সিলাইবালা ][কামাল রাহমান
রাত সাড়ে দশটায় কুড়াইল বাজারে যখন ওকে নামিয়ে দেয় গার্মেন্টসের বাস তখন ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। নিজের জন্য ভাবে না আর সে। সবটুকু সামর্থ দিয়ে জীবনের প্রথম অপকর্মটায় বাধা দিতে চেয়েছিল। পারেনি। তারপর আর পরোয়া করেনি ওসবে। শেষ দিকে বরং উপভোগ করতে শুরু করেছিল। এখন এই আট বছরের মেয়েটাকে বাঁচাতে চায় সে। খুব যে একটা অর্থ আছে এটার, তাও না। শুধু একটা ইচ্ছে। স্বামীর হাতে অক্ষত অবস্থায় ওকে তুলে দেয়া। তারপর যা হওয়ার হবে। মানুষগুলো যেভাবে পশু হতে শুরু করেছে, অথবা ভেতরের পশুটাকে ভুলিয়ে রাখার বিষয়টা ভুলে যাচ্ছে, তাতে আট বছরের শিশুও ওদের লালসা ছেড়ে যায় না।
ভাঙ্গা ছাতা দিয়ে মেয়েকে আরো বেশি আড়াল করে অনেকটা দৌড়ে বাজারের পেছনের বস্তিটাতে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দিলারা। ঘরে ঢুকে কাপড় পাল্টে গায়ে জড়ায় শুকনো পোশাক। ঠাণ্ডায় হাঁচ্চি আসে ক’টা। মনে মনে বলে, ‘দুর যা বালাই।’ ঘরের এক কোণে শুয়ে থাকা ওর মাকে জিজ্ঞেস করেÑ
ভাত আছেনি মায়ো?
আছে তো। বাইরা দিমু?
থাউক মা। লইয়া খামুনে।
কথা আর বাড়ে না। খেয়ে শুতে না শুতে ঘুমিয়ে পড়ে দুজনে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়মুনাকে ওর কাজের বাসায় পৌঁছে দিয়ে সে যাবে গার্মেন্টসে। বনানী মসজিদের ইমামের বাসায় কাজ জুটেছে মায়মুনার। ভাগ্যটা ভালো ওর। মনে মনে ভাবে দিলারা। মেয়েটা অন্তত ভালোভাবে স্বামীর ঘরে ঢুকতে পারবে। অনেক হাত ঘুরতে হবে না ওর মতো। পুরুষের লালসা থেকে কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে হয়ে তার তালিম এখনি দেয়া শুরু করেছে মেয়েকে। এর প্রতিক্রিয়া ওটুকু মেয়ের ভেতর কেমন হতে পারে তা ভেবেও দেখে না। অথবা ওটা ভাবার অবকাশই নেই। এমনটাই জেনে এসেছে ওদের পূর্বসূরিরাও।
বনানী গুলশান এলাকায় বাস করা মানুষগুলো এক পুরুষ আগেও ছিল দিলারা মায়মুনাদের গোত্রের। ওরা বোঝেও না যে নিুবিত্ত মানুষগুলোকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখতে হয়। না হলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে। বস্তির কদর্যতা অবশ্য স্পর্শ করে না ওদের। ওখান থেকেই তো উঠে এসেছে মাত্র কদিন আগে। ফলে মায়মুনাদের বস্তি থেকে কাজের জন্য খুব দূরে যেতে হয় না ওদের। পায়ে-হাঁটা দূরত্বে থাকায় বেশ সুবিধে। কিন্তু এই সুবিধেটাও নিরবচ্ছিন্ন থাকে না সব সময়। হঠাৎ ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় কাজ থেকে ক’দিনের ছুটি নেয় দিলারা। মায়মুনাকে আর পৌঁছে দিতে কিংবা নিয়ে আসতে পারে না। ইমাম গিন্নির কাছে বলে ওখানে রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় ওর। শেষ পর্যন্ত ওটাই পাকাপাকি হয়ে যায়। ওর মায়ের শরীর ভালো হয়ে যাওয়ার পরও আর আনা-নেয়া করার ঝামেলায় যায় না। কষ্টেরও লাঘব হয় কিছুটা। মাসে এক দুবার এসে মায়মুনা মা ও নানির সঙ্গে রাত কাটায়। এ ছাড়া বছরের বারো মাস, মাসের ত্রিশ দিনই কাজ করতে হয় ইমামের বাসায়। কাজ করেই যখন জীবন কাটাতে হবে, এটায়ই অভ্যস্ত হয়ে উঠে সে।
ইমামবাড়ির ভাত মাংস ঝাল ঝোল খেয়ে সবার আগে বাড়তে থাকে মায়মুনার শরীর। আশে পাশের আগাছা নিড়িয়ে গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দিলে যেভাবে লাফিয়ে বাড়তে থাকে ওটার শাখা প্রশাখা তেমনি লকলকিয়ে উঠে মায়মুনার শরীর। আর তাতে প্রথমেই মাথায় চক্কর দেয় ভালো মানুষ ইমাম সহেবের। গা হাত পা টিপে দিতে সময়ে অসময়ে ডাকে মায়মুনাকে। মাঝে মাঝে এমন সব জায়গায় টেনে নিয়ে হাতটা ধরিয়ে দেয় যে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচে মেয়েটা। সব বুঝেও কিছু বলার সাহস পায় না ইমামগিন্নি।
মায়ের কাছে কান্নাকাটি করে মায়মুনা। দিলারা ভাবে ইমামের ছেলেটা মনে হয় ওর শরীরে হাত-টাত দেয়। আরো বেশি করে বোঝায় কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয়। মায়মুনা বলতে পারে না যে বড় রাক্ষসে গিলতে বসেছে ওকে। আরো দুবছর গড়ায় ওভাবে। মায়ের শেখানো মায়মুনার প্রতিরক্ষা অস্ত্র সব ভেঙ্গে পড়ে এক রাতে। ইমামগিন্নি কেঁদে-কেটে অস্থির হয়। বেশি বাড়াবাড়ি করলে নতুন বউ ঘরে আনবে বলে শাসায় ওকে। কি আছে ওর শরীরে যে ওকে নিয়ে পড়ে থাকবে। ভাঙ্গা এক রেকর্ড। কত আর বাজাবে। শেষ পর্যন্ত ওটাও মেনে নেয় ইমামগিন্নি।
মায়ের কাছে কান্নাকাটি ছাড়া কিই বা আর করতে পারে মায়মুনারা। মা বোঝায় ওকে, এর চেয়ে ভালো মানুষ আর কোথায় পাবে সে, মসজিদের ইমাম! শেষ পর্যন্ত বিষয়টা মেনে নেয় মায়মুনা। মায়ের কাছে তো ওসব কথা খুলে বলতে পারে না। ঘেন্নায় গা রি রি করে। সারাদিন আতঙ্কে থাকে রাতের ঐ সময়টার জন্য।
দিন যেতে থাকে। এভাবেই যায় দিলারা মায়মুনাদের দিন। ইমামের ছেলেটাও এখন লায়েক হয়ে উঠেছে। তথাকথিত অভিজাত এলাকার বাসাবাড়িগুলোয় ছেলে বড় হয়ে উঠলে ওদের বাবামায়েরাই আজকাল সোমত্ত মেয়েদের ঘরে রাখে কাজের জন্য। যেন আবোল-তাবোল জায়গায় যেয়ে ঢুঁ মেরে ঝামেলায় না জড়ায় ওরা। এভাবে ছেলের কাজ চলে নিয়মিত। মাঝে মাঝে বাবারও। মসজিদের ইমাম বলেই এটার অন্যথা হওয়ার কোনো কারণ তো নেই।
মায়মুনার শরীর স্বাস্থ্যও এমন যে অপরিচিত কেউ এলে ওকে মনে করে পরিবারের কেউ। ইমামের মেয়ে ভেবে অনেক সময় সালামও দেয়। সব কিছুই তো মেনে নিতে হয় মায়মুনাদের। শেষ পর্যন্ত ছেলেটাও হাত বাড়াতে শুরু করে। মায়মুনার তখন বাধ ভেঙ্গে গেছে। ঐ বুইড়ার লটর-পটর থেকে বরং ছেলের তাগড়া শরীরটাকেই ভোগ করে প্রতি রাতে। মাসে একদু’বার বুইড়া হয়তো খাবলে-খুবলে ছেড়ে যায়। পড়ে ছেলে এসে প্রশান্তি এনে দেয়।
সমস্যা দেখা দেয় প্রকৃতির অলংঘ্য পদ্ধতিটায়। দু’জনের কে যে সমস্যটা তৈরি করেছে বুঝতে পারে না ইমামগিন্নি। ক্লিনিকে যেয়ে ওটাও সামলে নেয় শেষ পর্যন্ত ধৈর্যশীল ঐ মহিলাটি। পরিষ্কার করে ফেলে সে-সব। এবার বরং মায়মুনার মায়ের ভূমিকাটি নেয় সে। আসল প্রতিরোধের নিয়ম কানুন শিখিয়ে দেয়। প্রতি রাতে নিজের হাতে একটা করে বড়ি খাইয়ে দেয় ওকে যেন ভবিষ্যতে আর কোনো ঝামেলা না পাকায়।
ততদিনে মায়মুনাও শিখে গেছে জীবনের খুঁটিনাটি। নিজের ভালো মন্দ বোঝার জন্য মা অথবা খালা আর কারোই দরকার নেই। নিজেই খুঁজে পায় ওর মনের মানুষ। বাড়ির ড্রাইভারটার সঙ্গে পালিয়ে একেবারে ওর দেশের বাড়ি জামালপুরে যেয়ে উঠে বউ হয়ে। সংসারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মায়মুনা।
জন্মাবধি বস্তিতে চিমসে থাকা মায়মুনা গ্রামের মুক্ত হাওয়ায় এসে নতুন জীবনের সন্ধান পায়। একটা মানুষজীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। স্বামীর ভাগে পাওয়া মাটির ঘরটা লেপেপুছে ঝকঝকে তকতকে করে রাখে। নিজের সঞ্চিত অর্থ থেকে ঘরের চাল ছেয়ে দেয় নতুন টিন দিয়ে। পাতকুয়োর একটা পায়খানা বসায় প্রথম হপ্তায়ই। বাঁশ কাঠ সংগ্রহ করে নিজের হাতে মুরগির জন্য খোয়ার বানায়। কবুতরের খোপ বানায়। দুধ দেয়া ছাগল কিনে একটা। সংসারের স্বচ্ছলতা ও আনন্দের জন্য সব কিছুই করে মায়মুনা। জীবনের এই অজানা দিকগুলো শরতের কাশফুলের মতো দিগন্তনীল আকাশে প্রথমবারের মতো এক অলৌকিকতা নিয়ে দেখা দেয়। অনেক সময় বুঝতেও পারে না মায়মুনা যে এটা বাস্তব না স্বপ্ন। এ রকম স্বপ্ন তো সে দেখেনি কখনো!
