্তানের মতো। কাকে ছেড়ে কার কথা বলবো ?

সাতদিনঃ আপনার লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা কি?
আবু করিমঃ ভালো লাগা। ভালো লাগে বলেই এই নিরর্থক কাজ এখনো করে যাচ্ছি।

সাতদিনঃ শর্ত স্বাপেক্ষে লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে বললে কি ছাড়তে পারবেন?
আবু করিমঃ অর্থহীন প্রশ্ন। কে আমাকে লেখা ছেড়ে দিতে বলবে? আমিই বা শুনবো কেন?

সাতদিনঃ এক জন লেখকের ভেতরের মানুষস্বত্তাকে আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করেন?
আবু করিমঃ লেখক আর দশজন মানুষের মতোই। মানিক মনে করতেন লেখক আর শ্রমিকের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই
আমার মতামত অনেকটা তাই। তবে লেখক হতে হলে মেধা থাকতে হবে শ্রমিকের চেয়ে বেশি। বোতাম লাগাতে যে গুণ লাগে কবিতা লিখতে তার চেয়ে বেশি গুণ লাগে।

সাতদিনঃ মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেব?
আবু করিমঃ মৃত্যু নিয়ে আমার অনেক কবিতা আছে। কিছুদিন আগে লেখা দেবতারা নামে একটি কবিতা ফেসবুক এর  timeline এ আছে। তুমি ঐ কবিতা নিতে পারো।

সাতদিনঃ লেখালেখি ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয়?
আবু করিমঃ লেখালেখির বাইরে তাস খেলা আমার খুব প্রিয় কাজ। খেলা দেখতেও খুব পছন্দ করি। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতেও আমার খুব ভাল লাগে।

সাতদিনঃ সাহিত্যের বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শ্ত্রুকে কি ভাবে মূল্যায়ন করেন।
আবু করিমঃ আমার কোন শত্রু নাই। যখন চাকুরি করেছি তখন যারা আমার পদ পেতে আগ্রহী ছিল তারা কেউ কেউ হয়তো আমাকে শত্রু ভাবতো। আমি তাদের শত্রু ভাবিনা কারন এই পদ নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা নাই। আমলার চাকুরি ছিল আমার পেশা।
আমি দীর্ঘ জীবনে বহু মানুষের সঙ্গে মিশেছি। বহু মানুষের ভালোবাসা আমি পেয়েছি। আমার বন্ধুর সংখ্যা অগণিত। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বাঁধা আরোপ করার কারণে আমার বন্ধু তালিকা প্রায়ই সংক্ষিপ্ত করতে হয়। এ পর্যন্ত কয়েকবার তা ৫০০০ ছাড়িয়ে গেছে।

=================
লেখালেখির জন্য এ-জীবনে বহু কিছু ত্যাগ করেছি: পিনু

সাতদিনঃ নিজের লেখালেখিকে আপনি কি ভাবে মূল্যায়ন করনে?
গোলাম কিবরিয়া পিনুঃ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে লিখছি। লেখায় নিজেকে নিবেদিত রাখার চেষ্টা করেছি, এটাই মূল কাজ বলে বিবেচনা করেছি- এজন্য অনেক সিঁড়িতে পা রাখতে পারিনি, অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধে থেকে নিজেকে সচেতনভাবে প্রত্যাহার করে নিয়ে লেখালেখির সত্ত্বাকে সতেজ-সজীব রাখার চেষ্টা করেছি। লিখেছি ২০টির মত গ্রন্থ। কবিতাগ্রন্থ ১৩টি  ও অন্যান্য লেখা নিয়ে বাকী সাতটি গ্রন্থ। পাঠকপ্রিয় সেভাবে হয়তো হইনি, পাইনি হয়তো কাক্সিক্ষত মূল্যায়নতবে- লিখেছি নিজেকে শাসন করে, লিখেছি সচেতন পথ-নির্মাণ করে। হয়তো মূল্যায়ন হবে- হয়তো হবে না। তবে, লিখবো  শিরদাঁড়া উঁচু করে- নিজের শক্তিতে, নিজের সৃজনশীল স্পর্ধায়।

সাতদিনঃ আপনার প্রথম লেখা আর প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

গোলাম কিবরিয়া পিনুঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এমএ পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্ট হওয়ার আগেই ঢাকায় ১৯৮৩ সালের শেষে এসে চাকরি নিয়ে থিতু হলাম। সেই সময়ে কবিতা লেখার গোপনীয় স্পর্ধা নিয়ে নিজের ভেতর এক ধরনের চঞ্চলতা ছিল। সেই চঞ্চলতার রেশ নিয়ে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ এখন সাইরেন বাজানোর সময়বের হয় ১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসে, একুশের গ্রন্থমেলা উপলক্ষে নয়, তখন মেলা উপলক্ষে এখনকার মত বই বের হতো না, মূলত বছরের অন্যান্য সময়ে বেশি বই বের হতো। তবে, বছরের অন্যান্য সময়ে প্রকাশিত বই মেলায় বিক্রি হতো।  বইটি বের হয়েছিল ৪ বাংলাবাজারের পান্ডুলিপিথেকে, প্রকাশক ছিলেন লক্ষণ চন্দ্র সাহা, সেই সময়ে নির্মলেন্দু গুণ, মাসুদ বিবাগী ও আমার কাব্যগ্রন্থ একসাথে বের হয়েছিল এই প্রকাশনা থেকে। সেই পান্ডুলিপিএখন নেই, প্রকাশক  লক্ষণ চন্দ্র সাহার খোঁজ এখন আমার অজানা! তবে, মনে আছে প্রকাশক লক্ষণ চন্দ্র সাহার সাথে নির্মলেন্দু গুণ ও মাসুদ বিবাগীর বেশ সখ্য ছিলÑআমিও পান্ডুলিপিতে গিয়েছি, প্রকাশক লক্ষণ চন্দ্র সাহার সাথে আমারও সংক্ষিপ্ত আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাঁর মুখটি এখনো উজ্জ্বলভাবে মনে পড়ে! বিশেষ করে বইমেলা বা বইয়ের কথা মনে হলে! আমার প্রথম বইয়ের প্রকাশক হিসেবে তাঁর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা রয়েছে। এখনো আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ এখন সাইরেন বাজানোর সময়বের হওয়ার অনুভুতি অনুভব করিÑ কী এক আবেগ ও শিহরণ নিয়ে বইটি বের করেছিলাম! রাত জেগে ৬৩ হৃষিকেশ দাস রোডের তাহের আর্ট প্রেস থেকে বইটি কালিমাখা অবস্থায় ছেপেছিলাম! ৪৮পৃষ্ঠার বইটির দাম ছিল বারো টাকা। বইটির প্রচ্ছদ ও নামের  লেটারিং আমি করেছিলাম দুই রংয়ে, অন্য নামে। প্রচ্ছদটি একেবার খারাপ হয়নি, প্রশংশিত হয়েছিল। মনে পড়ে বইটির বিজ্ঞাপন সচিত্র সন্ধানীতে ছাপা হয়েছিল কয়েক সংখ্যায়, পত্রিকাটিতে তখন আমার কবিতা ছাপা হয়েছিল, এই সূত্র ধরে বিজ্ঞাপনটি ছাপা হয়। এ বিষয়ে কথাসাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদার বিশেয় সহায়তা করে ছিলেন, তখন তিনি এই পত্রিকাটির সাথে যুক্ত ছিলেন। সাপ্তাহিক একতাসহ আরও কিছু পত্রিকায় বইটির বিজ্ঞাপন ও খবর বের হয়েছিল। পরবর্তিতে বেশ কিছু আলোচনাও ছাপা হয়। সেই সময়ে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য এলাকার মধ্যে সড়ক ও প্রযুক্তি নির্ভর যোগাযোগ এখনকার মত ছিল না, গণমাধ্যমেরও এতটা বিকাশ হয়নি। বলতে দ্বিধা নেই- কবি হয়ে ওঠার এক ধরনের প্রেষণা নিয়ে ঢাকায় আসা এবং সেই প্রেষণার আওতায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হওয়ায় স্বপ্ন ছুঁয়ে আনন্দ অনুভব করেছিলাম। উল্লেখ্য, এই কবিতার বইটি যখন বের হয়- তার অনেক আগে থেকেই গাইবান্ধা অবস্থান করার সময় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ঢাকার উল্লেখযোগ্য দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকীতে আমার কবিতা নিয়মিত কবিতা ছাপা হচ্ছে ছিল। আরও উল্লেখ্য-স্বৈরাচার নিয়ন্ত্রিত সরকার রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধারাকে তখন করছিল- বাধাগ্রস্ত।

সাতদিনঃ বাংলা সাহিত্যের কোন শাখা তুলনামুলক ভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন?  
গোলাম কিবরিয়া পিনুঃ বাংলাসাহিত্যের কবিতা-কথাসাহিত্য তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ।

সাতদিনঃ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পা্রে?
গোলাম কিবরিয়া পিনুঃ সাহিত্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে গুরুত্ব হারাচ্ছে না, বরং বিভিন্ন পর্যায়ে বিস্তৃত হচ্ছে- আগের চেয়ে বিভিন্ন ধরনের পাঠকের কাছে সাহিত্য পৌঁছে যাচ্ছে। এক দেশের সাহিত্য আর এক দেশের পাঠকের কাছে সমাদৃত হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক সহজে। জীবনও ভিন্নমাত্রা পাচ্ছে।

সাতদিনঃ আপনার প্রিয় লখেক সর্ম্পকে কিছু বলবেন ঙ্কি?
গোলাম কিবরিয়া পিনুঃ আমার বহু প্রিয় লেখক। কবিতায় বেশ কজন, ঠিক তেমনি সাহিত্যে অন্যান্য শাখারও বহু লেখক আমার প্রিয়।

সাতদিনঃ আপনার নজিরে প্রয়ি লখো কোনটি এবং কনেো?
গোলাম কিবরিয়া পিনুঃ কবিতা কম লিখিনি। ছাপা হয়েছে অনেক। এরমধ্যে অনেক কবিতা আমার প্রিয়। অন্যান্য কিছু লেখাও আমার প্রিয়। তবে- প্রিয় লেখা লিখতে চাই আরও।

সাতদিনঃ আপনার লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা কি?
গোলাম কিবরিয়া পিনুঃ আমার লেখালেখির পিছনে প্রেরণা আমার দেশকালের ভিত্তিমূল দিয়ে তৈরী করা স্বপ্ন ও প্রেষণা। এবং মানবীয় সেইসব নৈতিকতা-দর্শন-মূল্যবোধ, যা মানুষ হিসেবে আরও সমৃদ্ধ এক জীবনবোধের প্রণোদনায় সক্রিয় রাখে- এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ যোগায়।