ওটা ভাঙ্গতেও সময় লাগে না বেশি দিন। উপজেলা শহরে ইঁট বালু টানার ট্রাক ড্রাইভারির চাকরি পায় ওর স্বামী। কিন্তু কিছুদিন পরই নেশা করা শুরু করে সে। এটা বেড়ে যেতে থাকে দিন দিন। তারপর নেশা করে কারণে অকারণে, অথবা তুচ্ছ কোনো কারণে ওকে মারধর করতে শুরু করে বছর না ঘুরতেই। এত কিছুর পরও সব সয়ে যায় মায়মুনা। বছর দেড়েকের মধ্যে ওর কোল জুড়ে এক ছেলে আসে। ওকে নিয়ে আবার নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সবাই লাথি-জুতো দিলেও পেটের ছেলে কখনো মায়ের অমর্যাদা করবে না। অন্তত এটুকু ধারণা বা আশা হয়েছে ওর। ছেলেটার তিন বছর বয়সে ওর বাপ উধাও হয়ে যায়। মায়মুনা বুঝতে পারে যে অন্য কোথাও সংসার পেতেছে সে আবার। এই নিদানের কালে আর কারও কথা মনে পড়ে না। সোজা যেয়ে মায়ের পুরোনো আস্তানায় হাজির হয়।
পৃথিবীর সব দরোজা বন্ধ হলেও এই একটা দরোজায় কোনো কপাট নেই। দু’জনে মিলে অনেক কান্নাকাটি করে। তারপর জীবন শুরু হয় জীবনের নিয়মে। ততদিনে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে দ্বিতীয় প্রজন্মের মেয়েরা ঢুকতে শুরু করেছে। বিভিন্নভাবে ফ্যাক্টরির ওদের খুশি করে ওকেও কাজ জুটিয়ে দেয় দিলারা। মালিক পক্ষের দুচারজনের সঙ্গে মাঝে মাঝে কিছু সময় কাটানো তেমন আর কোনো সমস্যা নয় ওদের জন্য। এসবে আর মনে কিছু করে না মায়মুনা। সতীসাধ্বী হয়ে স্বামীর সংসার করতে চেয়েছিল। উচ্ছন্নে যেয়েও কাটিয়েছিল অনেকদিন। দুদিকটাই তো দেখা আছে ওর। শরীরের পাকা নিরোধ ব্যবস্থাটা বরং করে নিয়েছে নিজে থেকেই। গার্মেন্টসের সহকর্মীদের কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেতে শুরু করে মায়মুনা। এখন আবার পালিয়ে যাওয়ার স্তরে নেই সে। বুঝতে পারে যে আসলে কি চায় ওরা। ঐ ফাঁদে আর পা দেয় না। জীবনের প্রতিও এক ধরনের মোহমুক্তি ঘটেছে। বুঝতে পারে যে অর্থহীন একটা পশুর জীবন যাপন করে চলেছে সে। যার জন্মই হয়েছে অন্যকে সব রকম সেবা দেয়ার জন্য।
ছেলেটার জন্য আবার ভাবনায় পড়ে মা ও মেয়ে দুজনেই। খুব সহজ একটা সমাধান পেয়ে যায় এটার এক দিন। ওদেরকে হেদায়েত করার জন্য প্রায়ই পূণ্যবান নারীরা দল বেধে আসে আজকাল। নির্দেশিত পাক পবিত্র পথে চলার পরামর্শ দেয় ওদের। স্থানীয় একটা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিতে বলে ছেলেটাকে। পয়সাকড়ি কিছু লাগবে না। এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব আর কি হতে পারে। ছেলেকে মাদ্রাসায় দিয়ে বড় একটা সমস্যার সমাধান হয় ওদের। দিলারার যেমন হয়েছিল মায়মুনাকে ইমামের বাসায় কাজ জুটিয়ে দিয়ে। এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য অন্য আর কি থাকতে পারত ওদের জন্য।
আরো বছর আটেক পর ছেলেকে দেখে নিজের ভেতর এক ধরনের আনন্দ অনুভব করে মায়মুনা। সঙ্গে কিছুটা ভয়ও। বাপটা ছিল মাতাল, বদমাশ। বড় হয়ে ছেলেটা যেন ওরকম না হয় কোনোভাবে। মনে মনে কামনা করে মায়মুনা। ছেলেটার স্বভাব কেমন যেন শান্ত শান্ত। এতে আরো বেশি ভয় পায় সে।
কাজ থেকে একদিন ঘরে ফিরে মায়মুনা দেখে গোমড়া মুখে বসে আছে ওর ছেলে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে বলেÑ
গার্মেন্টসে আর চাকরি করতে যাবা না মা।
অবাক হয় মায়মুনা।
কি অইছে?
না যাইবা না। খারাপ মাইয়া মাইনষেরা গার্মেন্টসে চাকরি করে।
মায়মুনার মনে হয় এই মুহূর্তে পায়ের নিচে মাটিটা যদি দুভাগ হয়ে যেত তা হলে ওখানে ঝাঁপ দিত। অনেক কিছু সয়েছে সে এ জীবনে। কিন্তু ছেলের কাছ থেকে এটা ওর পাওনা ছিল না। কোনোভাবেই না। শুধু এই ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে জীবনটা ধরে রেখেছিল মায়মুনা। নয়তো অনেক আগেই ইতি টেনে দিতে পারত এটার। এমন কোনো কঠিন কাজ ছিল না ওটা।
পোড়-খাওয়া মানুষ মায়মুনা। শেষ পর্যন্ত সামলে নেয়। ওকে জিজ্ঞেস করে-
কে কইছে এইসব কথা?
জবাব দিতে যেয়ে একটু ইতস্তত করে ছেলেটা। তারপর বলেÑ
হুজুরে।
মায়মুনা আন্দাজ করতে পারে যে কারা ওর ছেলের মগজ ধোলাই করেছে। মনে মনে আশঙ্কাও করেছিল। কিন্তু বিকল্প তো কিছু ছিল না ওর কাছে। মাথা ঠাণ্ডা করে ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করে। বলেÑ
তোর হুজুররে কইস, ভাতের যে নলাডা ওর মুখে যায় তার সব কয়ডা দানা গার্মেন্টসের মাইয়াগো কামাই করা।
এই সব কথা আমি বুঝি না। তুমি যাইবা না।
দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে মায়মুনা।
তাইলে খাইবি কি, সংসার চালাইব কেডা?
আমি চালামু।
ভাবতেও পারে না মায়মুনা যে ওর ছেলে এতটা বড় হয়ে গেছে! জিজ্ঞেস করে-
কেমনে?
মিছিলে গেলে ওরা ট্যাকা দিব কইছে।
সব কিছু বুঝতে পারে মায়মুনা। ওর চোখের সামনে আরো বড় হতে থাকে ছেলেটা। একটা পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হয়। দাড়ি গজাতে থাকে ওর মুখ জুড়ে। আর ঐ মুখটা পরিবর্তিত হয় বনানীর ঐ ইমামে। মেহেদি মাখা দাড়ির ভেতর ওর লম্বাটে মুখটা ভেসে উঠে। মায়মুনার দিকে তাকিয়ে বীভৎস ঐ মুখটা দাঁত খিঁচিয়ে উঠলে দেখতে পায় সে একাত্তরের রক্তে এখনো লাল হয়ে আছে ওর সব কটা দাঁত।
---------------
কমল কর্মকারের গল্প কুড়া ঝাড়–নি

একটানা ঘর্ঘর শব্দে
চালকলের মোটরটা চলতে থাকে। কর্কশ যান্ত্রিক এই শব্দ-গোলযোগ প্রথম প্রথম যে-কারোর
কানে বেশ বাজে। তারপর অভ্যস্ত হয়ে পড়লে এই কর্কশ শব্দের সঙ্গে মানুষের মিতালি হয়ে
যায়। তখন এই ঘড়ঘড় শব্দের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ছন্দময় সুর-তাল-লয়, তন্দ্রালু আবেশে তখন চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে আসে।
এমনি এক ব্যস্ত
দুপুরে কুড়াঝাড়–নি সাবিহা তন্দ্রার মোহন-জগতে ক্ষণিকের
জন্য ডুবে যেতে থাকে। তন্দ্রার ভেতরে তখন ভেসে ওঠে সবুজ আলোয় উদ্ভাসিত একটি ছোট্ট
উঠান। লাউয়ের মাচায় একটি দোয়েল শিস দিয়ে উড়ে যায়। উঠানে ছড়ানো সেদ্ধ ধানে এসে বসে
একপাল শালিক। ধঞ্চের লাঠি দিয়ে শালিক তাড়াতে গিয়ে হঠাৎ ছিটকে পড়ে সাবিহা। বোঁ
বোঁ শব্দে বোবা মানুষের মতো আচমকা গোঙাতে থাকে চালকলের মোটরটা। সাবিহা মিলের ভেতর
বসে কুলায় কুড়া ঝাড়ছিল। বিকট শব্দে তার তন্দ্রার সূক্ষ্ম জাল এক ঝটকায় ছিঁড়ে যায়।
চালকলের মিস্ত্রি
দৌড়ে ছুটে গিয়ে মেইন সুইচ বন্ধ করে দেয়। চালকলের হলারে কোনো গন্ডগোল দেখা দিয়েছে।
মিলের যন্ত্রপাতি খুলে মিস্ত্রি ব্যস্ত হয়ে পড়ে সারাইয়ের কাজে।
সাবিহার এবার খেয়াল
হয় যে তার হাত কুলাতেই এতক্ষণ আটকে ছিল। একটু আগে সাবিহা তার হারিয়ে যাওয়া সবুজ
উঠানে ফিরে গিয়েছিল। দোয়েলের মিষ্টি শিসের আমেজ এখানো তার কানে লেগে আছে। বুকের
ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সাবিহার। মিলের ছাদে মাকড়সার জালে কুড়ার দলা
ঝুলে আছে। সেখানে কিছুক্ষণ আটকে থাকে সাবিহার চোখ। ফুলির কথা মনে পড়ে।
চার বছরের ফুলি
সাবিহার একমাত্র সন্তান। ফুলিকে সিরাজ মিয়ার বস্তির ভাড়াটে বাসায় রেখে এসেছে। কদিন
ধরে মেয়েটার জ্বর। পাশের নাজিরবাড়ির বুড়ির কাছ থেকে গোপন গাছের শেকড় এনে কাঁথার
সুতা পাকিয়ে ফুলির ডান হাতে বেঁধে দিয়েছে। ওষুধটা খুব ভালো। বস্তির অনেকেরই জ্বর
ভালো হয়ে গেছে এতে। কিন্তু ফুলির বেলায় বুড়ির শেকড়ে কাজ হচ্ছে না। জ্বর কমছে না
মেয়েটার। সাবিহার মনে অবিশ্বাসের মেঘ জমে বুড়ির ওষুধের প্রতি। মাঝে মাঝে সাবিহা
অনেক কিছুর ওপর থেকেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এমনকি কখনো কখনো ধর্মের ওপরও তার
বিশ্বাস হারিয়ে যায়। তখন আবার অবিশ্বাসের গুনাহ মাফ করে দেওয়ার জন্য মনে মনে
আল্লাহর কাছে আরজি পেশ করে। শত-সহস্রবার আল্লাহকে ডাকে।
মেয়েটা বিছানায় পড়ে
রয়েছে। বিছানা বলতে নরম তোশকের ওপর মিহি সুতির চাদর আর তুলতুলে বালিশ নয়, স্যাতসেঁতে ঘরে মাটির ওপর হোগলা পাতা; তার ওপর
তেল-চিটচিটে একটি শতচ্ছিন্ন কাঁথা বিছানো। পুরোনো নেকড়ার পুঁটলিতে তৈরি বালিশ। তাও
জমে ইটের মতো শক্ত হয়ে গেছে।
মেয়ের কথা মনে পড়তেই
সাবিহার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে। আমেনা চাচি বলেছিল ফেরার পথে ওষুধ নিয়ে আসতে।
সাবিহা ফ্যালফ্যাল করে আমেনা চাচির দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। চাচি উপায় বাতলে
দিয়েছিল সাবিহাকে। চালকল-মালিকের কাছে টাকা চাইতে বলেছিল। কিন্তু সাবিহার পছন্দ হয়
না চালকল-মালিককে। অনেক আগেই লোকটার কুৎসিত গালিগালাজ শুনেছে সাবিহা। ধান শুকানোর
মাঠে মুনিদের (শ্রমিক) মা-বোন তুলে কী নোংরা ভাষায়ই-না গাল পাড়ছিল আছরাফ মেম্বর, এমন জঘন্য মুখও কারো হয়। তা ছাড়া লোকটির রকম-সকমও সুবিধার নয়। পুরুষ
মানুষের জাতটাই বুঝি এমন!
স্বামীর কথা মনে পড়ে
সাবিহার। স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সাবিহা, তার স্বামী
শেষ পর্যন্ত এমনটা করবে। তাকে ছেড়ে চলে যাবেÑ এটা কী করে হয়!
লোকটাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে সাবিহা। ভাবতেই পারেনি, তার
ভালোবাসার বাঁধন এত সহজেই ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু বাঁধন ছিঁড়ে গিয়েছিল খুব অল্প সময়েই।
বিয়ের পাঁচ মাস পরেই স্বামীর আসল চরিত্রটা ধরা পড়তে থাকে সাবিহার চেখের আয়নায় ।
মেয়েটা তখন পেটে।
সাবিহা টের পায় তার স্বামীর খারাপ জায়গায় যাওয়ার ব্যাপারটা। তবু মুখ বুজে সব সহ্য
করে সে। না-বোঝার ভান করে থাকে। সংসার টিকিয়ে রাখতে হলে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়।
সাবিহার মনের কোণে ক্ষীণ একটু আশার আলো ঝিলিক মেরে ওঠে। হয়তো সন্তানের মুখ দেখলে
তার স্বামী শুধরে যাবে।
কিন্তু না। সাবিহার
স্বামী আর ঘরমুখো হয়নি। তা ছাড়া কন্যাসন্তানের জন্ম মেনে নিতে পারেনি লোকটা। দিন
দিন সংসারের বাঁধন থেকে আলগা হয়ে গেছে তার স্বামী। তাস খেলা আর মেয়ে মানুষের নেশায়
বুঁদ হয়ে যায়। একদিন ভিটেমাটি বিক্রি করে দিয়ে সাবিহা সর্বস্বান্ত হয়ে শ্রম
বিক্রির জন্য বের হয়। কাজের সন্ধানে ছোটে তারা। গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে লঞ্চে ওঠে।
সারা রাত একটানা চলার পর ভোরে ঢাকা কাঠপট্টি ঘাটে ভেড়ে লঞ্চ।
কাঠপট্টির আকাশ
চিমনির কালো ধোঁয়ায় ছাওয়া। সারি সারি পাকা চিমনি আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে
আছে। এখানে আমেনা চাচির বস্তিতে এসে আশ্রয় নেয়। আমেনা চাচি বেশ কয়েক বছর হয় এখানে
এসেছে। একই গাঁয়ে তাদের বাড়ি। এখন কারোরই বাড়িঘর নেই।
গাটের পয়সা ফুরিয়ে
যাওয়ার আগেই সাবিহার স্বামী কাজ পেয়ে যায় আছরাফ মেম্বারের বয়লারে। বয়লারে ধান
সেদ্ধ করে পাকা চাতালে ধান ফেলার কাজ। এখানে মজুরি মন্দ নয়। বেশ ভালোই কাটতে থাকে
দিন। সাবিহার স্বামীর চোখেও আস্তে আস্তে রং জমতে থাকে। পুরোনো নেশা তাকে হাতছানি
দেয়।
একদিন সাবিহাকে ফেলে
পালিয়ে যায় লোকটি। আর ফিরে আসে না। পরে সাবিহা শুনছে তার দ্বিতীয় বিয়ের খবর। প্রথম
প্রথম খুব কষ্ট হতো এ নিয়ে। নিদারুণ কষ্টে বুকের ভেতরটা ভেঙে যেতে চাইত সাবিহার।
এখন সয়ে গেছে সব। আমেনা চাচিই এই কাজ জুটিয়ে দেয় সাবিহাকে। চালকলে কুড়া ঝেড়ে যে
খুদ বের হয় তার তিন ভাগের এক ভাগ পায় সাবিহা। বাকিটা নেয় আছরাফ মেম্বর।
খুদ ফুটিয়ে জাউ রেঁধে
খায় সাবিহারা। কখনো কখনো বিক্রি করে দিয়ে চাউল কিনে আনে। সাবিহা শুনেছে, আছরাফ মেম্বর এই খুদ তার গরুগুলোকে খাওয়ায়। গরু বনানোর (মোটাতাজাকরণ) কাজ
করে আছরাফ মেম্বর। পশ্চিমা হাড্ডিসার গরুগুলো কম দামে কিনে আনে সে। সেই গরু
খাইয়েদাইয়ে মোটা করে। কোরবানির ঈদের সময় ঢাকার হাটে গিয়ে বনানো গরু বেচে লাখ লাখ
টাকা মুনাফা করে।
বস্তি থেকে আমেনা
চাচির ছেলে এসে ফুলির জ্বর বাড়ার খবর দিয়ে যায়। খুব রাগ হয় সাবিহার নিজের জীবনের
ওপর,
দ্রুত কুড়া ঝাড়তে থাকে সে। মহাজনের কাছে যাবে কি না, সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মেয়েটার জন্য ওষুধ কেনা দরকার। দরদর করে ঘামতে
থাকে সে। ঘামে আর কুড়ায় শরীরে এক পুরু প্রলেপ পড়ে। শরীরের সমস্ত রক্ত আছড়ে পড়ে তার
মাথার ভেতরে। কপালের দু’পাশের শিরা ফুলে ওঠে। বিক্ষিপ্ত অনেক
ভাবনা এসে জড়ো হয় মনের ভেতরে। চালকলের মোটরটার মতো দ্রুত ঘুরতে থাকে মাথা। ঘরে
চাউল-খুদ কিছুই নেই। মেয়েটার জন্য একটা আনারস কিনতে পারলে বেশ ভালো হতো। সাবিহার
আর কিছু ভাবতে ভালো লাগে না।
অনেকক্ষণ হয় মিল আবার
চালু হয়েছে। ধানের কুড়ার একটা কুয়াশা জমেছে মিলের ভেতর। সেই কুয়াশার ভেতর থেকে সাবিহা
বেরিয়ে আসে।
তুষের গুদামে একটা
বস্তার ওপর উদোম পেটে বসে আছে আছরাফ মেম্বর। কাঁধে লাল রঙের গামছা। সাবিহাকে এদিকে
দেখে একটু চিন্তা করে নেয়। এই লাজুক মেয়েটাকে কাজে ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায় না।
গোল্ডলিফের প্যাকেট থেকে একটা সিগ্রেট বের করে প্যাকেটের ওপর ঠুকতে থাকে আছরাফ
মেম্বর। ‘কই রে! ম্যাচটা লইয়া আয়’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। মিলের
সর্দার লুঙ্গির কোচর থেকে ম্যাচ বের করে দেয়। মহাজনের চোখের ভাব দেখে সর্দার কিছু
একটা আন্দাজ করে নিয়ে নিজের কাজে চলে যায়। মহাজন তার কর্কশ কণ্ঠে গান ধরে :
‘তিনখান বিয়া
কইরা আমি পড়ছি মহা ফান্দে
বড় বউরে আদর করলে
মাইজ্যা বউয়ে কান্দে!’সাবিহা কীভাবে টাকা চাইবে বুঝতে পারে না। কেমন এক অচেনা কণ্ঠে সাবিহা টাকা চায়, ‘মেম্বর সাব, মাইয়াডার জ্বর হইছে।’
মহাজন না শোনার ভান
করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছাড়ে। চোখের কোণে একটা হাসির রেখা
আপনা-আপনিই ফুটে ওঠে। সাবিহা দ্বিতীয়বার আর্জি পেশ করতেই আছরাফ মেম্বর খেঁকিয়ে ওঠে, ‘তা জ্বর অইছে আমি কী করুম?’
‘কয়ডা টাকা
লাগবো, মাইয়াডার ওষুধ কিন্না দিমু’Ñ সাবিহা
জানায়। মহাজন তার স্বভাবসুলভ মুখের খিস্তি ছোটায়, ‘আমি কি তর
ভাতার, যে চাইলেই টাকা দিমু।’
কী বলবে সাবিহা, অপমানে লাল হয়ে যায় তার মুখ। যে পথে আসছিল সে পথেই আবার ফিরে যেতে উদ্যত
হয়। আছরাফ মেম্বর সাবিহাকে ডাকে- ‘সাবিহা হুইন্না যা। এই
হানে আয়।’ সাবিহা জড়পদার্থের মতো আছরাফ মেম্বরের সামনে আসে।
আছরাফ মেম্বর সাবিহার কুড়ার আস্তরণে ঢাকা দেহের ভাঁজে চোখ বুলিয়ে নেয়, ‘কুড়া দিয়া করছসটা কী শরীলডারে,’ কণ্ঠে কৃত্রিম
ভালোবাসার স্বর আছরাফ মেম্বরের, ‘টেহা লাগবো নে।’ পঞ্চাশ টাকার তিনটা লাল নোট লুঙ্গির গাঁট থেকে বের করে সাবিহার হাতে তুলে
দেয়। তার পরই গুদামের দরজায় শেকল তুলে দেয়।
সাবিহার মাথা চালকলের
মোটরটার মতো ঘুরতে থাকে বোঁ বোঁ করে। যেন তাকে আখ মাড়াইয়ের কলে ফেলে দিয়েছে কেউ।
যেন অনন্তকাল ধরে তাকে আখের ছোবড়ার মতো পেষা হচ্ছে। আছরাফ মেম্বরের
তপ্তশ্বাস-প্রশ্বাস বিষময় লাগে সাবিহার কাছে।
লাল নোটগুলো হাতে
নিয়ে গুদাম থেকে বের হয় সাবিহা। গুদামের পাশে কু-লী পাকিয়ে শুয়ে আছে একটা মাদি কুকুর।
সম্ভবত একটু আগে কোনো কুকুরের তাড়া খেয়েছিল। সাবিহার মাথায় মাদি কুকুরটার ছবি
স্থায়ী হয়ে যায়। কুকুরটার সঙ্গে কোথায় যেন নিজের একটা মিল খুঁজে পায় সে। আবার
একরাশ ভাবনা তার মাথায় ভিড় করে। ফুলির কথা মনে পড়ে। অসুস্থ মেয়েটা বিছানায় পড়ে
আছে। বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। দু চোখ ছাপিয়ে নোনা জলের বন্যা বয়ে যায় তার।

===============
রুমী কবিরের গল্প প্রতিশোধ
রুমী কবিরের গল্প প্রতিশোধ
ঘরে ঢুকে জরিনা ঢক ঢক
করে গ্লাসের পুরো পানি শেষ করে ফ্যালে। তারপর ভেজা কাপড় পাল্টে নেয়। গামছাটাকে
রশির মতো করে পিঠের চুলগুলোকে ঝেড়ে নেয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের কাঠ ফাটা রোদে হাঁপিয়ে ওঠে
জরিনা। ও’
ঘরের কোণ থেকে তালের পাখা এনে মেঝেতে বসে হাওয়া খেতে থাকে।
ওদের বস্তি ছাড়িয়ে
পানি আনতে কম পথ হাঁটতে হয় নাকি? সামনের দোকান–পাট পার হোয়ে ছোট্র বাজারটা, তারপরও বেশ কিছু পথ
হেঁটে তবে তো পানির সন্ধান!
জরিনা এতদূর প্রতিদিনই যায়। টলমলে পানির ডোবায় গোসল
সারে, পাশের টিউবঅয়েল থেকে খাবার পানি নেয়, তারপর একহাতে কলস আর অন্যহাতে আশপাশ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া খড়কুটো যা পায়,
তাই নিয়ে এভাবে প্রতিদিন ভেজা কাপড়ে আঁটসাট হোয়ে ছপছপ শব্দ তুলে ঘরে
ফেরে জরিনা।

জরিনার বুকের ভেতরটায়
আজ হু হু করে ওঠে কী এক যন্ত্রণায়। বাবা-মা, ভাইবোনদের
অনুপস্থিতিটা আজ উথলে পড়া জোয়ারের মতো নাড়া দিয়ে ওঠে। কতদিন হয় ও’ ঢাকায় এসেছে? একমাস হোয়ে এল বুঝি! অথচ এরই ভেতর জরিনার ছুটে যেতে ইচ্ছে করে
গ্রামের ছায়া-ঘেরা মাটিতে। উঠোন থেকে নেড়ে দেয়া ধান ঝেড়ে ঘরে তোলা, সন্ধ্যায় গোয়াল-ঘরে গরুগুলো ছোট ভাইটা এনেছে কিনা, তার
খোঁজ –খবর নেয়া, সারাদিনের কাজ শেষে
বাড়ির পেছনের পুকুরে গোসল করা- একে একে সব স্মৃতি জরিনার চোখের সামনে সিনেমার
পর্দার মতো ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে উন্মাতাল যুবক কলিমের ছবি। গ্রামের মোড়লের ডান হাত
রহিমুদ্দিনের ছেলে কলিম, যে কিনা টো টো করে ঘুরে বেড়াতো সারা
গাঁয়ে, এগাছের সে গাছের আম, কাঠাল,
নারকেল পেরে খেতো দল বেঁধে, সেই দামাল
ছেলেটাকে কি করে যে জরিনা ভালবেসেছিল ভাবতেই পারেনা। উত্তাল যৌবনের স্রোতে ভেসে
একরাতে ঠিকই চলে গিয়েছিলো কাজী বাড়ি। তারপর শেষ রাতের ট্রেনে চেপে সবাইকে ফাঁকি
দিয়ে রাজধানীর এই বস্তিতে। পাশের গ্রামের রুস্তম, ঢাকায়
রিক্সা চালায়, নবদম্পতি প্রথমে এসে ওর ঘরেই উঠেছিলো। তারপর
রুস্তমের ঘরের পাশেই আরও একটি ছাপরা ঘর তুলেছে।
এই মুখ নিয়ে জরিনা কি
করে ফিরে যাবে বাবা-মার কাছে! আদর্শ স্কুল মাস্টার বাবা কি এত সহজেই মেনে নেবেন
তাকে?
আর এতদিনে গ্রামে কি এই নিয়ে হৈচৈয়ের কিছু বাকী আছে ? অথচ জরিনা সব জলাঞ্জলী দিয়ে কিসের মোহে যে কলিমের জীবন সাথী হয়েছে,
ও’ এখনো তা বুঝে উঠতে পারে না। শুধু বুঝে
এইটুকুই, এর নাম ভালোবাসা।
বস্তির পাশ দিয়ে গলির
মতো রাস্তা গেছে একটা। ভাঙা-চোরা ইটের খোয়া আর জায়গায় জায়গায় বিটূমিন পিচ ঢালা
রাস্তাটা কিছুদূর গিয়ে টঙ্গী ডাইভারসন রোডের সাথে মিশে গেছে। রাস্তার ধারের একটা
কাঁঠাল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে পাশের ঘরের টেপীর মা’টা
কার সাথে যেন ঝগড়া করছে অশ্লীল ভাষায়। জরিনা ঘরের দরজার খুঁটীতে হেলান দিয়ে বসে
থেকে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। তারপর একসময় রিক্সার ক্রিং ক্রিং শব্দে সম্বিৎ ফিরে পায়
জরিনা। রিক্সাটা জরিনার ঘরের কাছে এসে থেমে যায়। রুস্তম এসেছে। নিত্যদিনই ও’
এসময়টাতে ফিরে আসে। নিজের রিক্সা বলে বাঁধাহীন নিয়মে চলে। দুপুরে
চারটা ডাল ভাত রেঁধে খেয়ে দেয়ে আবার বের হয় খুশীমতো। বিয়ে- থা করেনি, ছিমছাম ঝামেলাহীন জীবন। কী প্রশান্তি রুস্তমের ! কলিমেরও তো এমন হতে পারতো,
যদি না জরিনাকে বিয়ে করতো! বেচারা কলিম, সারাটা
রাত কাটে নিদ্রাহীন, সেতো জরিনার সুখের জন্যেই!