সাতদিনঃ র্শত স্বাপক্ষে লেখলেখি ছেড়ে দিতে বললে কি ছাড়তে পারবেন?
গোলাম কিবরিয়া পিনুঃ লেখালেখি ছাড়া সম্ভব নয়। লেখালেখির জন্য ইতোমধ্যে এ-জীবনে ব্যক্তিগত-সামাজিক-পেশাগত ও অন্যান্য বহু কিছু ত্যাগ করেতে হয়েছে। আর এ-বয়সে বহু  কিছু  দূরে ঠেলে দেওয়ার পর লেখালেখি দূরে ঠেলে দেওয়া সম্ভব নয়।

সাতদিনঃ এক জন লেখকের ভেতরের মানুষস্বত্তাকে আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করেন?
গোলাম কিবরিয়া পিনুঃ একজন লেখকের মানুষসত্ত্বা’-কে আমি খুবই গুরুত্ব দিই। বিশেষত- আমরা যারা কবিতা লিখি, তাদের ভেতরের মানুষসত্ত্বাবহ যুদ্ধ করে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। এজন্য কত কষ্ট, কত ত্যাগ, কত রকমের প্রতিকূলতা সহ্য করতে  হয়। বাঁচিয়ে রাখতে হয় এই মানুষসত্ত্বাঅনৈকতা থেকেÑপ্রচলিত গড্ডলিকা থেকে- নিজেকে শাসন করে- নিজেকে মুক্ত করে- নিজেকে চঞ্চল করে- নিজেকে  উজ্ঝীবিত করে। কবিতা  খুবই স্পর্শকাতর মাধ্যম- যা মানুষসত্ত্বার ওপর নির্ভরশীল এক শিল্পসত্ত্বা- যা অভিমানে নয়- যা সূক্ষ্ম-বিবেচনা  বজায় রেখে পথ চলে কবির সাথে কবির মানুষসত্ত্বার সাথে।

সাতদিনঃ মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
গোলাম কিবরিয়া পিনুঃ মৃত্যুকে বহুরৈখিক বিবেচনায় ব্যাখ্যা করি নিজের কাছে।  ভাবি- ব্যক্তির সীমাবদ্ধ জ্ঞান, এবিষয়ে এখনো বিভিন্ন দোলাচলে দোলাতে থাকে।

সাতদিনঃ লেখালেখি ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয় এবং অ্প্রিয়?
গোলাম কিবরিয়া পিনুঃ লেখালেখি ছাড়া আমার কাছে আরও অনেক কিছু প্রিয় ও অপ্রিয়। প্রিয়- মানুষের ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, অন্যের জন্য চঞ্চলতা, শিশুর হাসি, মানুষে মানুষে সখ্য এবং প্রকৃতির বিভিন্নমুখী সৌন্দর্য ও সাহচর্য। আর কত কী! জীবনের আরও কত অনুরণন।
অপ্রিয়- মানুষের লোভতাড়িত ঠকানোর কৌশল, আত্মসর্বস্ববাদী ভূমিকায় অন্যের ক্ষতি করা আর বৃহত্তর সামাজিক অবস্থায় মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা-বিভেদ-খুন আর বৈষম্যতাড়িত অবিবেচক রাষ্ট্রের এলোমেলো চকচকে পোশাকী অমানবিক জৌলস-ইত্যাদি।

সাতদিনঃ সাহত্যিরে বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শ্ত্রুকে কি ভাবে মূল্যায়ন করনে?
গোলাম কিবরিয়া পিনুঃ বন্ধু শত্রু হয়ে যায়- দেখলাম! তবে- বহু বন্ধু বহুদিন বন্ধু থেকেছে- এখনো তারা বন্ধু হিসেবে আছে। অল্প সময়ে- অল্প সম্পর্কের ভালো বন্ধু পেয়েছি অনেক। বন্ধু শত্রু হয়ে গেলে তা বেদনার অতলে নিয়ে যায়, আর তা হয়ে ওঠে অসহ্য। বন্ধু ও শত্রু হওয়ার পিজনে বহু কার্য-করণ লুকিয়ে থাকে, তা এখনকা র সমাজ-বাস্তবতায় আরও জটিল হয়েছে। তবু, মানুষের হাত ধরেই চলতে হবে, বন্ধু ভেবে মানুষকে কাছে টানতে হবে।

গোলাম কিবরিয়া পিনু, মূলত কবি। প্রবন্ধ, ছড়া ও অন্যান্য লেখাও লিখে থাকেন। গবেষণামূলক কাজেও যুক্ত। ইতোমধ্যে তাঁর ২০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। গোলাম কিবরিয়া পিনু-এর জন্ম ১৬ চৈত্র ১৩৬২ : ৩০মার্চ ১৯৫৬ গাইবান্ধায়। শিক্ষাগত যোগ্যতা : স্নাতক সম্মান (বাংলা ভাষা ও সাহিত্য) এবং স্নাতকোত্তর; পিএইচ.ডি. ।
জাতীয় কবিতা পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন সংগঠন থেকে পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য প্রয়োজনে কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছেন। পেশাগতভাবে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকতা, কলামলেখা, সম্পাদনা ও এডভোকেসি বিষয়ক কর্মকান্ডে যুক্ত থেকেছেনবর্তমানে একটি সংস্থার সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকায় কর্মরত। প্রকাশিতগ্রন্থের সংখ্যা কুড়ি।

==================
কোন শর্তেই লেখালিখি ছাড়তে পারব না

সাতদিন: নিজের লেখালেখিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
বারীন ঘোষালঃ পাঠকরাই আমার লেখার মূল্যায়ন করেন। আমি সেই মূল্যায়নকে সাদরে গ্রহণ করে নিজেকে শোধন করি বা করি না। এটাই আমার নিরীক্ষার ফল। পাঠকদের প্রতিক্রিয়াকে আমি লিটমাস টেস্ট মনে করি।

সাতদিন: বাংলা সাহিত্যের কোন শাখা তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন?
বারীন ঘোষালঃ আমি প্রাথমিকভাবে ছিলাম একজন গল্পকার। ১৩ বছর বয়সে পড়িপন্ডিত নেহেরুকে তাঁর ছোটবেলায় বাবা একটা কলমের জন্য মিথ্যার আশ্রয় না দেবার শিক্ষা কিভাবে দিয়েছিলেন। সেটা আমি বাংলায়ন করি অর্থাৎ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নতুন চরিত্র আর অবস্থানে গল্পটির পুনর্বিন্যাস। সেটি কলকাতার ছোটদের পত্রিকা শুকতারা-তে ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হলে আমি প্লেগিয়ারিজম ছেড়ে স্বকপোলকল্পিত গল্প লেখায় আগ্রহ পেয়েছিলাম। আমার প্রথম বই কবিতার। নাম সুখের কালক্রম ও সমুজ্জ্বল দুঃখ। ১৯৬৮-তে কৌরব সংগঠিত হলে ধীরে ধীরে আমি কবিতায়  মনোনিবেশ করতে থাকি গল্পের সাথে সাথে। তখন ধ্রুপদী বাংলায় কবিতা লিখতাম আর আঞ্চলিক ভাষায়। বিভিন্ন ছন্দ অভ্যাস করতাম। তাই ওই রকম নাম। আমাদের মধ্যে কমল চক্রবর্তী ব্যাপারটা প্রথম হাইলাইট করে। বইটি প্রকাশকালে খুব উৎফুল্ল ছিলাম। কমলের রিঅ্যাকশনে চুপসে যাই।












সাহিত্য কখনো জীবনে প্রতি
ফলিত হয় না। 
.........


সাতদিন: নিজের লেখালেখিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
বারীন ঘোষালঃ পাঠকরাই আমার লেখার মূল্যায়ন করেন। আমি সেই মূল্যায়নকে সাদরে গ্রহণ করে নিজেকে শোধন করি বা করি না। এটাই আমার নিরীক্ষার ফল। পাঠকদের প্রতিক্রিয়াকে আমি লিটমাস টেস্ট মনে করি।

সাতদিন: বাংলা সাহিত্যের কোন শাখা তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন?
বারীন ঘোষালঃ আমি প্রাথমিকভাবে ছিলাম একজন গল্পকার। ১৩ বছর বয়সে পড়ি, পন্ডিত নেহেরুকে তাঁর ছোটবেলায় বাবা একটা কলমের জন্য মিথ্যার আশ্রয় না দেবার শিক্ষা কিভাবে দিয়েছিলেন। সেটা আমি বাংলায়ন করি অর্থাৎ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নতুন চরিত্র আর অবস্থানে গল্পটির পুনর্বিন্যাস। সেটি কলকাতার ছোটদের পত্রিকা শুকতারা-তে ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হলে আমি প্লেগিয়ারিজম ছেড়ে স্বকপোলকল্পিত গল্প লেখায় আগ্রহ পেয়েছিলাম। আমার প্রথম বই কবিতার। নাম সুখের কালক্রম ও সমুজ্জ্বল দুঃখ। ১৯৬৮-তে কৌরব সংগঠিত হলে ধীরে ধীরে আমি কবিতায়  মনোনিবেশ করতে থাকি গল্পের সাথে সাথে। তখন ধ্রুপদী বাংলায় কবিতা লিখতাম আর আঞ্চলিক ভাষায়। বিভিন্ন ছন্দ অভ্যাস করতাম। তাই ওই রকম নাম। আমাদের মধ্যে কমল চক্রবর্তী ব্যাপারটা প্রথম হাইলাইট করে। বইটি প্রকাশকালে খুব উৎফুল্ল ছিলাম। কমলের রিঅ্যাকশনে চুপসে যাই।

সাতদিন: বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
বারীন ঘোষালঃ বাংলা সাহিত্যে কবিতা আর প্রবন্ধ সাহিত্য তুলনামূলক ভাবে সমৃদ্ধতর। বাংলা কবিতা তো পৃথিবীর যে কোন ভাষায় সমকক্ষ। বরং এগিয়ে বলা যেতে পারে। বাংলা ভাষায় যত তরুণ কবিতা লেখে আর কোথাও এমন না।

সাতদিন: বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
বারীন ঘোষালঃ সাহিত্য কখনো জীবনে প্রতিফলিত হয় না। জীবনই প্রতিফলিত হয় সেখানে, সাহিত্য যেন আয়না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে কাব্যসাহিত্য যথেষ্ট প্রণোদিত হয়েছে। কিন্তু গদ্যসাহিত্য স্তিমিত হয়ে পড়েছে সময়ের চাপে, সংবাদ সাহিত্যের চাপে, অন্যতর বিকর্ষণের চাপে, উপার্জনের চাপে, সর্বোপরি কলমের বদলে কম্পুটারের আগ্রাসনের চাপে।

সাতদিন: আপনার নিজের প্রিয় লেখা কোনটি এবং কেন?
বারীন ঘোষালঃ আমার প্রিয় লেখক সম্পর্কে কিছু বলাটা প্রহসন হয়ে দাঁড়াবে। ছেলেবেলা থেকে আমার আদর্শ বা প্রিয় পুরুষ বা হিরো ক্রমাগত বদল হয়ে চলেছে যেমন, সাহিত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বীরেন চট্টোপাধ্যায়, স্বদেশ সেন, ইত্যাদি, বিভিন্ন কালে আমার বয়সের সাথে বিভিন্ন জন প্রিয় কবির মর্যাদায়। তাদের সম্পর্কে কিছু বলা অবান্তর হবে।

সাতদিন: আপনার লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা কী?
বারীন ঘোষালঃ আমার নিজের লেখা কবিতাগুলোই আমার প্রিয় লেখা কারণ তারা আমার সন্তানের মতো। আমারই ভাবনা চিন্তা মননের ফল সব।
সৃষ্টিকর্তা যেমন কোন প্রেরণা ছাড়াই সৃষ্টি করে যান তেমনি অন্তরের চাপে আমার লেখা সৃষ্টি হতে থাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। তাতে কোন প্রেরণার প্রয়োজন নেই। বস্তুবিশ্বের মেটিরিয়াল গেইন, খ্যাতির আকাঙ্খা ইত্যাদি কোন প্রেরণা আমাকে প্ররোচিত করে না। তা লেখককে সর্বস্বান্ত করে বলে আমি 'প্রেরণা পুড়িয়ে ফেলি' লিখেছিলাম কবিতায়।

সাতদিন: শর্তসাপেক্ষে লেখালেখি ছেড়ে দিতে বললে কি ছাড়তে পারবেন?
বারীন ঘোষালঃ কোন শর্তেই লেখালিখি ছাড়তে পারব না। ভেতরের চাপে উগলে আসবেই। যেদিন শারীরিকভাবে অসমর্থ হবো, পাগল হয়ে যাবো।

সাতদিন: একজন লেখকের ভেতরের মানুষসত্তাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
বারীন ঘোষালঃ মনুষ্যসত্তা সাধারণ মানুষ বা লেখক সবারই আছে। প্রাথমিকভাবে আমি সবাইকেই এক লেভেলে দেখি। সহজ সরল মাটির মানুষ সবাই। মাটি থেকে এসেছে, মাটিতে মিশে যাবে। তার মধ্যে মাৎসর্যের প্রকাশ দেখলে অপ্রস্তুত হই ক্ষণকালের জন্য। মনুষ্যসত্তা ভালবাসার কাঙ্গাল। তারা পৃথিবীর ভালই চায়। সুযোগ পেলেই ভাল কাজ করে। পৃথিবীর সমাজের কালে কালে উন্নতি হয় এজন্যই।

সাতদিন: মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
বারীন ঘোষালঃ মৃত্যু এলে দেখে বলব। আমার মৃত্যু আর আমার বাবার মৃত্যু এক নয়। মৃত্যু আমাকে স্মরণ করায় মানুষের নশ্বরতা। অহমিকা থেকে উদ্ধার করে। অপরের জন্য বেঁচে থাকতে শেখায়। জীবনকে ভালবাসতে বলে। আমার মৃত্যুর সময় এসব মনে পড়বে না। পৃথিবীকে ছেড়ে যাবার সময় ঈশ্বরকে স্মরণ করব হয়ত।

সাতদিন: লেখালেখি ছাড়া আর কী আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয়?
বারীন ঘোষালঃ লেখালিখি ছাড়া আমার কাছে প্রিয় বই পড়া, ঘুরে বেড়ানো, কবিদের সাথে আড্ডা মারা, মদ খাওয়া, আর গাছ লাগানো, স্কুল চালানো ইত্যাদি। দেখঃ www.bhalopahar.com   নামের একটি NGO’র আমি সভাপতি। সেখানে ব্যস্ত থাকি।

সাতদিন: সাহিত্যের বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শ্ত্রুকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
বারীন ঘোষালঃ বন্ধু আর শত্রুর মূল্যায়ন আমি করি না। সবাইকেই বন্ধু ভাবি। দেহমনের তরঙ্গ যার সাথে মেলে তার সাথে ঘনিষ্ঠ হই। মিশি।

 ---------------
  জীবনে ভোগের চেয়ে আদর্শের স্থান অনেক উঁচুতে

ওবায়েদ আকাশ

সাতদিন: নিজের লেখালেখিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
ওবায়েদ আকাশ: নিজের লেখালেখিকে যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজে মূল্যায়ন করা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই লেখালেখির কোনো সার্থকতা নেই টি এস এলিঅট, এজরা পাউন্ড এই ধারার পক্ষে ছিলেন আরো অনেকেই এই পথকে সমীহ করেছেন, এখনও করেন আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে, আমি কতটুকু আলাদা হতে পারলাম সেটা আমি ছাড়া আর অন্য কারো এত ভালো করে জানবার কথা নয় আমার লেখা সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হলো: আমার লেখালেখির দায় সম্পূর্ণ আমার আমি দুর্বোধ্যতা এবং স্টান্ডবাজির মোড়ক লাগিয়ে পাঠকের ওপর দায় চাপাতে আগ্রহী নই আমার কবিতা যদি শব্দের ব্যবহারে বা বক্তব্যের উপস্থাপনায় দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে- সে দায় আমার সম্পূর্ণ নিজস্ব আমি ব্যক্তিজীবনের চেয়ে বেশি আমার সাহিত্যকে সৎচিন্তা দ্বারা হয়ে গড়ে তুলতে চেষ্টা করি আমি মনে করি, ব্যক্তি ওবায়েদ আকাশের চেয়ে তার সাহিত্য অনেক বেশি কমিটেড, অনেক বেশি সৎ আমার সাহিত্য নিরাপোসী এখানে নানান জনে না প্রশ্ন তুলতে পারেন কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে আমি একটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে যেমন আমি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি, কর্তৃপক্ষের কথা মতো কাজ করতে হয় কিন্তু আমার সাহিত্য কারো চাকরি করে না তাকে কারো কথাও শুনতে হয় না সে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠে আর আছে তৃপ্তি-অতৃপ্তির ব্যাপার সাহিত্য সময়ান্তরে তৃপ্তিকর এবং অতৃপ্তিকর ব্যাপার সাহিত্য পাঠ মুডের ওপর নির্ভর করে প্রেক্ষাপট সময়ের ওপর নির্ভর করে আমার সাহিত্য নিয়ে আমার অতৃপ্তি আছে আবার স্বাতন্ত্র্যের অহঙ্কারও আছে যা আমার ব্যক্তিগত নয় সেটা সম্পূর্ণই আমার কবিতার ব্যাপার আমি অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছি সাহিত্য কারো মোসাহেবী বা অন্ধ দলবাজিকে প্রশ্রয় দেয় না সাহিত্য নিভৃতের ব্যাপার যে যত বন্ধুহীন, যে যত নিভৃত তার সাহিত্য ততবেশি গণমুখী যে যত একা সে তত বড় লেখক যিনি নিজস্ব লেখার ক্ষমতা অনুভব করতে পারেন, তিনি কখনো মিডিয়ার দিকে, দলের দিকে চাতকের মতো তাকিয়ে থাকেন না কিন্তু আজকাল তরুণদের মধ্যে দেখা যায় উল্টোটা লিখতে আসার আগেই নিজের গায়ে একটা দশকের তকমা লাগিয়ে নেয়, তারপর দল খোঁজে যে কোন দলটা বড়, তারপর দেখে কোন দলের অধীনে কোন কোন বড় মিডিয়া সেই অনুযায়ী তারা দলভুক্ত হয়ে সাহিত্য করে তারা লেখার চেয়ে নিজেদেরকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে জীবনে যাদের একটি লেখাও পড়িনি, দুইয়ে দুইয়ে চারদিন যাদের সাহিত্যের বয়স, দলবাজি আর ধান্ধাবাজিতে তাদের নাম শীর্ষে উঠে আসে পরের জেনারেশন আবার তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মরীচিকার দিকে ছুটে যায় আমার সৌভাগ্য হলো এমন কিছু আমাকে কখনো গ্রাস করেনি আমি কবিতা লিখেছি জেনে-বুঝে কারো মোসাহেবী করতে হয়নি কখনো কোনো দলভুক্তও হতে হয়নি এখন চেষ্টা করছি আরও নিভৃত হওয়ার আরও একাকী হওয়ার
 

সাতদিন: বাংলা সাহিত্যের কোন শাখা তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন?
ওবায়েদ আকাশ: যে ভাষায় জীবনানন্দ দাশ কবিতা লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটগল্প-নাটক-গান-প্রবন্ধ লিখেছেন, মানিক-বিভূতি-ওয়ালীউল্লাহ উপন্যাস লিখেছেন, নজরুল ইসলাম গান এবং কবিতা লিখেছেন সেই ভাষার সাহিত্যের কোন শাখাটি দুর্বল, বলা মুশকিল তবে সমসাময়িক বাংলা কবিতা বিশ্বমানের এতে কোনো সন্দেহ নেই 
শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রফিক আজাদ, শহীদ কাদরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, সিকদার আমিনুল হক, আবুল হাসান প্রমুখ বিশ্বখ্যাত কোনো কবির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কবি নন তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহসহ কমলকুমার, ইলিয়াস, অমিয়ভূষণ, সতীনাথ, হাসান আজিজুল হক, শহীদুল জহির প্রমুখ লেখকের লেখা অন্য যে কোনো ভাষার উপন্যাস বা ছোটগল্পের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়


সাতদিন: বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে
ওবায়েদ আকাশ: বিজ্ঞান প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাহিত্যের উৎকর্ষের পাশাপাশি হাঁটে সাহিত্যিকরা আবেগতাড়িত বটে, তবে সেই আবেগ আগামী দিনের বিজ্ঞান বা বাস্তবতা তাই, সাহিত্যিক যেটা আগে বুঝতে পারেন, বিজ্ঞান কিছুদিন পরে সেই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে জনসমক্ষে তার বাস্তবতা উন্মোচন করেন বিজ্ঞানের আবিষ্কার শত শত বছর ধরে চলছে, আগামীতেও চলবে সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞানের বিরোধ হলো ইমোশনের সঙ্গে বাস্তবতার কিন্তু তা- সময়ান্তরে একই মোহনায় মিলে যায় আধুনিক সচেতন মানুষের জন্য একটা অন্যটার পরিপূরক সত্যিকারের পাঠক কখনো বলতে পারেন না, ‘শালিশ মানি কিন্তু তালগাছ আমারতিনি যত পড়েন, ততই তার চিন্তায় পরিবর্তন আসে সত্যিকারের লেখক একজন ভাল পাঠকও বিজ্ঞানের বেলায়ও তাই বৈজ্ঞানিক নিরন্তর নব নব আবিষ্কারের পিছনে ছোটেন বিজ্ঞান প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাহিত্যের পাঠককে আরও সহজে, আরও জানার পরিধি উন্মুক্ত করে দেবে