রুস্তম রিক্সাটা রেখে
জরিনার ঘরের পাশে এসে দাঁড়ায়। পলিথিনে ঢাকা ঘরের চালের উপর হাত রেখে উদাসী জরিনার
দিকে তাকায়। কপালের জমে থাকা ঘাম মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে, “বাবি (ভাবী) কি করতাছো?”
জরিনা গম্ভীর হয়ে বসে
থাকে। কোন কথা বলে না। একবার দুচোখ তুলে রুস্তমকে দেখে। তারপর গায়ের শিথিল কাপড়
ঠিকঠাক করে নিয়ে নড়েচড়ে বসে। অসহায় দৃষ্টি ছুঁড়ে দ্যায় ঘুপটি মেরে থাকা গাছগাছালির
দিকে।
রুস্তম অবাক হয়ে বলে, “কি অইছে? কলিম মারছে নাহি? ও
হালায় মারবই তো! হালার রকম সকম দ্যাকতাছি কয়দিন দইরা...” বকবক
করতে করতে হঠাৎ থেমে যায় রুস্তম। জরিনার দিকে তাকায়। অসহ্য গরমে জরিনার নাক,
কপাল, গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে চিকচিক করছে
মুক্তার মতো। পিঠ ছাপিয়ে ভেজা চুল মাটি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে আছে। রুস্তমের চোখে ভরা
যৌবনের শ্যামলা চেহারার জরিনাকে আজ বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়। এধরনের যুবতী মেয়েদের যে
বস্তিতে একা থাকা মোটেও নিরাপদ নয়, এই উপলব্ধিটা রুস্তমের
কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে।
জরিনা নিরুত্তাপ
তখনও। রুস্তমের কাছে ব্যাপারটা গোলমেলে
মনে হয়। ও’ জরিনার পিঠের পাশ দিয়ে দরজার ভেতর মাথাটা
গলিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতরটা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি দিয়ে দেখে। ঘরের এক কোনায় পানির কলস,
তার পাশে বেড়ার ধার ঘেঁষে মোড়ানো বিছানা, অপর
পাশে কারুকাজ করা টিনের সুটকেস, মাটির সানকী, গ্লাস, রশিতে
ঝুলানো লুঙ্গী, ময়লা গেঞ্জি, ছাপা শাড়ি,
লাল রঙের ব্লাউজ। রুস্তম নজরে পড়ার মতো কিছুই দেখে না।
জরিনার চোখে বানের
মতো জল এসে গেছে ততক্ষণে। রুস্তম তখন কী যেন একটা কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। সহজ
সরল মেয়েটির উপর কিসের এক মায়া এসে ভর করে। ও’ ধীর গলায়
বলে, “বাবি বাত চড়াও নাই এহনও?”
“চাইল নাই”। জরিনার হিমশীতল কণ্ঠ।
রুস্তম তখন সান্তনার
কথা বলে,
“অ, এই কতা! ঠিক আছে বাবি, কুনো অসুবিদা নাই, আইজ আমিও রানতাছি না। হইঠাল থাইকা
বাত কিন্যা আনমু। তুমি আর আমি আইজ মিল্যা মিশ্যা খামু”। একটু
দম নিয়ে আবারও বলে, “চিন্তা কইরো না বাবি, আমি ঐ হালার কলিম্যারে দেইহা ছারমু ! বউ ফালাইয়া যে কই থাহে বুজামু হালারে”!
বলতে বলতে রুস্তম মাঝেমধ্যেই যে কাজটা করে থাকে, আজও সেভাবেই খুব কাছাকাছি হয়ে জরিনার চিবুকে হাত রেখে অভয় দেয়ার চেষ্টা
করে। কিন্তু জরিনার কাছে আজ ব্যাপারটা সাহেবদের বাসার ঘটনার মতো মনে হতেই রুস্তমের
হাতটা সরিয়ে দেয় এক ঝটকায়। দুদিন আগে টেঁপীর মা’র যখন অসুখ
ছিল, তখন তার বাসন মাজা, কাপড় ধোঁয়ার
কাজগুলো করে দিতে গিয়েছিলো জরিনা। অথচ বাসার সাহেবটি খালি বাসা পেয়ে ও’কে প্রায় বিছানায় নিয়ে গিয়েছিলো।
ঠিক রুস্তমের মতো করেই চিবুকে হাত রেখেছিলো শয়তানটা। ঘটনাটার কথা মনে পড়তেই
জরিনা আজ শরীরটাকে পিছিয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “অইছে যান এহন !
অত দরদ দেহান লাগবো না”। ঝাঁজ মেশানো তীর ছুঁড়ে ও’ ঘরের ঝাঁপ ঠেলে দিয়ে বন্ধ করে দ্যায়।
রুস্তম থ’ হয়ে কয়েক
মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ও’র ঘরে চলে যায়।
শুয়ে থেকেও স্বস্তি
পায়না জরিনা। বুকের ভেতরতায় শুধু অস্থির অস্থির লাগে। রুস্তমকে অমন করে অপমান
করাটা কি ঠিক হলো ? কলিমের অনুপস্থিতিতে সে-ই তো
একমাত্র ভরসা। গতরাতের কথা মনে হয়। ও’র একাকী রাত কাটানোর কথা কারা যেন টের পেয়েছিলো। আর তারই সদ্ব্যবহার করতে
এসেছিলো। ঘরের চারদিকে শুধু খামচাখামচি করেছে কুকুরের মতো। ফিসফিস করে দর কষাকসিও
করেছে। জরিনা তখন অজানা ভয়ে শিউরে উঠেছে থেকে থেকে। শেষে চিৎকার করে রুস্তমকে ডেকে
আনাতেই না পালিয়েছে তারা। বাকী রাতটুকু তো রুস্তম ও’র ঘরের
পাশে বসেই কাটিয়েছে। অথচ এই লোকটার মনেও কি সাহেবদের মতো ইচ্ছে-টিচ্ছে থাকতে
পারে! ভেবে কুল পায়না জরিনা।
দুপুর পেরিয়ে যায়।
কলিম আসে না তবু। ঘুম কামাই দিয়ে কোথায় যে ঘুরছে কে জানে! রুস্তমের কাছ থেকে
কটা টাকা ধার নিলেই হতো! অথচ তা
করবেন না গুনধর সাহেব, দাম কমে যায় নাকি!
জরিনা পাশ ফিরে শোয়।
পাখা দিয়ে জোরে বাতাস করে গায়ে। গা থেকে কাপড় সরিয়ে ফ্যালে। ঘামে ভেজা ব্লাউজটাও
খুলে রাখে। নিজেকে একবার দেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। নিজ দেহের লাবণ্য ও যৌবনের অনুভুতি তাকে পুলকিত করে তোলে।
কলিমের সান্ন্যিধ্য পেতে ইচ্ছে করে। অথচ চাকরীটা পাবার পর থেকে কলিমেরও যে কি
হয়েছে,
রাতে কাজ আর দিনে ঘুম ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। লোকটা কি এইভাবে
একেবারেই শান্ত হয়ে গেলো? জরিনা এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে একসময়।
জরিনার যখন ঘুম
ভাঙ্গে,
তখন সন্ধ্যেটা যাই যাই করছে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলো থেকে
গানের রেকর্ড বাজছে দুন্দুভিতালে। আশপাশের ঘরগুলোতে দিনের শেষের ব্যস্ততা। কারো দুধের
বাচ্চা কাঁদছে। জরিনার ঘরে তখন আধো আলো আধো অন্ধকার।
ওঠে বসে জরিনা। সহসা
দেখে ঘরের দরজা একেবারেই খোলা । কলিম এসেছিলো কি তবে? জরিনা গায়ের কাপড় জড়িয়ে ঘর থেকে বের হবার মুহূর্তেই নজরে পড়ে ঢাকা দেয়া
বাসন। ও’ এবারে নিশ্চিন্ত হয়। রুস্তম খাবার দিয়ে গেছে। ঘুমিয়েছিল
বলে ডাকেনি । জরিনার তখুনি এক অদ্ভুত লজ্জা এসে ভর করে। তবে কি রুস্তম ও’র খোলামেলা দেহ, নগ্ন বক্ষ এসব দেখে গ্যালো ? ছিঃ ছিঃ , ও’
কি করে রুস্তমের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে এখন? এক
ধরনের অস্বস্তি নিয়ে জরিনা ঘরের বাইরে আসে এবং ফের ঘরে ঢুকে
পানির বদনাটা নিয়ে বের হয়।
এক সময় রুস্তম আসে
ক্লান্ত দেহ নিয়ে। রিক্সাটা ঘরের পাশে রেখে হাত-মুখ ধোয়। জরিনা ও’র ঘরের দরজায় বসেছিল, রুস্তম ও’কে দেখে গামছা দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে ও’র দিকেই আসে
এবং জিজ্ঞেস করে, “বাবি, বাত খাইছো ?”
জরিনা ম্লান হেসে মাথা নীচু করে থাকে।
রুস্তম আবার কথা বলে,” কলিম আইছে?”
জরিনার তখন কি যে হয়! পাহাড় সমান ব্যথা এসে ও’কে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যায়।
কাঁদস্বরে বলে, “না, হেই বিয়ানে গেছে,
এহনো কুনো খুজ নাই!” বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে
ফ্যালে। আঁচলে দুচোখ মুছে। পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মাটি খুঁচিয়ে তোলে। রুস্তম তখন
ভাবতে থাকে। গতরাতের ঘটনাটা মনে পড়ে। জরিনা একাকী কি করে বস্তি পাড়ায় থাকে?
বস্তিতেও যে কত রকমের বাজে কাজ চলে, একথা কি
জানে জরিনা ? অথচ
কলিমটা কি করছে আজকাল! আর ভাবতে পারে না।
ও’ জরিনাকে জিজ্ঞেস
করে, “কাইল তো পাহারা দিলাম, আইজ রাইতে
থাকবা ক্যামনে?”
জরিনা কথা বলে না।
রুস্তম আবার প্রশ্ন করে, “আইচ্ছা বাবি, কলিম কুন অফিসে কাম করে কইতে পারো?”
জরিনা সেটা কি করে
জানবে?
ও’ মাথা নেড়ে “না”
সূচক ইঙ্গিত করে।
“আমি জানি” রুস্তমের গলার স্বর ধীর এবং শান্ত, “হে তো এহন হেই
জাগাতেই আছে। ডিউটির সময় অইয়া গেছে না !” শেষের কথাটি বেশ
তিরস্কারের সাথেই বলে রুস্তম।
লম্বা করে একটা দম
নেয় রুস্তম। কিছুক্ষণ আগে একটা সিগারেট জ্বালিয়েছিল, ওটা
এতক্ষণে প্রায় নিঃশেষ হয়ে ছোট হয়ে এসেছে, রস্তম ও’তে জোরে একটা সুখটান দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে
ফ্যালে আবারও ভাবে কিছুক্ষণ। এইভাবে কয়েক মুহূর্ত চিন্তায় ডুবে থেকে শেষে
বলে, “যাইবা আমার লগে তার অফিস দেখতে?” তারপর ক্রোধে গিজ গিজ করতে করতে নাটকীয় ভঙ্গিতে উচ্চারণ করে, “খু-উ-ব সুন্দর অফিস, আমিও খুজ পাই নাই আগে”।
শুনে জরিনা উচ্ছ্বসিত
হয়ে ওঠে,
যেন অকুল পাথারে হারিয়ে যাওয়া জাহাজের কুল খুঁজে পাওয়া। ও’ যাবে ও’র প্রানের মানুষকে দেখতে।
রুস্তমের রিক্সাটা
ছুটে চলে পংখিরাজের মতো। আরোহী জরিনা। রিক্সাটা কারোয়ান বাজার রেল গেটের কাছে এসে থেমে যায়। রুস্তম নামে, জরিনাকেও নামতে ইশারা করে। রিক্সাটা রাস্তার পাশের একটা গ্যারেজের কোনে রেখে রস্তম জরিনার এক হাত আগলে
ধরে রেল লাইনের উপর গিয়ে ওঠে। তারপর হন হন করে ছুটে চলে ওরা। এসময় এশা নামাজের
আজান শুনে। জরিনার বুকটা তখন ধুক ধুক করছে দ্রুততালে। কখন পৌঁছবে সে স্বামীর
অফিসটায় ? ও’কে দেখে কলিম চমকে যাবে
নাতো ?