সাতদিন: আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
ওবায়েদ আকাশ: আমার প্রিয় লেখক তো আর একজন নয় নানা শাখায় অনেকে প্রত্যেকের নাম উল্লেখ করে করে বলতে গেলে ফুরোবে না প্রিয় লেখকরা আছেন বলেই এখনো পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় লিখতে গেলে তাকে অতিক্রম করার বাসনা জাগে লিখতে বসে তার প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজের কণ্ঠস্বর নির্মাণের চেষ্টা করি কথায় বলে মানুষ তার আশা বা স্বপ্নের সমান উঁচু কিন্তু আমি বলি, একজন প্রকৃত লেখক তার প্রিয় লেখকের চেয়ে উত্তীর্ণ 

সাতদিন: আপনার নিজের প্রিয় লেখা কোনটি এবং কেন?
ওবায়েদ আকাশ: এভাবে না বলে আপনি যদি বলেন, আপনি আপনার অমুক লেখাটি অমুক বই থেকে বাদ দিয়ে দেন, তখন আসল ব্যাপারটা বোঝা যাবে যদি গড়পড়তা বলি তাহলে বলবো, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সমালোচক, সাহিত্যতাত্ত্বিক কিংবা ছান্দসিকরা আমার যে লেখাগুলোর বেশি প্রশংসা করেন, সব সময়ই দেখা গেছে আমার সেই লেখাগুলোর প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা নেই আবার দুর্বলতা আছে এমন কোনো কোনো লেখা তারা একেবারেই বাতিল করে দেন আমার সর্বশেষ লেখাটিই আমার সবচেবেশি প্রিয় এবং আগামীকাল বা পরশু যে লেখাটি লিখবো, সেটিই হবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা আর মৃত্যুর অন্তিম মুহূর্তে দাঁড়িয়েও বলবো: এবার বেঁচে গেলে আমি আমার শ্রেষ্ঠ লেখাটি শেষ করবো

সাতদিন: আপনার লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা কী?
ওবায়েদ আকাশ: আমার লেখালেখির মূল প্রেরণা, আমার মাতৃভূমির অভাবনীয় গ্রামীণ রূপময়তা, ছয় ঋতুর মাতাল উন্মাদনা তারপর আমার বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া মায়ের মুখ আর সাম্প্রতিক সময়ে বেশি করে প্রভাবিত করছে, মানুষের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস, উপকারীর প্রতি মানুষের অকৃতজ্ঞতাবোধ, মানুষের জীবন নাশ করে হলেও নিজে ভাল থাকার প্রয়াস, আর মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিক আচরণ, মাৎস্যন্যায়ের মতো ছোটর ওপর বড়র প্রভাব বিস্তার এই অসাম্প্রদায়িক ছবির মতো বাংলাদেশে যা একসময় ভাবাই যেত না 

সাতদিন: শর্তসাপেক্ষে লেখালেখি ছেড়ে দিতে বললে কি ছাড়তে পারবেন?
ওবায়েদ আকাশ: সময় এলে দেখা যাবে

সাতদিন: একজন লেখকের ভেতরেরমানুষসত্তাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
ওবায়েদ আকাশ: এলেন গীন্সবার্গের একটি কথাকে আমি শ্রদ্ধা করি তিনি বলেছেন: “যতক্ষণ না তুমি একজন ভাল মানুষ, ততক্ষণ না তুমি একজন ভাল কবিকবি সত্তাটা কিন্তু সব কিছুকে ছাড়িয়ে ব্যক্তি মানুষের ঊর্ধ্বে সে একটি আদর্শ, সে একটি চেতনার প্রতীক, সে অবাধ সৌন্দর্যের রূপকার, অগণিত মানুষের স্বপ্ন রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, পেশা-পদবি সব কিছুকে ছাড়িয়ে কবির স্থান তিনি একজন মৌলিক স্রষ্টা তিনি যে কোনো অসুন্দরকে সুন্দর করে তোলেন শব্দের যথার্থ প্রয়োগে তিনি ব্যকরণ বা প্রথাকে অস্বীকার করে নিজেই একটি মৌলিক আদর্শে রূপায়িত হন সুতরাং তার ব্যক্তিসত্তাকে অবশ্যই তাঁর কবিতার মতোই হতে হবে কবি কবিতার বাইরে জীবনযাপন করলে যে কেউ তাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন একজন ভাল কবি শিশুর মতোন রবীন্দ্রনাথ শিল্পীদেরকেবয়স্ক শিশুবলেছেন শিশুর মধ্যে অহঙ্কার নেই, ধূর্তামি নেই, কপটতা নেই, ধান্ধাবাজি নেই সেই সবসময় প্রাণবন্ত সে নিয়ম মানে না ইচ্ছে মতো এটা ভাঙে, ওটা ভাঙে তবু সবাই শিশুকে ভালবাসে কাছে টানে কবিও নিয়মের ফেরে আটকে থাকতে পারেন না তিনি যা খুশি তাই করেন কিন্তু তার সততা, ব্যক্তিত্ব এবং সর্বোপরি তার কবিতা দিয়ে মানুষের মন জয় করেন তাই কবির অন্তর্ধানে পৃথিবীর প্রকৃতি-মানুষে শোকের ছায়া নামে যদি কবি হতে চান মানুষের মন আপনাকে স্পর্শ করতেই হবে

সাতদিন: মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
ওবায়েদ আকাশ: দেহের অবসান বা নিথরতা প্রকৃত মৃত্যু নয় এটা দেহের সচলতা থেকে নিশ্চলতায় রূপান্তর আর আদর্শের মৃত্যু হলো প্রকৃত মৃত্যু অনেকে বলেন, যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণই বাঁচার সার্থকতা এটা ভোগবাদীদের কথা পুঁজিবাদ এই আদর্শে পৃথিবীকে নেশার্ত করেছে, মাতাল করেছে আমি মনে করি, জীবনে ভোগের চেয়ে আদর্শের স্থান অনেক উঁচুতে জীবন যাপনের ভেতর দিয়ে এমন একটি আদর্শ রেখে যেতে হবে যার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক ভ্রষ্টমানুষ পথের দিশা খুঁজে পাবে সেক্ষেত্রে আমার বেঁচে থাকার দরকার নেই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থপূর্ণ করে যেতে হবে জীবনের সার্থকতা অর্জনের জন্য খুব বেশি সময় বেঁচে থাকার দরকার নাই পৃথিবীর অসংখ্য আদর্শ ব্যক্তিত্ব তিরিশ কিংবা চল্লিশের কোটা না পেরুতেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন কিন্তু তাঁরা আমাদের কাছে এখনও আদর্শরূপে বেঁচে আছেন, তাঁদের কাজ আমাদের অনুপ্রাণিত করে তারা যদি স্বার্থবাদী বা ভোগবাদী হতেন; আজ আমাদের মগজে তাঁদের ঠাঁই হতো না তাঁরা মরেও ত্যাগী সংযমী কারণ তাঁদের মৃত্যুর পর তারা আমাদের যা দিয়ে গেলেন, তাঁর প্রতি কোনো স্বত্ব দাবি করছেন না আকাশের নক্ষত্র হয়ে তাঁরা আমাদের আলোকিত করছেন, আর তারা নিজেরা জ্বলছেন নক্ষত্র চিরদিন জ্বলে, তার মৃত্যু নাই

সাতদিন: লেখালেখি ছাড়া আর কী আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয়?
ওবায়েদ আকাশ: আড্ডা আর ভ্রমণ আমার প্রিয় বিষয় প্রিয় আমার সন্তানের মুখ অতীব প্রিয় বড় মানুষের সান্নিধ্য প্রিয় আমার প্রেমিকার সান্নিধ্য আবার কখনো প্রিয়, প্রিয় রমণীর সান্নিধ্য প্রিয় নিজের দেশ-মাটি দেশের মানুষের সহজ-সরলতা আর সবচেপ্রিয় আমার স্বাধীনতা

সাতদিন: সাহিত্যের বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শ্ত্রুকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
ওবায়েদ আকাশ: এতকাল বন্ধু এবং শত্রুদের মধ্যে একটা বিভাজন ছিল, একরকম এখন অন্যরকম কারণ এতদিনে আমি বুঝে গেছি, তারাই আমার শত্রুতা করেছে এতকাল, যারা আমার সমান কাজ করতে পারছে না আমি ওদের চেয়ে ভাল এবং বেশি কাজ করেছি বলেই ওরা আমার শত্রুতে পরিণত হয়েছে তাছাড়া আমি তো দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, আমি এমন কোন কাজ করিনি যে কেউ আমার শত্রু হতে পারে আমি তো সারাক্ষণই কবিতা এবং সম্পাদনা নিয়ে থাকি আমি তো কারো লেখার বিষোদগার করি না ওরা কেন আমার পায়ে পাড়া দিয়ে আমার শত্রুতা করে? দীর্ঘ পরিভ্রমণের শেষে দেখলাম, ওরা আমার শত্রু নয়, ওরা আমার ঈর্ষাকাতর বন্ধু যেমন আমি যখনএইচএসবিসি-কালি কলম পুরস্কারপেলাম ২০০৮ সালে, ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কারপেলাম ২০০৯ সালে, চোখের সামনে দেখলাম আমার একদল বন্ধু শত্রুতে পরিণত হলো, আবার যখন ২০১২ সালে ইংল্যান্ডে গেলাম একটা কবিতার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, দেশে ফিরে দেখলাম, অনেক বন্ধুই আর মন খুলে কথা বলে না আর সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা তো আপনারা সবাই জানেন আমার বাংলা একাডেমি থেকে নির্বাচিত কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর অতি কাছের বন্ধুরাও কেমন গোখরা সাপের মতো ফণা তুলল পত্রিকায় বিবৃতি দিল, কবি হিসেবে আমাদের নাকচ করে দিল আমি শুধু অবাক হয়ে দেখলাম, আর ওদের প্রতি আমার মায়া জন্মাতে লাগল আমি ওদেরকে খুব করুণা করতে শিখলাম এখনো ওরা আমার করুণার পাত্র আমি যা লিখেছি, তার দশ ভাগের একভাগ ওরা লিখেছে কিনা সন্দেহ কী মানে কী সংখ্যায়- আমি আমার কবিতার ব্যাপারেবিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনি তবে ওদের দ্বারা আমি খুব উপকৃত হই আমার সাহিত্যিক কাজগুলো এমনভাবে করি, এবং এমন নির্ভুলভাবে করতে চাই, যে, ওরা যেন আমার কাজের কোনো ভুল ধরতে না পারে আমি আজকাল আমার সব শত্রুদের ক্ষমা করে দেই, কিন্তু আমার দেশের শত্রু যারা, তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা করি
আর আমার বন্ধু তো বন্ধুই বন্ধুদের নিয়ে একটাই সমস্যা তারা আমার ভাল মন্দ সব কাজের প্রশংসা করে এজন্য আমি প্রায়শ বন্ধুদের পরামর্শ গ্রহণে নিরত থাকি তবে প্রাণ খুলে আড্ডা দিতে, নিজের জীবনের সুখ-দুঃখ শেয়ার করতে বন্ধুর তুলনা কোথায়?