“বাবি আমরা
আইসা গেছি”, ফিস ফিসিয়ে বলে রুস্তম। জরিনা থমকে দাঁড়ায়।
রুস্তমকে অনুসরণ করে। রুস্তম রেল লাইন থেকে এবারে নেমে পুব দিকে হাঁটে। কিন্তু
জরিনা কোন অফিস দেখে না। ও’ এবার অবাক হতে থাকে। ভয়ে সংকুচিত
হতে শুরু করে ধীরে ধীরে। রুস্তমের কি তবে অন্য কোন মতলব আছে? জরিনার বুকে সংশয়।
এখানে শুধু বস্তি।
জরিনারা যে বস্তিতে থাকে তাঁর চেয়েও খারাপ। ঘরগুলোর ভেতর থেকে টিমটিমে বাতি
জ্বলছে। কারো বাচ্চা কাঁদার শব্দ। কেও রাঁধছে বাইরের উনুনে। রুস্তম নিঃশব্দে একটা
ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে জরিনাকেও
টেনে নিয়ে যায়। জরিনার তখন হাত কাঁপছে। কাঁপছে সারা দেহ। রুস্তম ঘরটার কাছে পৌঁছে
বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে আগে উঁকি দিয়ে কিছুক্ষণ দেখে নেয়। তারপর জরিনাকে ফিস
ফিসিয়ে বলে দেখার জন্যে। জরিনা নিঃশব্দে তাই করে এবং মুহূর্তের মধ্যেই কী যে হয়
তার! আগুন ঝরা চোখে বেড়ার কাছ থেকে ও’ ক্ষণকালের মধ্যেই সরে আসে। থরো থরো কাঁপে পা। কিসের এক দাবদাহ জ্বলজ্বল
করে চোখে। জরিনা একবার স্থির দৃষ্টিতে রুস্তমকে দ্যাখে। তারপর ও’র এক হাত প্রচণ্ড ক্ষিপ্রটায় মুষ্টিতে চেপে ধরে জরিনা নিজ গন্তব্যের দিকে
ছুটে যায়।
রিক্সায় বসে জরিনা
আবারও ঐ দৃশ্যটার কথা ভাবে। পরনারীর সাথে গায়ে গায়ে জড়ানো কলিম! জরিনার সাথে যেমন
করে জড়িয়ে জড়িয়ে নিবিড় মুহূর্তে তলিয়ে যেত ঠিক তেমন দৃশ্যটি ও’কে কেন দেখতে হল ভিন্ন এক যুবতীর সাথে? মেয়েটি কি
তবে শেফালী ? ওদের গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী কিশোরী ছিল শেফালী।
গরীব বাবা-মার ঘরের চঞ্চলা রূপবতী শেফালী
তখন কলিমকেই পাগলের মতো ভালোবাসতো। কিন্তু
কলিম ব্যাপারটিকে সেসময় পাত্তাই
দেয়নি। কারণ কলিমের মনটা তখন পড়ে থাকতো জরিনার জন্যে। অথচ মোড়লের ছেলে একরাতে
সেই মেয়েটিকে নিয়ে জোর করে ব্যাভিচারে
লিপ্ত হলে পরদিনই সারা গায়ে জানাজানি হয়ে গিয়েছিলো। শেষে বাচারী শেফালী চোখের জল
ফেলতে ফেলতে হঠাৎ একদিন সবার অজান্তে গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। জরিনার চিনতে ভুল হচ্ছেনা। এখন ঠিক ঠিক বুঝতে
পারছে ঐ মেয়েটিই শেফালী। কিন্তু কলিম ও’র খোঁজ পেলো কিভাবে ?
কলিম কি তাহলে জরিনাকে আর ভালবাসে না ? একটা
দমকা হাওয়া এসে জরিনার চূলগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে যায়। জরিনা আর ভাবতে পারে না।
ঘরে গিয়ে জরিনা হাতের
চুড়ি ভাঙে একে একে সব। কপালের টিপ মুছে ফ্যালে মুখের থু থু দিয়ে। তারপর মেঝেতে
গোছানো বিছানায় পড়ে গড়াগড়ি যায়। হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে বালিকাদের মতো। আশপাশের
ঘরগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে তখন। রূপকথার নিঝুম পুরী যেন গোটা বস্তিটা। বাইরে ঝিঁ
ঝিঁ পোকার শব্দ একটানা। দুরের একটা ঘর
থেকে রমজান পাগলার গোঙরানির আওয়াজ। জরিনার কান্না হেচকি দিয়ে দিয়ে থেমে আসে একসময়।
কিন্তু চোখে তার ঘুম আসে না। মগজের স্নায়ুগুলো শুধু লাফালাফি করে প্রতিহিংসায়।
জরিনার মাথায় হঠাৎ কি
যেন খেলে যায়। ও’র সারা শরীর নাড়া দিয়ে ওঠে
দ্বিগুণ ক্ষোভে, প্রতিবাদে। ও’ ঘর থেকে
বেরিয়ে আসে। রুস্তমের ঘরের দরজাটা এক ধাক্কায় খুলে ফ্যালে প্রচণ্ড শক্তিতে। রুস্তম
জেগে ছিল তখনও। ও’ জরিনার ক্ষিপ্র মূর্তি দেখে চমকে ওঠে। ক্ষীণ
আলোয় জরিনার দেহ থেকে একে একে সব কাপড় খুলে যাওয়া দেখে রুস্তম। উন্মাতাল নগ্ন
জরিনা তখন রুস্তমের উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্তনাদ করে ওঠে, “ আমি শুধ নিবার চাই রুস্তম বাই! আমারে ঠেইলা দিও না! আমি শুধু নিমু!
প্রতিশোধ!”
শুয়ে থাকা রুস্তম এক
ঝটকায় জরিনাকে বুকের ওপর থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর বিছানা থেকে নিজেও সরে এসে হাঁটু
গেড়ে বসে। রুস্তম তখন জিঘাংসা, রিরংসা, আকাংখা আর হতাশার এক মিশ্র প্রতিচ্ছবি দেখে জরিনার চোখে মুখে। এই প্রথম
নারীদেহের নগ্নতা দেখে সে। রুস্তমের বিছানায় চিত হয়ে নেতিয়ে পড়ে আছে জরিনা। নগ্ন
সুডৌল উঁচু বক্ষ ঘন ঘন নিঃশ্বাসের সাথে উঠানামা করছে। রুস্তমকে কাছে পাবার আকুলতা
নিয়ে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে জরিনা। মুহূর্তেই রুস্তমের সারা শরীর জুড়ে এক
অজানা শিহরণ চনমন করে ওঠে। ও’র কি করা উচিত এখন ? ও’
কি জরিনার আহবানে সাড়া দিয়ে ও’কে সাহায্য করবে ? তাতে সেও
তো শারীরিক ক্ষুধা মেটানোর এক নতুন অভিজ্ঞতার আস্বাদ পাবে! রুস্তমের বুকের ভেতর ঢিব ঢিব করতে থাকে। কিন্তু
মুহূর্তেই ও’র মগজের স্নায়ুগুলো আবার ভিন্ন দিকে ধাবিত হয়।
খুব চাপা স্বরে ও’ তখন
হিস হিসিয়ে ওঠে,”তুমার কি মাথা খারাপ অইছে ? এইডা কি করতে চাইতাছ? কলিম না তুমার বিয়া করা
স্বামী”?
জরিনা তখন বসে থাকা
রুস্তমকে আবারও দু’হাত দিয়ে হেঁচকা টানে ও’র বুকের কাছে নিয়ে আসে। রুস্তমের গালে, মুখে ,নাকে নারী বক্ষের নরম-উষ্ণ উঁচু অংশের স্পর্শ লাগতে থাকে। ও’র শরীরে তখন আবারও শিহরণ দেয়। এবারে যেন বিদ্যুতের ঝলকানির মতো শরীরের
উত্তাপও বেড়ে যায়। সেই সাথে শ্বাস প্রশ্বাসের উঠানামাও বেড়ে যায়। কিন্তু আবারও
বিবেকের দংশন! কোনদিকে যাবে রুস্তম? জরিনার সান্নিধ্যে
নাকি বন্ধুর স্ত্রীকে যথাযথ সম্মানের সাথে দেখভাল করার দায়িত্ব পালন?
এরই মধ্যে জরিনা
রুস্তমের পিঠে দু’হাতের স্পর্শ দিতে দিতে থাকে।
কখনো চুলে, কখনো গলার আশপাশে নারী দেহের নরম আঙ্গুলের স্পর্শ
রুস্তমকে ক্রমশঃই অথৈ সাগরে তলিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। জরিনার ফিস ফিস কণ্ঠ বেজে উঠে
তখন, “শেফালীর সাতে যার এত ঢলাঢলি, আমি
মইরা গেলেও তো তার ঘর আর করতাছিনা
না! এইডাই আইজকা ফাইনাল রুস্তম বাই।
তুমি আমারে ফিরাইয়া দিও না দয়া কইরা!”
কিন্তু রুস্তম এবারও
মুহূর্তের মধ্যেই যেন প্রচণ্ড এক শক্তিতে নিজেকে দমন করতে সক্ষম হয়। জরিনার
দেহ-স্পর্শ থেকে নিজেকে ক্ষিপ্র গতিতে মুক্ত করে বিছানা থেকে উঠে সোজা দাঁড়িয়ে
যায়। তারপর ধীর কণ্ঠে বলে, “তুমি আইজ রাত ভইরা চিন্তা
করো জরিনা, তুমি আসলে কি করতে চাও! মাথা গরম কইরা কিছু করা
ঠিক না, আমি তো পাশেই আছি, চইলা
যাইতাছিনা তো!”
রুস্তম সহসা জরিনাকে
আর ‘ভাবী’ সম্বোধন করতে পারেনা। আপনাতেই মুখ থেকে ‘জরিনা’ নামটিই উচ্চারিত হয়ে যায়। তবে কি রুস্তম জরিনাকে ভালবাসতে শুরু করেছে? সত্যিকার অর্থে রুস্তমের তখন আর
কোন কিছুই ভাববার সময় নেই। একটা কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি সে আজ। এই পরীক্ষায় তাকে
পার হতেই হবে।ও’ এক ঝলকে ঘরের দরজা খুলে হুর মুর করে বেরিয়ে যায়।
আকাশের দক্ষিণ-পশ্চিম
কোণে কয়েক খণ্ড মেঘ স্থির জমাট হয়ে ছিল বিকেলের দিকে। তা এতক্ষণে আরও বড় ক্যানভাসে
সারা আকাশ ছেয়ে ফেলে। মুহূর্তেই শীতল দমকা হাওয়া এসে অবাধ্যের মতো ঢুকে পড়ে বস্তির
ফাঁক ফোঁকর দিয়ে। সেই সাথে ধুলো বালির অশান্ত ঝাপটা। বিদ্যুৎ চমকায় থেকে থেকে।
মেঘে মেঘে ঘর্ষণে গুরু গুরু গর্জন, বৃষ্টি
বর্ষণের কথা জানিয়ে দেয় দীর্ঘদিন পর।
একটা দীর্ঘ শ্বাস
নিয়ে শ্রান্ত, ক্লান্ত, নিঃসাড় জরিনা তখন চিত হয়ে পড়ে থাকে
ভাবলেশহীন বরফ-ঠাণ্ডা মাছের মতো। দেখে ঘরের চাল। চালের ফুটো দিয়ে আকাশ দ্যাখে।
আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি। নেতিয়ে পড়া জরিনার দুচোখ বুজে আসে। ঝর ঝর করে কয়েক ফোঁটা
জল চোখের দু’ধার দিয়ে নেমে এসে কানের পাশ ঘেঁষে বিছানায় গিয়ে
পড়ে।
দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ওঠে নগ্নদেহী অতৃপ্ত দুখী জরিনা।
================
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর গল্প মাউসট্র্যাপ

A mousetrap is a specialized type of animal trap designed primarily to catch mice; however, it may also trap other small animals….