***
ওবায়েদ আকাশের সংক্ষিপ্ত পরিচিতঃ ওবায়েদ আকাশের জন্ম ১৯৭৩ সালের ১৩ জুন, বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার সুলতানপুর গ্রামে একাডেমিক পড়াশোনা বাংলা ভাষা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পেশা সাংবাদিকতা বর্তমানে দেশের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকাদৈনিক সংবাদ’- সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন 
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ>কাব্যগ্রন্থ : পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোতা চাঁদ (বর্তমান সময়, ২০০১), নাশতার টেবিলে প্রজাপতিগণ (মঙ্গলসন্ধ্যা, ২০০৩), দুরারোগ্য বাড়ি (মঙ্গলসন্ধ্যা, ২০০৪), কুয়াশা উড়ালো যারা (বিশাকা, ২০০৫), পাতাল নির্মাণের প্রণালী (আগামী, ২০০৬), তারপরে, তারকার হাসি (আগামী, ২০০৭), শীতের প্রকার (বৃক্ষ, ২০০৮), ঋতুভেদে, পালকের মনোবৃত্তিগুলি (কাব্য সংকলন, বৃক্ষ, ২০০৯), বিড়ালনৃত্য, প্রেতের মস্করা (শুদ্ধস্বর, ২০০৯), যা কিছু সবুজ, সঙ্কেতময় (ইত্যাদি, ২০১০), স্বতন্ত্র ৬০টি কবিতা (কাব্য সংকলন, বৃক্ষ, ২০১০), প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায় (ইত্যাদি, ২০১১), ওবায়েদ আকাশের কবিতা আদি পর্ব (কাব্য সংকলন, জনান্তিক, ২০১১), শুশ্রƒষার বিপরীতে (ধ্রুবপদ, ২০১১) এবং রঙ করা দুঃখের তাঁবু (ইত্যাদি, ২০১২), বিবিধ জন্মের মাছরাঙা (দীর্ঘ কবিতার সংকলন, ইত্যাদি, ২০১৩), তৃতীয় লিঙ্গ (দীর্ঘ কবিতার সংকলন, শুদ্ধস্বর, ২০১৩), উদ্ধারকৃত মুখম- (বাংলা একাডেমি কর্র্তৃক প্রকাশিত নির্বাচিত কাব্য সংকলন, ২০১৩), হাসপাতাল থেকে ফিরে (কলকাতা, উদার আকাশ, ২০১৪), ৯৯ নতুন কবিতা (ইত্যাদি, ২০১৪), বর্ষণসিক্ত হাসপাতাল (বৃক্ষ, ২০১৪)। অনুবাদ:ফরাসি কবিতার একাল / কথারা কোনোই প্রতিশ্রতি বহন করে না’ (ফরাসি কবিতার অনুবাদ, জনান্তিক, ২০০৯) ‘জাপানি প্রেমের কবিতা / এমন কাউকে ভালবাস যে তোমাকে বাসে না’ (জাপানি প্রেমের কবিতা, জনান্তিক, ২০১৪)
গদ্যগ্রন্থ: ‘ঘাসের রেস্তরাঁ’ (বৃক্ষ, ২০০৮); ‘লতাপাতার শৃঙ্খলা’ (ধ্রুবপদ, ২০১২); চারদিকে উদ্যানের সৌরভ (ধ্রুবপদ, গল্পগ্রন্থ, ২০১৪) । সম্পাদনা গ্রন্থ:দুই বাংলার নব্বইয়ের দশকের নির্বাচিত কবিতা’ (শিখা, ২০১২)
সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন: শালুক (১৯৯৯-) পুরস্কার:শীতের প্রকারকাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেনএইচএসবিসি-কালি কলম তরুণ কবি পুরস্কার২০০৮; ‘শালুকসম্পাদনার জন্য পেয়েছেনকলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার২০০৯; ২০১২ সালে লন্ডন থেকে পেয়েছেনসংহতি বিশেষ সম্মাননা পদক’; ‘বিশেষ সম্মাননা সংবর্ধনা: রাজবাড়ী জেলা প্রশাসন’, ২০১৪

-------------------------------
ভালো মানুষ না হলে বড় মাপের লেখক হওয়া যায় নাঃ জাহানারা পারভীন


সাতদিন:  নিজের লেখালেখিকে আপনি কি ভাবে মূল্যায়ন করেন?
জাহানারা পারভীনঃ আমি আসলে চেষ্টা করে যাচিছ। কিছু একটা বলার। সময়, সমাজ সমকাল ও আমার নিজের জীবনের পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে নিজের বিশ্বাস উপলব্ধির কথা বলার চেষ্টা করছি। লেখালেখি একটা অনেক বড় প্রক্রিয়া। লেখক হযে ওঠাও একটা পুরো জীবনের বিষয়। দীর্ঘ ভ্রমন। লেখালেখি একটা পুরো জীবন দাবি করে। এই পুরো জীবনের ভ্রমনের পরও লেখকের মনে অতৃপ্তি থাকে সেরা লেখাটা লিখতে না পারার। তবে আমার নিজের লেখা বিশেষ করে কবিতা নিয়ে সে সাড়া পাঠক, সমালোকচদের কাছ থেকে আমি পেয়েছি তাতে আমি আশাবাদী। আসলে নিজের লেখার মূল্যায়ন নিজে করা মুশকিল। সেটা পাঠকের হাতে ছেড়া দেয়াই ভাল। পাঠাকই বাচিয়ে রাখেন লেখককে। তবে এটুকু বলতে পারি, আমার লেখালেখির যে ভ্রমণ তার তুলনায় যে সম্মান আমি পেয়েছি যা পাচ্ছি তাতে আমি অভিভূত।  কবি রবার্ট ফ্রষ্টের মত করে আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ.....

সাতদিন: আপনার প্রথম লেখা এবং প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
জাহানারা পারভীনঃ প্রথম কবিতা লেখা শুরু করি এস এসসির পর। প্রথম কবিতাগুোলোর প্রায় সবই ছিল অন্তমিলে লেখা। সে সময় খুবি কিশোর ক্লাসিক পড়তাম। সেই প্রভাবে একটা রহস্যপোন্যাসও লিখে ফেলেছিলাম। পরে সে পান্ডুলিপি হারিয়ে যায়। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় নিজের সম্পাদিত কাগজে। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের সাথে মিলে সিদ্ধান্ত নেই একটা ছোটকাগজ প্রকাশের। প্রতিবেশী ছেলে মেয়েরা যারা একটু সৃষ্টিশীল, লিখছে, লিখতে চায় তাদের লেখা নিয়ে ১৬ ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় অম্লান। প্রেস থেকে যখন হাতে কপি এসেছেল অন্যরকম এক অনুভূতি হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জাতীয় দৈনিকে প্রকাশের সুযোগ আসে। প্রথম গ্রন্থ নোঙরের গল্প বাচাচিছ প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে। তখন পড়াশোনা শেষ করে যোগ দিয়েছি দৈনিক মুক্তকণ্ঠে। বইটির প্রকাশক বর্নায়ণ। তরুণ কবিদের প্রথম বই প্রকাশের যে তিক্ত অভিগ্গতা হয়ে থাকে তার তুলনায় আমার অভিগ্গতা ইতিবাচকই বলা চলে। কোনো দ্বিধা ছাড়াই একজন একজন তরুণ কবির প্রথম বই প্রকাশের দায়িত্ব নেন বর্নায়ণ প্রকাশনীর প্রকাশক লিয়াকত ভাই।  

সাতদিন: বাংলা সাহিত্যের কোন শাখা তুলনামুলক ভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন?
জাহানারা পারভীনঃ কবিতা বাংলা সাহিত্যের আদি শাখা। আমার মতে এখনো কবিতাই সাহিত্যের সবচে সমৃদ্ধ শাখা। পাশাপাশ ছোটগল্পের কথাও বলা যায়।

সাতদিন: বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
জাহানারা পারভীনঃ সাহিত্য মননের বিষয়। সৃজনশীলতার বিষয়। প্রযুক্তি জীবনকে যতটাই এগিয়ে নিয়ে যাক না কেন, মানুষের জীবনে সাহিত্যের আবেদন ফুরাবে না। যারা বলেন, মানুষ এক সময় আর প্রেস থেকে থেকে ছাপা হওয়া বই পড়বে না, পড়বে ই-বুক, তাদের সাথে আমি একমত নই। তবে পৃথিবীতে ধীরে ধীরে সাহিত্যের গন্ডি, পরিধি ছোট হয়ে আসছে। এখন ইন্টারনেট, ফেসবুক নির্ভরতার কারনে বইপাঠের অভ্যাস কমেছে। এখন আর কেউ চেঠি লেখে না। এস এম এস বা ইমেইল করে। মাঝে মাঝে মনে হয়, পৃথিবীর সেরাপত্রসাহিত্য গুলো কি সৃষ্টি হত যদি ১০০ বছর আগে ইমেইল বা এস এম এসের চল থাকত?  