রাত আটটার দিকে একটা
শব্দ হয় আবার হয় রাত দশটার দিকে। কখনো কাপবোর্ডের ভেতর থেকে কখনো আবার ওয়ার্ডরোবের
ভেতর থেকে। কাপবোর্ডের ভেতর থেকে শব্দটা কড়মড় করা বিস্কুট ভাঙ্গার শব্দ। দশটায়
মোহনা বিছানায় একটু হেলান দিয়ে বসছিল মাত্র। ওয়ার্ডরোব থেকে আসা একটা লাফ দেয়ার
শব্দ শুনেই সেও লাফ দিয়ে ওঠে। স্লাইড ডোরটা একদিকে নিতেই ইঁদুরের চোখটা ভেসে আসে।
ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন তাকে ধমকাচ্ছে। মোহনা বলে হিস হিস।
ইঁদুরটা তখন দৌড়ে পালায়। মোহনা কাপড় চোপড় নেড়ে দেখে কোথায় গেছে। এত সুন্দর দামী
দামী কাপড়। মাত্র সে ঢাকা থেকে কিনে এনেছে। কয়েক বছর চালাতে হবে। সে চিৎকার করে
ওঠে। হিস হিস। তবু ইঁদুরটাকে আর পাওয়া যায়
না। ইঁদুরটারে কেন ধরা যাচ্ছে না এটি ভেবে ভেবে মোহনার আরাম হারাম হয়ে গেছে। এখানে
সেখানে ইঁদুরেরা হাগা দিয়ে পুরো বাড়িটাকে নোংরা করে ফেলেছে। মোহনা এমনিতেই খুব
পরিস্কার পরিচ্ছন্ন মানুষ। সবসময় ঘরবাড়ি গোছগাছ করে রাখা তার প্রিয় বিষয় নয় শুধু, এটি তার অবশেসন। যা করবে সে একদম হাণ্ড্রেড পারসেন্ট। তার গোছানোতে কোনো
ধরনের ফাঁকি নাই। এই রকমই ভাবে ইরতিজা। মাঝে মাঝে সে মোহনাকে ডাকে পরিবেশ মন্ত্রি
বলে। ওরা এই বাড়িটা ভাড়া নেয়ার আগে এই ছোট
শহরে তন্ন তন্ন করে অনেক বাঁড়ি খুজেছে। মোহনা অনেক আগ থেকেই তার চেনা জানা রিয়েল
এস্টেট এজেন্টদেরকে বলে রেখেছিল। স্টেশনের কাছে, বাচ্চা
কাচ্চাদের স্কুলের কাছে একটা বাড়ি তার চাই। খুবই সুবিধা হবে এতে। বিশেষ করে
আদিবার। আদিবা দূরে একটা হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে। প্রথমবারের মতো দূরে যাচ্ছে।
কয়েকটা সাবার্ব পরেই তার স্কুল। ট্রেনে করে গেলে সে পনের বিশ মিনিটেই স্কুলে চলে
যেতে পারবে। এমন না যে ইরতিজা গাড়ি ড্রাইভ করতে পারে না। আসলে তার সময় নাই যে
মেয়েটাকে স্কুলে ড্রপ দিবে। সে সকালে বের হয় আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। মোহনা এখনো
লাইসেন্স পায়নি। স্টেশনের কাছে একটা বাড়ি পাওয়া গেলে মেয়েটা আরামে স্কুলে যেতে
পারবে। অন্য দুটো বাচ্চাও বাড়ির পাশের পাবলিক স্কুলে হেঁটে হেঁটেই যেতে
পারবে। একরম ভাবতে ভাবতে মোহনা একটা রিয়েল স্টেটের সাথে কথা বলে একটা বাড়ির খোঁজ
পায়। সে তাড়াতাড়ি ইরতিজাকে ফোন করে।
-হ্যালো একটা
বাড়ি পাওয়া গেছে। তুমি কি আসতে পারবা?
-এখনই?
ওপাশ থেকে ইরতিজা।
-এখনই আসো।
ডেভিড ফোন করছিল। আমাদের রাস্তার উল্টা দিকে পেট্টল স্টেশনের ডান দিকে একটা বাড়ি
পাওয়া গেছে। সুন্দর। শোনো দেরি করলে কিন্তু আর পাওয়া যাইব না। জাননা এখন বাড়ির কত
ডিমাণ্ড।
বসকে বলে ইরতিজা
তড়িঘড়ি করে বাসায় চলে আসে। রাস্তায় অবশ্য আবারো মোহানার ফোন পায় -হ্যালো হ্যালো
তুমি এখনো আসো নাই। ব্রিজটা পার হইছ? ওরা তো বইসা
রইছে। ইরতিজা তো উড়াল দিতে পারে না। সে একটু স্পিড করেই চলে আসে। এজেন্টের হিসাব মতে
বিশ বাইশ বছরের পুরনো বাড়ি। চারটা রুম। একটা টয়লেট। একটা ছোট গ্যারেজ। সামনে পেছনে
বড় ফাঁকা জায়গা। ইচ্ছা মতো গাছপালা শাক সবজি লাগানো যাবে। সবচেয়ে ভালো যে একটা দৌড়
দিয়ে স্টেশনে যাওয়া কোনো ব্যাপারই না। লম্বা খোলামেলা একটা রাস্তা বাড়ির সামনে
দিয়ে চলে গেছে। যার বুক ধরেই সেদিকে যাওয়া যায়। দশমিনিটের মতো হাঁটা। ইটস রিয়েলি এ
স্টোন থ্ররো...।
মোহানারা যে এই
বাড়িতে উঠল তা আজ চার পাঁচ বছর হয়ে গেল। একটা নির্জন জায়গাতে তাদের বাড়ি। নো থ্রো
রোড। মানে গাড়ি টাড়ি এই রাস্তার সামনে দিয়ে অন্যদিকে যেতে পারবে না। বড় মেয়েটা
ছাড়াও ওদের আরো দুটি ছেলে মেয়ে আছে। মাঝে মাঝে ছোট ছেলেটা আরো কয়েকটা ছেলের সাথে
বাড়ির সামনে ক্রিকেট খেলে। মোহানা কোনো চিন্তা করে না। গাড়ি ঘোড়া তো এদিকে দিয়ে
পার হবে না। তার মনে আছে বাড়িটা পাওয়ার পরই সে ঢাকায় ফোন লাগায়।
-মা শুনছ।
একটা বাড়ি পাইছি। অতো সুন্দর না হইলেও সব কিছু কাছে। আদিবা, অর্ক
আর আরিশার স্কুলে যাইতে কিছু অসুবিধা হইবনা ।
-কত টাকা ভাড়া
-দুই সপ্তাহে
সাতশ ডলারের মতো
-সে তো মেলা
টাকারে মা। যাই হোক ভালো ভাবে থাইক। বাচ্চাদেরকে দেইখা রাখো।
কিন্তু আজ চার পাঁচ
মাস হল বাড়িতে ইঁদুরের উপদ্রব বেশ বেড়ে গেছে। একটা থেকে আর একটা হতে বেশি সময় লাগে
না। ভালো প্রজনন শক্তি ওদের। সারা দিন রাত থেমে থেমে চোখের সামনে দিয়ে ইঁদুর
দৌড়াদৌড়ি করে। একবার ছোট ছেলেটা লাঠি নিয়ে পেছনে পেছনে দৌড়ায়। কিন্তু কোনো লাভ হয়
না। এমন না যে পেস্ট কন্ট্রোল করানো হয়নি। ইরতিজা এক বছর পর পর লোক ভাড়া করে
তেলাপোকা ইঁদুর আরো অন্যান্য উপদ্রব তাড়িয়েছে। কিন্তু এইবার গরম আসার সাথে সাথে এর
আগমন বেশি! একটা কিছু করা দরকার। সারাদিন কাজ শেষে বাসায় এসেই ইরতিজা শোনে।
-সারা বাড়িতে
ইঁদুরের দৌড়াদৌড়ি। কাপবোর্ড ওয়ার্ডরোব কিচেনের উপর ইঁদুরের কালো কালো পায়খানা দিয়া
রাখছে। আমি আর পারতেছিনা । একটা কিছু করো ইরতি। বাচ্চা গুলার তো অসুখ হয়া যাবে।
-দাড়াও কালই
ওদরে কাউকে ডাকব। এর মধ্যি একটা কাজ করা যায়। লোকাল চাইনিজ শপে এক ধরনের
মাউসট্র্যাপ পাওয়া যায়। ইমারজ্যান্সিতে কিছু করা যায় কিনা দেখতে হবে।
পরেরদিন অফিসে শেষে
ইরতিজা চাইনিজ দোকানে যায়। ওদের সাথে কথা বলে একটা মাউসট্র্যাপ নিয়ে আসে। এই
ট্র্যাপটা অন্য রকম। একটা প্লাস্টিকের কাগজের উপর গ্লু লাগানো। কাগজের উপরে লেখা
আছে সেফ ট্র্যাপ। কোনো বিপদজনক কীটনাশক নাই। শুধু নিরাপদ আঠা। ছবি দেয়া আছে একটা
ইঁদুর আঠার মধ্যে পড়ে গেছে আর উঠতে পারছে না। নির্দেশনা মতে ইরতিজা ফ্রিজের নিচে
যেদিক দিয়ে ইঁদুরেরা বেশি আসা যাওয়া করে সেখানে মাউসট্র্যাপটা রেখে দেয়। কিন্তু
সারা রাত পার হলেও একটা ইঁদুরও ধরা পড়েনা। রাতে বিছনায় মোহনা আফসোস করে।
-মনে হয়
টাকাটাই গচ্ছা। কোনো কাজ তো হচ্ছেনা গো।
-একটু তো সময়
লাগবে। বোঝনা ইঁন্দুরের চালাকি। আমাদেরকে কৌশল বদলাইতে হবে।
-কিচেনের কাছে
রাখবা নাকি। ওখানে তো ময়লা থাকে।
-ঠিকই তো বলছ।
দাঁড়াও ঐখানে দিয়ে আসি।
আজ সাইট অফিসে যাওয়ার
সময় এলিজাবেথ ইরতিজার সঙ্গী হয়। যাওয়ার কথা ছিল না। কারণ ওখানে হেল্প ডেক্সের কোনো
কাজ নাই। সাইট অফিসের কয়েকটা কম্পিউটারে একটু সমস্যা দেখা আছে। কাল সে বসের কাছে
ইমেইল পায়। কিন্তু ইলিজাবেথ কিভাবে এই ট্যুরে নাম দিল ইরতিজা বুঝল না।
ক্ষীনাঙ্গীনী লালচে রঙের এই ইটালি অরিজিন মেয়েটি তার অফিসের হেল্প ডেস্কে কাজ করে।
কয়েক পুরুষ ধরে সিডনিতে আছে। অফিসে ঢোকার সময় প্রায়ই লবিতে তার সাথে দেখা হয়। অনেক
সময় এলিজাবেথ ইরতিজার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটা বারবার সিগারেট ধরায় আর পারফিউম
দেয়। ইরতিজার সাথে স্মোকিং জোনেই তার সাথে বেশি কথা হয়। কত বয়স হবে পচিশ ছাব্বিশ।
সাদা সার্ট আর একটা নীল স্কার্ট তার ফেবারিট ফ্যাশন। প্রতিদিনই পায়ের জুতা
পাল্টায়। লাল নীল সবুজ বেগুনি। স্মোকিং জোনে আরো লোকজন থাকে। এলিজাবেথ ওদের সাথে
হাই হ্যালো পর্যন্তই। ইরতিজাকে দেখা মাত্রই সে একটা হাসি মারে। তারপর ধোঁয়া ছাড়তে
ছাড়তে কাছে চলে আসে। ইরতিজার সাথে তার আরো ভালো ভাব হয় একদিন সারি হিলস-এ
বাংলাদেশি ফুড খেতে গিয়ে। খেতে খেতে এলিজাবেথ বলে- ইণ্ডিয়ান ফুড আমার খুব
ফ্যাবারিট। আমি আগে অভ্যস্ত ছিলাম না । আই লাইক ইট ভেরি মাচ নাও। লিটল বিট হট বাট
ভেরি ডিলিশাশ। মাম একদিন রান্না করেছিল। কিন্তু খুব একটা ভালো
হয়নি। বেশি হট হয়ে গেছিল। ভেরি হট। শোনে ইরতিজা হাসে। বলে- অভ্যাস না থাকলে রান্না
করা যায়না। এরকম করে কয়েকবারই ওরা এখানে খেতে এসেছে। একবার ইরতিজা আর অন্য সময়
এলিজাবেথ বিল পরিশোধ করে। একদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিল। সিডনির আবাহাওয়া এমনিতেই রোদে
ভরা। ফক ফকা। বছরের প্রায় আশি ভাগ সময়ই
রৌদ্র থাকে। তো সেদিন বৃষ্টি পড়াতে ওরা একটা টেক্সি করে সারি হিলসে চলে যায়। সেদিন
এলিজাবেথ এমন একটা সার্ট পড়ে যে ওর বুকের প্রায় সবটুকুই দেখা যায়। ইরতিজা সেদিকে
দেখা না দেখার ভান করে। টেক্সিটা একটা টার্ন নেয়ার সময় এলিজাবেথ প্রায় ইরতিজার
শরীরের ওপরে চলে আসে। সরি বলে আবার আগের জায়গায় ফিরে যায়। ওর জামা কাপড় থেকে ভেসে
আসছে শ্যানেলের মাদকতা। পা দুটি সীট থেকে ঝুলিয়ে আড়াআড়ি করে রেখেছে। এতে করে উরু
থেকে পা পর্যন্ত খোলা অংশটা বেশি তীক্ষ্ণ হয়ে আছে। সাথে সাথে শরীর তেকে একটা
ঘামেরও গন্ধ আসছে। ইরতিজা নাকটা বন্ধ করতে চায়। চোখটা বন্ধ করতে চায়। পারেনা। কারন
টেক্সির জানালা নামানো। দম বন্ধ হয়ে যেতে পারে তাতে।
-জান ইরতি
আমার আর মাইকেলের সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই।
-কোথায় ও?