সাতদিন: আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
জাহানারা পারভীনঃ প্রিয় লেখক অনেকেই। জীবনানন্দ দাশ আমার প্রিয় কবি।তার কবিতা যত পড়ি মুগ্ধ হই। আলোড়িত হই আক্রান্ত হই। সকল লোকের মাঝে বসে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি এক হতেছি আলাদা। সেই কৈশোরে এই কবিতা পড়ে আক্রান্ত হয়েছিলাম। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্নতার সেই শুরু। সবার মাঝে থেকেও, প্রবল ভিড়েও একলা থাকার যে অসুখের সূত্রপাত তার উপলব্ধি করেছিলাম জীবনানন্দের কবিতা পাঠের পর থেকেই।  

সাতদিন: আপনার নিজের প্রিয় লেখা কোনটি এবং কেনো?
জাহানারা পারভীনঃ আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ নিদ্রানমগ্র নিয়ে অনেক সাড়া, প্রতিক্রিয়া পেয়েছি পাঠকের। জার্মান কবি রাইনের মারিয়া রিলকেকে নিয়ে লেখা রিলকে: নৈশ্বব্দে ও নি:সঙ্গতায় বইটিকে নিয়েও পাঠক, সমালোচকের প্রশংসা পেয়েছি।আমার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ মা হাওয়ার সন্তান সে তুলনায় পাঠকের নজর এড়িয়ে গেছে বলে মনে হয়। বিভিন্ন ব্যস্ততার কারনে, ২০০৯ সালে বইটি প্রকাশের সময় আমি মাত্র ৫/৬ দিন বইমেলায় যেতে পেরেছি। হয়ত অনেকের মনযোগ দাবি করতে পারে এই বইটি। এই কাব্যগ্রন্থে জীবনবোধ, চিন্তার যে বহি:প্রকাশ তা অন্যগ্রন্থের চেয়ে আলাদা বলেই মনে হয় আমার।

সাতদিন: আপনার লেখালেখির পেছনে মূল প্রেরণা কি?
জাহানারা পারভীনঃ জীবনের শূন্যতা, অসঙ্গতি থেকে থেকে বেরিয়ে নিজের সৃস্টিশীলতাকে প্রকাশের ইচ্ছাই আমার লেখার মূল শক্তি।

সাতদিন: শর্ত স্বাপেক্ষে লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে বললে কি ছাড়তে পারবেন?
জাহানারা পারভীনঃ প্রকৃত লেখকের পক্ষে লেখা ছাড়া বাঁচা অর্থহীন। লেখার সাথে সাময়িক বিচ্ছেদ, দূরত্ব হয়ত তৈরী হতে পারে, কিন্তু লেখা ছাড়া তাও শর্তস্বপেক্ষে? লেখার সাথে লেখকের সম্পর্ক আত্মিক।

সাতদিন: এক জন লেখকের ভেতরের মানুষস্বত্তাকে আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করেন?
জাহানারা পারভীনঃ মনুষ্যত্ব আমার কাছে লেখকের অন্যতম পরিচয়। গুন। অনেক খ্যতিমান একজন লেখক যদি মনুস্যত্বহীন হন, বা তার খ্যাতির তুলনায় মানুষ হিসেবে বড় না হন, আমি আহত বোধ করি। চারপাশে অনেক খ্যাতিমান, প্রতিষ্ঠিত মানুষের ভিড়ে সত্যিকারের মানুষের সংখ্যা কম বলেই পৃথিবীটা এত অসুন্দর হয়ে আছে। আমি মনে বড় মানুষ না হলে বড় লেখক হওয়া যায় না। তবে খ্যাতিমান হওয়া যায়। এটি সহজ।

সাতদিন: মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
জাহানারা পারভীনঃ জীবনের শেষ পরিনতি মৃত্যু।  জন্মেছি যখন তখন মৃত্যু আসবেই। এটিকে আমি অনিবার্য পসঙ্গ প্রসঙ্গ হিসেবেই নিয়েছি। আমি এ নিয়ে ভীত নই। আমি জানি যেকানো মূহুর্তে মৃত্যু এসে থামিয়ে দিতে পারে সব। আতঙ্ক বা বিষাদে নয়, আমি এর জন্য সহজভাবেই প্রস্তুত।

সাতদিন: লেখালেখি ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয়?
জাহানারা পারভীনঃ লেখার বাইরে আমি সাংবাদিকতা করি। একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি আমার পেশাকেও ভালবাসি। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে দিয়ে ব্যস্ততার কারনে কখনো কখনো লেখালেখিতেও বিরতি এসেছে। মানুষের স্বার্থপরতা আমার ভাল লাগে না। সৎ, উদার মানুষদের শ্রদ্ধা করি সব সময়।  


সাতদিন: সাহিত্যের বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শ্ত্রুকে কি ভাবে মূল্যায়ন করেন
জাহানারা পারভীনঃ বন্ধুকে হাত বাড়িয়ে দেই। পাশে থাকার চেষ্টা করি। তবে আজকাল প্রকৃত বন্ধু পাওয়া বিরল। শত্রুদের অমঙ্গল চাই না। তবে দূরত্ব নিমার্ণের চেষ্টা করি তাদের সাথে। মানুষের বন্ধুতা এবং শত্রুতা এটি জীবনের দুই পিঠ। একে সহজভাবে মেনে নিতেই হবে। আমরা কেউ জানি না কখন তার শত্রুতার মুখোমুখি হতে হবে। আর কেউবা বা নতুন করে বন্ধুতার হাত বাড়িয়ে দেবে। তবে যারা আমার  বিরোধীতা করে আমার চলার পথে কাটা বিছিয়েছেন তাদের কাছ থেকেও শিখেছি। শিখেছি নির্লিপ্ততা, মৌনতা আর একলা চলার কৌশল। লেখক যতই সংবেদনশীল হোন না কেন, জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে সহজভাবে মেনে না নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। তবে আমার মাঝে মনেই হয়। যেন জন্মেছি ভূল সময়ে। এই স্বার্থপর,বাস্তবদাবী সমাজের উপযুক্ত নই যেন।

[জন্ম :৩০ মে ১৯৭৫, বাংলাদেশ। পেশা সাংবাদিকতা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: নোঙরের গল্প বাচাচ্ছি(২০০২) বর্নায়ণ। নিদ্রা সমগ্র (২০০৫) সময় প্রকাশন। মা হাওয়ার সন্তান (২০০৯) সময় প্রকাশন। জলবৈঠক(২০১০) সময় প্রকাশন। প্রবন্ধ :রিলকে নৈ:শব্দে ও নি:সঙ্গতায়।কবিতার জন্য পেয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃত্তিবাস পুরস্কার ২০১১,  জাতীয় কবিতা পরিষদের শামসুর রাহমান সস্মাননা (২০০৭), শ্বব্দগূচ্ছ পুরস্কার (২০১২), ছোটকাগজ চৈক্রসংক্রান্তি সম্মাননা (২০০৭)] 

-----------------
খিদে পায়, ঘুম পায়, পেচ্ছাপ পায়লেখা পায় লিখিঃ মলয় রায়চৌধুরী

* শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু আমার বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেছেন।

* আমি কিন্তু বই সংগ্রহ করি না ; বইয়ের লাইব্রেরি নেই আমার। বই আর পত্রিকা পড়া হয়ে গেলে বিলিয়ে দিই।

* মৃত্যু সম্পর্কে আমি বেশ কনফিউজড। আর বন্ধু বলতে যা বোঝায় তা আর আমার নেই। আমি বন্ধুহীন।



সাতদিন: নিজের লেখালিখির আপনি কি ভাবে মূল্যায়ন করেন?
মলয় রায়চৌধুরী: কোনো মূল্যায়ন করি না। যেমন খিদে পায়, ঘুম পায়, পেচ্ছাপ পায়, তেমন লেখা পায় বলে লিখি। খিদের যেমন মূল্যায়ন করি না, তেমনই লেখালিখির। মূল্যায়ন করতে হলে অন্যের ধরে থাকা আয়না দরকার। আমি তো নিজের জন্য অন্যের আয়নার প্রয়োজন বোধ করি না।

সাতদিন: আপনার প্রথম লেখা এবং প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
মলয় রায়চৌধুরী: আমার প্রথম লেখা দুটি কবিতা, প্রকাশিত হয়নি, কেননা সে দু’টি ছিল প্রেমানুভূতি; একটি বাংলায়, স্কুলের উঁচু ক্লাসের সহপাঠিনী নমিতা চক্রবর্তীকে, যিনি আমার রাহুকেতুউপন্যাসে সুমিতাদি; আরেকটি ইংরেজিতে, চুম্বনের দাম হিসাবে, স্নাতকস্তরে নেপালি সহপাঠিনী ভূবনমোহিনী রাণাকে, ‘রাহুকেতুউপন্যাসের রাণো। প্রথম প্রকাশিত লেখা ইংরেজিতে  ১৯৬১ সালের নভেম্বরে হাংরি ম্যানিফেস্টো, বাংলায় এপ্রিল ১৯৬২তে হাংরি ম্যানিফেস্টো। যে উথালপাথাল ঘটিয়ে ছিল তা কল্পনাতীত। সম্ভবত হ্যাণ্ডবিলের মতন বিলি করা কাগজে তখনও পর্যন্ত সাহিত্য করার কথা ভাবা হয়নি, আর হ্যাণ্ডবিলের মতন ছিল বলে দ্রুত পৌঁছে যেতে পেরেছিল সর্বত্র। প্রথম বই ছিল মার্কসবাদের উত্তরাধিকারযে বইটি প্রকাশিত হবার পর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উল্টোডাঙার বস্তিবাড়ির সামনে পেটরল ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছিলুম। বইটা বের করার ভার দিয়েছিলুম শক্তিদাকে; উনি ম্যাসাকার করে দিয়েছিলেন, কাউকে দিয়ে প্রূফ দেখাননি, নিজে দেখেননি, অত্যন্ত বাজে কাগজে ছাপিয়েছিলেন এবং পুরো পাণ্ডুলিপি কমপোজ করাননি। আমার উপন্যাস রাহুকেতুতে আমি ঘটনাটা দিয়েছি। তার পরের বই, যাকে প্রকৃত অর্থে বলা যায় পাঠকের হাতে পৌঁছে দেয়া বই, তা হল কৃত্তিবাসথেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্হ শয়তানের মুখ’,  প্রকাশক ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বইটি এবং আমাকে নিয়ে কলকাতায় হইচই হচ্ছে জেনে তিনি আমেরিকা থেকে ১৩ জুন ১৯৬৪ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, “আপনি মলয়কে এত পছন্দ করছেন- কিন্তু ওর মধ্যে সত্যিকারের কোনো লেখকের ব্যাপার আছে আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে বিশ্বাস করেন না।আবার কলকাতা ফিরে যখন দেখলেন যে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু আমার বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেছেন, তখন উনি তুরুপের তাসটি খেলে আমার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেলেন! জীবনের এমনতর ঘটনাকে কী বলবেন?

সাতদিন: বাংলাসাহিত্যের কোন শাখা তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন?
মলয় রায়চৌধুরী: কবিতা তো অবশ্যই, এবং প্রবন্ধ। কবিতা লেখার জগতটা কারোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকছে না, কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক কলকাঠি নাড়া সত্ত্বেও। আর এখন ইনটারনেট হয়ে এলাকাটা সম্পূর্ণ স্বাধীন; শব্দ, বাক্য, ছন্দ, বিন্যাস নিয়ে যথেচ্ছ বিস্তার ঘটিয়ে চলেছেন তরুণ কবিরা, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় যে কবিতা লেখা হচ্ছে, যেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ পড়ার সুযোগ পাচ্ছি, তার পাশে বাংলা কবিতাকে রাখলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়। গল্প-উপন্যাস এখনও বিষয়নির্ভর হয়ে রয়েছে, আলোচকরা গপপো নিয়ে চিন্তিত, যেকারণে আমরা জয়েস, প্রুস্ত, কাফকা, ফকনার, মার্কাজের মতন গদ্যশিল্পী পাইনি; গল্প-উপন্যাসের বাংলা গদ্য এখনও ইউরোপীয় ভাষাগুলোর স্তরে তাই পৌঁছোয়নি।

সাতদিন: বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে?
মলয় রায়চৌধুরী: প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারলুম না। জীবনের প্রতিফলন সাহিত্যে? নাকি সাহিত্যের প্রতিফলন জীবনে? পশ্চিমবঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এমনই হাল যে ভালো ফলাফল করলেই ছাত্ররা রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে পালান, তারপর বিদেশে পালান।

সাতদিন: আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
মলয় রায়চৌধুরী: সারা জীবন কেবল একজন তো আর প্রিয় লেখক হতে পারেন না ; বয়সের সঙ্গে, পাঠ-অভিজ্ঞতার সঙ্গে যাঁদের লেখার প্রতি আকর্ষিত হয়ে্ছি, তাঁরা পালটে যেতে থেকেছেন। তবে কিছুকাল আগে যে বই দুটো আমি বহুবার পড়েছি তা হল ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচুডএবং পামুকের রেড। আমি কিন্তু বই সংগ্রহ করি না ; বইয়ের লাইব্রেরি নেই আমার। বই আর পত্রিকা পড়া হয়ে গেলে বিলিয়ে দিই। আমার কোনো স্টাডিরুম, লেখার টেবিল, পড়ার ঘর জাতীয় ব্যাপার নেই। আর আজকাল তো কাগজ-কলমও ব্যবহার করি না। যাঁরা বাড়িতে সাক্ষাৎকার নিতে আসেন, তাঁদের পিলে চমকে যায়

সাতদিন: আপনার নিজের প্রিয় লেখা কোনটা এবং কেন?
মলয় রায়চৌধুরী: নখদন্তনামে একটি সাতকাহন। রামায়ণ থেকে সাতকাহনের আইডিয়া আর মহাভারত থেকে গল্পের ভেতরে গল্পের ভেতরে গল্প টেকনিক প্রয়োগ করেছি, সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত রোজনামচার টুকরো-টাকরা, আর পশ্চিমবাংলায় পাট চাষ-চট শিল্পের বিলুপ্তির রাজনৈতিক পৃষ্ঠপট। এটা প্রিয় এইজন্য যে এই বইটা লিখে আমি হ্যাপি ফিল করেছিলুম।

সাতদিন: আপনার লেখালিখির পেছনে মূল প্রেরণা কি?
মলয় রায়চৌধুরী: এটা অ্যাডিকশান। অ্যাডিকশানের বোধ হয় প্রেরণা হয় না।

সাতদিন: শর্তসাপেক্ষে লেখালিখি ছেড়ে দিতে বললে কি ছাড়তে পারবেন?
মলয় রায়চৌধুরী: জানি না ভারতের সাহিত্য একাডেমিকে লেখা আমার চিঠিটা বাংলাদেশে পৌঁছেচে কিনা। চিঠিটা আমি এখানে তুলে দিচ্ছি ; মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া আছে চিঠিটিতে:

April 30, 2004
Prof K. Satchidanandan
Secretary
Sahitya Akademi
Rabindra Bhaban
35 Ferozeshah Road
New Delhi.

Dear Sir
Refusal to accept Sahitya Akademi Award
Thanks for your telegram dated 30.4.2004 conveying that my translation work of Dharmaveer Bharati’s “Suryer Saptam Asva” has been awarded the Sahitya Akademi Translation prize.
I am constrained to refuse this award. As a matter of principle I do not accept literary and cultural prizes, awards, lotteries, grants, donations, windfalls etc. They deprave sanity.
My decision to refuse the award is in no way to affront late Dharmaveer Bharati, who was a great admirer of my work, and had supported me during my literary ordeals in 1960s when most of the Bengali intelligentia had conspired against the Hungryalist movement. Your magazine the “indian Literature” itself had never bothered to write about this movement.
Sincerely
Malay Roychoudhury.

আর কী শর্ত থাকতে পারেজেনিফার লোপেজের সঙ্গে মহাকাশযানে করে অন্তরীক্ষে এক পাক খেয়ে আসা বা ক্যাটরিনা কাইফের সঙ্গে জাহাজের রেলিঙে দাঁড়িয়ে পেংগুইনদের সাঁতার দেখা?
সাতদিন: একজন লেখকের ভেতরের মানুষসত্তাকেআপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করেন?
মলয় রায়চৌধুরী: কোনো লোক লেখক হয়েছে বলেই তো আর তার ভেতরের মানুষসত্তাটা পালটে যেতে পারে না। সে লেখক না হলেও তার মানুষসত্তাটা যা ছিল তাই থাকবে। আসেপাশে লেখকদের যা সব কাণ্ড-কারখানা দেখি, তা থেকে স্পষ্ট যে তারা লেখক না হলেও ওই সমস্ত কাজ-কারবারই করত। আমি লেখক না হলেও মানুষটা আমি যা রয়েছি তা-ই থাকতুম। আমার সত্তা জিনিশটায় যদি বাইরের কোনো উপাদানের অবদান থেকে থাকে তাহলে তা শৈশবের বিহারি অন্ত্যজ আর দুস্হ মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ার একলেকটিক পরিবেশ; যেকোনো বাড়িতে যেকোনো সময়ে প্রবেশ করতে পারতুম, এমনকি পাড়ার মসজিদেও, যা বর্তমান ভারতীয় সমাজে অকল্পনীয়।

সাতদিন: মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
মলয় রায়চৌধুরী: সত্যি বলতে কি, মৃত্যু সম্পর্কে আমি বেশ কনফিউজড।

সাতদিন: লেখালিখি ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয়?
মলয় রায়চৌধুরী: আমি খেতে ভালোবাসি। বয়সের কারণে নানা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে গিয়েও যতটা পারা যায় খাওয়ার ব্যাপারটায় রদবদল করতে থাকি। আমি রাঁধতেও পারি । আমি আর দাদা রান্নাঘরে মাকে টুকিটাকি সাহায্য করার সময়ে অনেককিছু রাঁধতে শিখে গেছি। মাঝে ভেবেছিলুম যা রান্নার রেসিপি নিয়ে একটা বই বের করব, তা আর হল না। আমি বিরক্ত হই আমার একাকীত্ব বিঘ্নিত হলে, এমনকি আশেপাশের আওয়াজও আমার একাকীত্বকে নষ্ট করে বলে বিরক্ত হই। আমি বেসিকালি একজন লোনার, একা থাকতে ভালোবাসি।

সাতদিন: সাহিত্যের বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শত্রুকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
মলয় রায়চৌধুরী: বন্ধু বলতে যা বোঝায় তা আর আমার নেই। স্কুল-কলেজে ছিল আমার তিনজন বন্ধু, সুবর্ণ-বারীন-তরুণ। তারপর থেকে আমি বন্ধুহীন। আমার একাকীত্বপ্রিয়তার জন্যই বোধহয় আমি বন্ধুহীন। এই এখন হঠাৎ যদি আমার স্ত্রীর কিছু হয়, এমন কেউই নেই যাকে ডাক দিতে পারব। অমন পরিস্হিতিতে ডাক দিতে হবে অ্যাম্বুলেন্সকে। শত্রুও নেই। কেনই বা কেউ শত্রুতা করবে? লেখালিখির জগতে অনেকে অনেক কিছু লেখে আমার বিরুদ্ধে; তার জন্য তাদের শত্রু তকমা দেয়া উচিত হবে না।

[মলয় রায়চৌধুরী (১৯৩৯) একজন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রবন্ধলেখক ও অনুবাদক। পশ্চিমবঙ্গে ষাটের দশকে যে চারজন হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন (অন্যেরা হলেন দেবী রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সমীর রায়চৌধুরী), তিনি তাঁদের অন্যতম । কবিতা লেখার জন্য ১৯৬৪ সালে তাঁকে অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এ মকদ্দমা তিনি হাইকোর্টে জিতে যান। তাঁর জখমকবিতাটি বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ১৯৬৮ সালে তিনি মধ্যপ্রদেশের রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় সলিলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন। বর্তমানে তিনি মুম্বাইতে কাণ্ডিভালি শহরতলিতে একটি বহুতলে একরুমের ফ্ল্যাটে সস্ত্রীক থাকেন। তাঁর মেয়ে, জামাই নাতনিরা বিদেশে থাকেন এবং ছেলে ও ছেলের স্ত্রী থাকেন কলকাতায়।]

----------------
আমার প্রথম বই নিজের নামে ছাপা হয়নিঃ পবিত্র সরকার

সাতদিনঃ আপনি নিজের লেখার মূল্যায়ন কী ভাবে করেন?