-ব্রিসবেন চলে
গেছে।
-তুমি যাওনি
কেন?
-আমি যাব কি
করে। ওতো তার এক্স গার্লফ্রেণ্ডের সাথে থাকে।
-আচ্ছা তাই
নাকি? তোমার কি খারাপ লাগে না?
-লাগে। ওর
সাথে তো আমার পাঁচ বছরের সর্ম্পক ছিল। আমার সবকিছু মনে আছে।
এসব বলতে বলতে ইরতি
দেখল এলিজাবেথের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ইরতি বলল ডোন্ড ওরি। দিস ইজ নট দ্য এণ্ড
অব অ্যাভরিথিং। টেক্সি থেকে নেমে ওরা
ইণ্ডিয়ান ফুড খেয়ে অফিসে ফিরে এল। পরদিন সকালে ইরতিজা তার মেইল খুলতেই দেখল এলিজাবেথের
একটা মেইল। অফিস শেষে তাকে তার বাসায় যেতে বলেছে। অফিসের হেল্প ড্রেস্ক সেকশনটা
দেখা যায় না। ইরতিজা কাজ করে সফটওয়ার সেকশনে তিন তলায়। হেল্প ডেস্ক দোতালায়। সে ভাবে সে কি উত্তর
দেবে। একবার সে মোহনার কথা ভাবল। অনেকদিন তো হল মোহানার সাথে তার বিয়ে হয়েছে। এখনো
মোহানা আকষর্ণীয়। শরীরটা টান টান। তিন তিনটা প্রেগসেন্সি হওয়ার পরও তার শরীর তেমন
ভেঙ্গে পড়েনি। একটু মুটিয়ে গেছে এই আর কি।
প্রায় রাতই মোহনা কানের কাছে ফিস ফিস করে। ইরতিজার একটি হাত নিয়ে তার বুকের মধ্যে
রাখে। আস্তে আস্তে সেই হাত বুক থেকে নাভি তারপর নাভি বেয়ে বেয়ে কমোরের নিচে যেতে
থাকে। মোহনা ঘন ঘন শ্বাস নিতে থাকে তখন। তার চোখমুখ অন্ধকারেও লালচে হয়ে যায়। ইরতিজা লক্ষ্য করে যে মোহানা আগে থেকেই বালিশের
নিচে কনডম রেডি করে রেখেছে। অতি সাবধান। কারণ এরই মধ্যে মোহনা একটি অ্যাবরশন করে
ফেলেছে। চায়না আর একবার হোক। সে জানে ইরতিজার কোনো হুস জ্ঞান থাকে না। রাবারের জনিসিটা তার একদম
পছন্দ না। বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে খুলে ফেলে রাখে। মোহনা টেরও পায়না। এইসব ভাবতে
ভাবতে ইরতিজা এলিজাবেথের মেইলটা আবারো পড়ে। চিঠিটার নিচের দিকে ইতি এলি লেখা আছে।
পুরো নামটা সে লিখেনি। কি করবে সে। সে কি যাবে? একবার সে
টেবিল থেকে উঠে পড়ে। দোতালার দিকে পা বাড়ায়। এলিজাবেথের সাথে কথা বলা দরকার। দরোজা
খুলেই দেখা যায় এলিজাবেথ কাউকে হেল্প করছে। সে ইশারা দেয়। ফোনে কথা বলা শেষ হলে সে
ইরতিজার কাছে আসে। আজকে সে টাইট ব্লু জিন্সের সাথে একটা কালো টি সার্ট পড়েছে।
ঠোঁঠে হালকা রঙের লিপ স্টিক। গ্লাস ডোর পেরিয়ে সে ইরতিজার সামনে দাঁড়ায়। ইরতিজা
মুখটা একটু সিরিয়াস হয়।
-এলি আই অ্যাম
সরি। আমি মনে হয় যেতে পারব না। আজকে আমার বাসায় কিছু গেস্ট আসবে। আর একদিন যাবো।
-কিন্তু আমার
মামকে তো আমি বলে রেখেছি তুমি যাবে। ক্যান ইউ কাম প্লিজ। টু ডে ইজ ভেরি স্পেশাল ডে ফর মি। আজ আমার জন্মদিন।
-ও আই এম সরি
আমি জানতাম না। আর একদিন যাবো
-জাস্ট
ম্যানেজ ইট টুডে ইরতি। অনলি ফর টুডে
- আচ্ছা ঠিক
আছে। এখনো তো সন্ধ্যা হয়নি। দেখা যাক।
- কুল। আই উইল
সি ইউ সুন।
বেলা তিনটার দিকে
মোহানা অফিসে ফোন করে। ইরতিজা একটু একটু করে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। একটু আগে
এলিজাবেথ তাকে একটা ম্যাসেজও দিয়েছে। নাছোর বান্দা। আমি যেয়ে কী করব? ইরতিজা নিজেকে নিজেকে বলে। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করে। ওপাশে মোহনার
গলা।
-ডারলিং কি
করছ?
-কিছু না। কাজ
করছি।
-আজকে একটু
তাড়াতাড়ি আইস। আরো একটা বড় ইঁদুর ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা করতেছে। অর্ক দেখছে। ওর পড়ার
টেবিলের নিচে ছিল। এখন ঢুকছে আমার শোয়ার ঘরে। অর্ক বলছে খেয়ে দেয়ে একদম তরতাজা হয়ে
গেছে। শরীরটা তেলতেলে।
-তাহলে কি
আঠাটা কাজ করে নি?
-না একদম না।
আরো বাড়ছে।
-তা হলে কি
করা যায়?
-জানো একটু
আগে মিনি আপার সাথে কথা বলছিলাম। উনি বলল মাউসট্র্যাপে একটু চিজ দিয়ে দিলে নাকি
চিজের গন্ধে ইঁদুর আসে। এখন তাই করছি।
- ঠিক আছে।
আমার মনে কাজ হবে না। চেষ্টা করতে পারো।
-তুমি কখন
আসবে?
-একটু দেরি
হতে পারে। কাজ জমা হয়ে আছে। বাই।
এলিজাবেথ সিঁড়িতে
দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কালো একটা ব্যাগ। মোবাইল ফোন বার করে ইরতিজাকে ফোন দেয়। কাম
ডাউন। আই এম ওয়েটিং ফর ইউ। ইরতিজা তার কাজের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিচে নেমে আসে।
কিছুদূর হাঁটতে হাঁটতে ওরা পার্ক স্ট্রিট থেকে একাট সাদা টেক্সিতে উঠে পড়ে। মাম
উইল বি সো হ্যাপি টু সি ইউ ইরতি। এলিজাবেথ ইরতির হাত ধরে ফেলে। তুমি কি আমাকে একটু
ধরবে?
ইরতিজা কিছু না বলার আগেই এলিজাবেথ তার ডান হাতটা ধরে ফেলে। ইরতিজার
সারা শরীর যেন কেঁপে ওঠে। সোনালি রঙের পাতলা একটি হাত আর চিকন কয়েকটি আঙুল ইরতিজার
ডান হাতটাকে যেন কাঁকড়ার মতো আঁকড়িয়ে ধরল। ড্রাইভার মিউজিক প্লিজ। এলিজাবেথ বলে।
মিউজিক বাজার সাথে সাথে ইরতিজা মোহনার কথা ভাবল। মোহনার হাত আঙুল কি এরকম? না এরকম না। একটু মোটা মোটা মোহনার হাত দুটি। আঙুলগুলির কথা মনে পড়ছে না।
আস্তে আস্তে এলিজাবেথ আরো কাছে এসে পড়ে। ইরতিজা প্রথমে নড়ে না । টেক্সি ট্রাফিক
সিগন্যালের কাছে থামল। জানালার বাইরে দোকানের কাঁচে ওদের দুজনকে স্পষ্ট দেখা
যাচ্ছে। ইরতিজা সরে বসে। পনের মিনিট পড়ে ওরা রেন্ডউয়িক চলে আসে। এলিজাবেথদের
বাড়িটাও বেশ পুরনো। কিন্তু উপরে রঙ করা। টাইলস গুলি বেশ কালারফুল। ওর মাকে ডেকে
ইরতিজাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। টেবিলে সাজানো খাবার। পিজা, পাস্তা
আর ল্যাম্ব স্টেইক। বিয়ার ক্যান। সাথে হরেক রকমের পাউরুটি। সালাদও আছে। এলিজাবেথ
ইরতিজার সামনাসামনি বসে। এর মধ্যে সে অফিসের পোশাক খুলে ঘরের ক্যাসুয়াল ড্রেস
পরেছে। এমন পাতলা একটা মিডি পড়েছে যে তার নিতম্বের পুরো ভাঁজটুকু পর্যন্ত ভেসে
উঠছে। এদিক মুভ করার সময় পেছনের সেই গভীর নরম নরম জায়গাগুলি নড়ে উঠছে আস্তে
আস্তে। গায়ে ছোট একটি হাতা কাটা সিঙ্গলেট।
বুকের অংশ অনেক খোলা। সাদা পালকের পাখি যেমন। অফিসে তো এমন উঁচু বুক এলিজাবেথ
দেখায় না। একটু ঝুকলেই বাঁধ ছেড়ে বেড়িয়ে আসছে সেই ঢেউ। গোল গোল ঢেউ। মাঝখানে খাঁজ
কাটা। এমন করে সে খাবার তুললো যে ইরতিজার জিবে পানি এস পড়ল। হ্যাভ সাম প্লিজ।
এলিজাবেথ বলে। মাম নিজে তৈরি করেছে। মোস্টলি ইটালিয়ান খাবার। জানিনা তোমার ভালো
লাগবে কিনা। ট্রাই ইট ইরতি। আই থিঙ্ক ইট ইজ ভেরি ডিলিশাস।
খাবারের মাঝে মাঝে ইরতিজা
যখন বিয়ারের কয়েক ঢোক গিলছে তখন এলিজাবেথ সিডি প্লেয়ার অন করে মৃদু ডান্স শুরু করে
দিয়েছে। সে ইরতিজাকে ডাকল। কাম অ্যাণ্ড ডান্স উয়িথ মি। ইরতিজা কাছে গেল না। শেষে
এলিজাবেথই তাকে নিয়ে নাচ শুরু করে দিল। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে নাচ চলল। এক সময়
এলিজাবেথ ক্লান্ত হয়ে পড়লে ইরতিজার বুকে মাথা রেখে দিল। সন্ধ্যার আবছা আলোতে
ইরতিজা এলিজাবেথের মুখটা দেখল। একটা মায়াবি রূপ এলিজাবেথের সারা শরীর থেকে বেরিয়ে
আসছে। ইরতিজার কানের কাছে এসে সে বলছে- টেক মি মাই ডিয়ার। টেক মি। স্টে উয়িথ মি টু
নাইট। আই হ্যাভ মেনি দিংস টু টক অ্যাবাইট। মেনি দিংস টু অফার ইউ। জাস্ট টেক মি
ইরতি।
এলি যখন ইরতিজাকে
নিয়ে সোফায় বসল তখনই মোহনার ফোন- এই জানো একটা ইঁদুর আঠাতে আটকে গেছে। এমন ভাবে
গেছে যে আর নড়তে পারছে না। আমিই একটু চিজ দিয়ে রাখছিলাম। আর যায় কই। ধরা পইড়া
গেছে। তুমি কখন আসবা ডালিং? আমরা তো তোমার জন্য অপেক্ষা
করতেছি। ইরতিজা এলিজাবেথের হাতটা সরিয়ে সোজা হয়ে দাড়ায়। আসব। একটু পরেই। অফিসে কাজ
জমা পরে গেছে। এই মাত্র শেষ করলাম। এক ঘণ্টার মধ্যেই বাসায় আসছি, ডার্লিং।
===========
আইভি রহমান গল্প অস্তিত্বের
কার্নিশে ঘুণপোকা


কিন্তু আজ চুপ করে
বসেই আছেন। পাইপে আগুন জ্বলেনি। ধোঁয়া
উড়িয়ে উড়িয়ে ঠান্ডা কফির কাপ থ মেরে ভ্যাবলার মত তাকিয়ে আছে। ঠান্ডা কাপের
বুকের মাঝখানে দুধের পাতলা সরের আস্তরণ হাল্কা করে ভেসে আছে। অবাক অবাক চাউনিতে
একটা প্রশ্ন ঝুলে আছে তারও।
রাতে ভাল ঘুম হয়নি
সেই ছায়া প্রকট চেহারাতে। ভ্রুজোড়া কুঁচকানো কপালে ভাঁজ স্পষ্ট জানান দিচ্ছে
চিন্তার জোনাকি জ্বলছে আর নিভছে মগজের কোণে কোণে।
আসলে ঘটনার শুরু কাল
রাতের খাবার টেবিলে। মেহেরুন্নেসা রাতের খাবার টেবিলে সব সাজিয়ে রোজকার মত
সবাইকে তলব করে করে ক্লান্ত হয়ে ফের বসার
ঘরে টেলিভিশনের সামনে যেয়ে বসতেই বড় ছেলে দিব্য খাবার টেবিলে এল আর টেবিলে তখনও
কেউ এসে পৌঁছায়নি দেখে সে বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল কেন কে জানে। এদের সারাক্ষণ কিসের
এত তাড়া বুঝতেই পারেন না মেহেরুন্নেসা বা
আজাহার মোল্লা কেউ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই
সবাই এসে টেবিলে বসতেই সেই শব্দটা উগলে দিল দিব্য, সবাই
মানে তো ওরা পাঁচজন। দিব্য, পুন্য, অরুণা,
মেহেরুন্নেসা আর আজহার
মোল্লা। টেবিলে বসা পাঁচজনের কেউই এই শব্দের জন্য
প্রস্তুত ছিল না।
সেই রকম তথাকথিত সুখী
সংসার না হলেও বেশ চলে যায়। থেমে যায়না বা ধ্বসে পড়েনা আজও এর মাথার উপরের ছাদ।
সেই খানে এই রকম শব্দের প্রয়োগ সব এলোমেলো করে দিল হুট করে। মোল্লা নিজে সেই ভাবে
উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও শহরের নামকরা ব্যাবসায়ী মহলের কেউকেটা গোছের।
ছেলেমেয়েদের মা
কলেজের সীমা পেরনো মানুষ। দেখতে অসাধারণ সুন্দরী আর খুব সংসারী বলে আজাহারের বাবা আশফাক মোল্লা খুব পছন্দ করেই
ঘরে তুলেছিলেন একমাত্র ছেলের বউকে সেই প্রায় তিরিশ বছর আগে।
তাকে আর যেতে দেওয়া
হয়নি ইউনিভার্সিটির সবুজ লনে বসে গল্প করতে বা ফুসকা চটপটির দোকানে আড্ডা দিতে।
তাদের ধারণা মেয়ে মানুষের বেশি লেখাপড়া ঘরের শান্তি কাড়ে।
যদিও সেই শান্তির
সবটুকু শান্তি নেই তাদের ঘরে। তবুও মাঝে মাঝেই নিজের দিকে ফিরে ফিরে তাকিয়ে দেখেন মেহেরুন্নেসা। সাথের বন্ধুরা
প্রায় সবাই চাকরী করে। স্বামীর হাত ধরে বিদেশ যায়।ছেলেমেয়ে নিয়ে সুন্দর ভাবে কেটে
যাওয়া তাদের জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। তারা সুখী কিনা
জানেনা সে।
কি করে জানবে তাকে তো
একা ঘরের বাইরেই যেতে দেওয়া হয়না। কেউ না কেউ সাথে থাকেই যেখানেই সে যাবে। বলা
হয়েছে তার নিরাপত্তার জন্য। কিছুতেই তার মাথায় আসেনা কে বা কারা তার নিরাপত্তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে আসবে।
প্রশ্ন করে উত্তর না পেয়ে চুপ করে গেছে সে।
কিন্তু ছায়ার মত কেউ
সাথে থাকলে কি আর সেই খোলা আকাশের মুক্ত পাখীর মুক্তির স্বাদ মেলে। সে ছেড়ে দিয়েছে
বাইরে যাওয়া। বন্ধুদের সাথে দেখা করা।
এখন তার সর্বাঙ্গ
জুড়ে আছে গহনার আস্তর আর মুখে বানানো হাসির রেখায় লুকানো কষ্ট। বাড়ীতে ব্যাবসায়িক
পার্টি ফাংশন লেগেই থাকে। সে যন্ত্রের মত সবার সাথে হাসির ফোয়ারায় মেতে থাকে। কেউ
বুঝতেও পারেনা সে আসলে কেমন আছে। বিদেশের মাটিতেও যে স্বামী তাঁকে নিয়ে যান নি তা
নয়। যতবারই গেছে সে হোটেলের অন্তপুরে আর স্বামী ব্যাস্ত কাজে। রাতে বা সন্ধ্যায়
বাইরে খাওয়া বা টুকটাক কেনাকাটা ব্যস।
মেহেরুন্নেসার ডাক
নাম মিলি। আজাহার মোল্লা এবং আশফাক মোল্লা
ঐ নামে তাকে ডাকেন বিয়ের পর থেকেই। শ্বশুরের খুব আদরের বউ। শাশুড়িকে দেখেনি
মিলি তার বিয়ের দুই বছর আগেই তিনি অজানা রোগে মারা গেছেন বলে তাকে জানানো
হয়েছে।
সেই মৃত্যু নিয়ে বহু
গুজব ছড়ানো ছিটানো এদিক ওদিক। ছবি দেখে
বোঝা যায় তিনি আজাহারের মতই ফর্সা সুন্দর ছিলেন। আজাহার মায়ের দিকে গেছে। আশফাক
মোল্লা কালো এবং ছোটখাট ধরনের মানুষ। তাঁর অবৈধ হলেও প্রচুর বিত্ত বৈভবের কারণে
কিছু সুবিধা লোভী মানুষ তাকে সুন্দর বলে থাকে সম্মান করে সামনে কিন্তু আড়ালে
আবডালে কি বলে সবার জানা থাকলেও তা নিয়ে
কেউই মাথা ঘামায় না।
টাকা এবং ক্ষমতার
প্রলেপ সমস্ত অসুন্দর আর দুর্গন্ধ আড়াল করে দূরে সরায় শূন্যে ওড়ায়।
নিজের জীবনের
পড়াশুনার ঘাটতি তিনি ছেলেকে দিয়ে মিটিয়েছেন। কলেজ থেকেই বিএ পাশ করিয়েছেন একমাত্র
ছেলেকে। টাকার সাথে সাথে একটা সার্টিফিকেট খুব দরকার সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে
গেলে এটা তিনি পদে পদে বুঝেছেন বলেই ছেলেকে তার মুখোমুখি হতে দিতে চান নি। খুব নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে তিনি। স্কুলের
গন্ডিতেও পা মাড়াতে পারেন নি। সংসার বাঁচাতে নিজের সব জলাঞ্জলি দিয়ে ধনের পাহাড় কি
ভাবে গড়েছেন শুধু তিনিই জানেন সেই অধ্যায়।
মিলির বাবা মা
টাংগাইলে থাকেন। একমাত্র মেয়েকে দেখতে প্রায় প্রায় ঢাকা আসেন হাঁড়ি ভর্তি চমচম আর
দই নিয়ে। তিন ছেলের কেউ দেশে নেই। তারা কানাডা নিয়ে যেতে চায় বাবা মাকে কিন্তু
মিলিকে ফেলে তাঁরা কিছুতেই যাবেন না। অবশেষে এবার খুব জোর করে রাজি করানো গেছে। এক
মাস পরেই তাঁরা কানাডা চলে যাবেন।
ছেলেরা এই বাড়ীর
কাউকেই পছন্দ করেনা কেবল নিজের একমাত্র বোন আর পুন্যকে ছাড়া। অরুণাকে খুব আদর করত
সবাই পরিবারের একমাত্র মেয়ে সন্তান বলে কিন্তু একটু বড় হবার সাথে সাথেই কেমন যেন
বেয়াদবের মত ব্যবহার বাড়তে লাগল মেয়েটার
আর তাতে তার বাবার পূর্ণ সমর্থনের বাতাস থাকায় তা বেলুনের মত ফুলে ফুলে উঠেছে।
বাবা আর মেয়ের মতে মামাদের
পয়সা নেই। তাদের স্ট্যাটাস অনেক নীচে।
বাবা মা চলে যাবে
দৃষ্টি সীমানার বাইরে এটা ভাবতে চায়না মিলি। চোখের চারিপাশ ঘোলাটে হয়ে আসে। একটু
খানি সবুজ বন ছিল তার জীবনের তপ্ত পোড়া মাঠের বুকে সেটাও উপড়ে নেবে জীবন!
কারো কারো জীবনে বুঝি
সবুজ রঙ কিছুতেই প্রযোজ্য নয় সবটাতেই হলুদ আর খয়েরীর প্রলেপে মাখা থাকে। কারো কারো
জীবনে বুঝি মুখোশ আর ছলনা ওতপ্রোত ভাবে মিশে যায়।
এক মাত্র মেয়েকে
তাঁরা অনেকটা চাপের মুখেই বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই সময়। ধনবান পরিবারের এক
মাত্র সুদর্শন ছেলে নিতান্ত মামুলী চাকরিজীবী এমদাদ সাহেব ফেরাতে পারেন নি। ভাগ্য
বিশ্বাসী পরিবারের সবাই এই বিয়েকে মেয়ের সৌভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছিলেন। মেয়ের
শ্বশুরের অবৈধ সম্পদের পেছনের ইতিহাস ঘটনা কানাঘুষা কানে এলেও কানে শোনেন নি
তারা।
বিয়ের দুবছরের মাথায়
দিব্য এলো তার পরের বছর পুণ্য তার পরের বছর অরুণা।
বিয়ের পর হোঁচট
খেয়েছে বার বার কিন্তু দমে যায়নি মিলি। হেরে যেতে চায়নি। নিজেকে শুধুই সন্তান
জন্মদানের উৎস বা জমিন হিসেবে দেখতে প্রচন্ড ঘৃণা জন্মেছে নিজের উপর কিন্তু
জানা নেই কোন সে অজানা কারনে আবার চিমসে
গেছে খোসা ছাড়ানো বাদামের মত।
খুব ধীর শান্ত
স্বভাবের মেয়েটা আস্তে আস্তে সবার মন জয় করে ফেলে। নিজের কোন পছন্দের কেউ না
থাকাতে আজাহারকে মেনে নিতে একটুও কষ্ট হয়নি বরং ভালই লেগেছিল যৌবনের উত্তাল
সেই দিনের শুরুতে অমন সুন্দর বর পেয়ে সাথে
অঢেল সম্পদের সাবলীলতা।
কিন্তু কোথায় যেন
একটা অদৃশ্য ছায়া আছে একটা আত্মা আছে এই বাড়ীর সব খানে। যে অলক্ষ্যে থেকে সব
পরিচালনা করে কাউকে জানতে বা বুঝতে দেয়না। এটা বুঝতে বুঝতেই তিন সন্তানের মা হয়ে
গেছিল সে।
এই পাঁচজনের সংসারে
যে যার মতই চলে। তবে বাচ্চাদের স্বাধীনতা
নামের ঘোড়ায় চড়ে যা খুশী করে বেড়ানো চলবে না এটা ভাল করেই তাদের মগজে ঢুকানো
হয়েছিল ছোটবেলায় দুই ভাই আর বোন যখন স্ক্ললাস্টিকায় যেত ড্রাইভারের সাথে তখন
থেকেই।
কিন্তু কি করা চলবে
না তা খুলে বলা হয়নি বা আজও বলা হয়না অজানা কারনে।
দিব্যর লেখাপড়ায় এখন
মনই নেই। সেই কবে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে পাশ করে বেরুনোর নাম নেই সারাক্ষণ
ল্যাপটপে মুখ গুঁজে গুঁজে কি যেন করে আল্লাহ জানেন।
পুন্য লেখাপড়ায় খুব
ভাল,
মামাদের সাথে তার যোগাযোগ খুব বেশী। ইউনিভার্সিটি পেরুলেই চলে যাবে
মামাদের কাছে কানাডা। এই ছেলেটা মিলির সব চেয়ে আদরের আর কাছের।
অরুণা সাফ সাফ জানিয়ে
রেখেছে স্কুলের সীমানা পেরিয়ে কলেজে গেলে তাকে নিয়ে বেশি না ঘাঁটতে তার যখন ইচ্ছে
সে পড়বে যখন ইচ্ছে বাইরে যাবে।
কিন্তু লেখা পড়া মন
দিয়েই করে সে। এবছর স্কুল ফাইনাল তার। সেও কম যায়না বড় ভাইয়ের মত সারাক্ষণ
ল্যাপটপে বসে না কিন্তু কানে হয় মোবাইল নয় আইপডের কর্ড ঝুলেই থাকে দিনরাত।
মাঝে মাঝেই অবাক হয়ে
মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে মিলি। কি করে মেয়েটা এতটা উস্শৃঙ্খল স্বাধীনচেতা মেজাজ আর অন্যরকম উন্নাসিকতা পেল।
সে তো আজও একা হেঁটেই
দেখল না জীবনের মাঠে। আজও মাথা তুলে বলতেই পারল না সে ঠিক কি আশা করে বা চায়
ছেলেমেয়েদের কাছে বা স্বামীর কাছে জীবনের কাছে।
বাবা মাকেও আজো বলতে
পারেনি কেন তাকে সেদিন বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল পড়া শেষ না করিয়েই। তার অনুমতির ধার না
ধেরেই।
সেই ছোট বেলায়
বাচ্চাদের পড়াতে বসলে অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করত তারা বড় হয়ে কি হতে চায়। বাচ্