পবিত্র সরকারঃ আমি নিজের লেখার মূল্যায়ন করি না, করা উচিতও নয়। কখনও নিজের তাগিদে লিখি, কখনও অন্যের তাগিদে। অন্যরা যে তাগিদ দেন, তাতে বুঝি, এ লেখা কারও কাছে মূল্য পায়, যদি না নেহাত পাতা ভরানোর জন্যে নিরুপায় হয়ে অন্যেরা চান লেখা, হাতের কাছে আমি আছি বলে আমারই কাছে চান। 
তবু চান তো, সেটাই একটা মূল্য। অন্যদের কাছেও তো চাইতে পারতেন, আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষাও তো করতে পারতেন। সেটা করেন না, তাতেই বুঝি, এক পয়সা হোক, দু-পয়সা হোক, কিছু মূল্য এ লেখাগুলোর আছে।
আর, আধুনিক পাঠক-প্রতিক্রিয়া তত্ত্বে বলে, তোমার লেখাটা আসলে তোমার সৃষ্টি নয়, পাঠকেরাই তাকে সৃষ্টি করে। কাজেই পাঠকেরা কীভাবে আমার লেখার মূল্যায়ন করেন সেটাই আসল মূল্যায়ন।


সাতদিনঃ প্রথম লেখা কী, প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা কী?
পবিত্র সরকারঃ ক্লাস সিক্সের কোনো একটা সময়ে বৃষ্টির সঙ্গে সৃষ্টিমিল দিয়ে এক দুপুরে একটা পদ্য লিখেছিলাম বলে মনে পড়ছে। সেটা মহাকালের গর্ভে বিলীনকিন্তু সেটাকেই আমার প্রথম লেখা বলে ধরতে হবে। প্রথম ছাপা লেখা কবিতা বা ছড়া, তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখে যথেষ্ট উত্তেজিত হয়েছিলাম, ও বয়সে হাজার ছেলেমেয়ে হয়। 
প্রথম বইও এমন কিছু আহামরি নয়। এক প্রকাশক এসে ধরেছিলেন ১৯৬২-তে, তখন আমি এমএ পাস করে সবে একটা স্কুলে ঢুকেছি,  একটা রচনা বই লিখে দিতে হবে। রচনা পিছু কুড়ি টাকা করে দেবেন। সে এক মহা ঐশ্বর্যের আমন্ত্রণ। দৈনিক চারটে করে রচনা লেখা হয়ে যেত কোনোদিন।  দৈনিক আশি টাকা রোজগার নিজেকে টাটা-বিড়লার সমকক্ষ মনে হত। বইয়ের নাম ছিল প্রবন্ধ বাহার। হায়, সে বই নিজের নামে ছাপা হয়নি, ছাপা হয়েছিল, এখন লিখতে লজ্জা হচ্ছে, ‘বাই আ ফারস্ট ক্লাস ফারস্ট গোল্ড মেডালিস্ট স্কলারনামে। ফলে নিজের নাম ছাপা হয়নি, একটা হাস্যকর বিশেষণ ছাপা হয়েছিল। সে বইকে আমার প্রথম বই বলে দাবি করব,  এমন প্রমাণ আমার হাতে আর নেই।

সাতদিনঃ বাংলা সাহিত্যের কোন্‌ শাখা আপনার মতে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ বলে মনে হয়?
পবিত্র সরকারঃ আমার মতে কবিতা আর ছোটোগল্প। তার পরেই উপন্যাস।  কেন তা লিখতে গেলে পুরো একটা সাহিত্যের ইতিহাস লিখে ফেলতে হবে।

সাতদিনঃ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনকে কতটা প্রতিফলিত করবে?
পবিত্র সরকারঃ বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি সব সময় ছিল, এখন তার মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। তাই বলে সাহিত্য অবান্তর বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি,  তার রচনা আর প্রকাশও বন্ধ হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে তা হবে বলে মনে হয় না, সুদূর ভবিষ্যতে না।  তবে তার রূপ হয়তো বদলাবে, ছাপা বইয়ের জায়গায় কম্পিউটারে বা ট্যাবলেটে আমরা বেশি বই পড়ব।  বই কিন্তু পড়বই। সাহিত্য যে চেহারাতেই থাকুক, জীবনকে বাদ দিয়ে হবে না। কল্পবিজ্ঞানের ভবিষ্যপুরাণেও জীবনের কথাই থাকবে। 

সাতদিনঃ. আপনার প্রিয় লেখক কে?
পবিত্র সরকারঃ এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব শক্ত।  কেউ কেউ (একজন নন) সারাজীবনের প্রিয় লেখক, আবার কেউ কেউ কোনো একটা সময়ে প্রিয় লেখক। অন্যদের বাদ দিয়ে একজনকে আমি বেঁছে নেওয়ার কথা ভাবতেই পারি না।  রবীন্দ্রনাথের নাম করে দিলে ল্যাঠা চুকে যায়, কারণ তাঁর রচনাই আমি আমার কাজে ও প্রকাশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করি, কিন্তু সেটা হবে এক ধরনের ন্যাকামি। তাহলে পরশুরামকে আমি কোথায় রাখববিভূতিভূষণ(বন্দ্যোপাধ্যায়)কে? আখতারউজ্জামান ইলিয়াসকে?

সাতদিনঃ আপনার প্রিয় নিজের লেখা কোন্‌টি, এবং কেন?
পবিত্র সরকারঃ লিখেছি এবং লিখি তো অজস্র।  অন্নদাশংকর রায়ের এবার না-লিখতে শেখোউপদেশ আমি শুনি না। তাই অনেক লেখাই আমার প্রিয়। তবে বইয়ের মধ্যে গত বছর বেরোনো মৃত্যুবইটা বিষয়ে আমার একটু দুর্বলতা জন্মেছে, কারণ আমি মানবজীবনের একটা সত্যকে নিজের মতো করে বোঝবার চেষ্টা করেছি। অনেকের ভালো লেগেছে শুনি, সেটাও একটা কারণ হতে পারে।

সাতদিনঃ আপনার লেখালেখির প্রেরণা কী?
পবিত্র সরকারঃ বাইরের কোনো প্রেরণা, কোনো ব্যক্তি বা ঘটনাএখন আর কাজ করে না।  আমার নিজের মধ্যেই কিছু বলবার কথা জমে ওঠে, তাতে অবশ্যই বাইরের ঘটনার অভিঘাত থাকে।  তাতে আমার নাতিদের জন্ম, তাদের মজাদার কথা ও কাজ, নানা ব্যক্তির হাস্যকর চরিত্র, ইতিহাসের নানা সংকট ও সন্ধিক্ষণ থেকে সমাজের সাময়িক ও চিরস্থায়ী অসংগতি সবই থাকে। 

সাতদিনঃ শর্তসাপেক্ষে আপনাকে লেখা ছেড়ে দিতে কেউ যদি বলে, আপনি কি ছাড়বেন?
পবিত্র সরকারঃ না।  শর্ত মানে কোনো প্রলোভন: আপনাকে এক কোটি টাকা দেব, স্বর্গের হুরিপরিদের সঙ্গ জোগাড় করে দেব ইত্যাদি এই তোএক কোটি টাকা কত আমি এখনও গুনতে পারি না, আর সম্ভোগের বয়স আমার আর নেই, ইচ্ছাও নেই।  আমি যা পেয়েছি এত পাওয়ার কথা আমার ছিল না তা নিয়ে তৃপ্ত আছি।  লেখা ছেড়ে দিতে বললে মৃত্যুর অনেক আগেই আমার মৃত্যু হবে।

সাতদিনঃ লেখকের ভিতরকার মানবসত্তাআর লেখকের সত্তা নিয়ে কী একটা প্রশ্ন।
পবিত্র সরকারঃ প্রশ্নটা আমি যদি ঠিক বুঝে থাকি (না বোঝার সম্ভাবনাই বেশি), তা হলে বলব, আমি একটা সামাজিক লোক, আমার নানা বাইরের পরিচয় আছে। সমাজে সেই পরিচয় অনুযায়ী আমি মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করি অধ্যাপক হিসেবে ছাত্রদের সঙ্গে, প্রতিবেশী হিসেবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে, ক্রেতা হিসেবে বাজারের দোকানদারদের সঙ্গে, সহযাত্রী হিসেবে সহযাত্রীদের সঙ্গে, লেখক হিসেবে সম্পাদক বা পাঠকদের সঙ্গে, ইত্যাদি। কিন্তু লেখক হিসেবে আমি যে ভাবি, পড়াশোনা করি, শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে লিখি, সেখানে বাইরের কেউ উপস্থিত থাকে না, আমি আমার আত্মপ্রকাশের একটা পরিসর করে নিই। আমার লেখা অবিশ্যি নানারকমের। গুরুগম্ভীর প্রবন্ধে ছাত্র বা সাধারণ জিজ্ঞাসু পাঠকের কথা মনে থাকে,  কিন্তু ব্যক্তিগত লেখার ক্ষেত্রে তাঁরা দূরে সরে যান। ফলে আমার সামাজিক সত্তা আর লেখকসত্তা এক নয়।  আর মানবসত্তা’—সে তো আরও ভিতরে।  তার খোঁজ নেওয়া বিপজ্জনক।

সাতদিনঃ মৃত্যুসম্বন্ধে কী ভাবেন?
পবিত্র সরকারঃ মৃত্যু ঘটবেই।  জন্ম ব্যাপারটা অনিশ্চিত, নরনারীর মিলনে সন্তানের জন্ম নাও হতে পারে, কিন্তু যে একবার জন্মেছে সে মরবেই। মৃত্যু জীবনের একমাত্র ধ্রুব বাস্তব। আমার বয়েস সাতাত্তর, কাজেই মৃত্যু আমার কাছাকাছি কোথাও অপেক্ষা করছে। তা নিয়ে আমি ভাবি না। এ-ও ভাবি না যে, জন্মান্তর আছে। আমার কাছে জীবন একটাই। যা হবে তা এ যাত্রাতেই হয়ে যাবে।  আমি শুধু ভাবি, মৃত্যুটা যেন খুব সমস্যাজনক না হয়, আমার আত্মজনেরা যেন আমার মৃত্যু নিয়ে বেশি না ভোগে।  দেহ দান করা আছে, ডাক্তারি ছাত্রদের জন্য। মৃত্যুর আগে হাতের কাজগুলো যেন শেষ করতে পারি যেন আমার গানের শেষে থামতে পারি সমে এসে।’  কিন্তু যেমন চাই তা কি হবেনা হওয়াই সম্ভব। তখন বলব, ‘ব্যাস, এইটুকুই হল আমার দ্বারা। বাকিটা তোমরা কেউ কোরো।
 
সাতদিনঃ আর কী কী প্রিয়
পবিত্র সরকারঃ নোনতা খাবার প্রিয়, গরম মুড়ি তেলেভাজা যেমন, তবে মিষ্টিও মাঝে মাঝে খেতে ভালো লাগে। গান, বিশেষত রবীন্দ্রসংগীত প্রিয়, তা দিয়ে দিন শুরু করি।  নজরুল,  উচ্চাঙ্গ সংগীতদেশ ও বিদেশের, লোকসংগীত ভালো লাগে। কন্যা ও  নাতিরা প্রিয়, কিন্তু তারা কাছে থাকে না। 

সাতদিনঃ বন্ধু কারা? শত্রু কারা
পবিত্র সরকারঃ এ ভাবে এখন আর ভাবি না। স্কুল ও কলেজ জীবনের একজন-দুজন বন্ধু এখনও টিকে আছে, তারা খোঁজখবর নিলে ভালো লাগে। শত্রু নানা সময়ে তৈরি হয়েছিল, দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু তাদের অবস্থা দেখলে এখন দুঃখ হয়। শত্রুতা করে তাদের খুব একটা লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না। 

১২ জুন ২০১৪, কলকাতা।
===========================

২টি মন্তব্য: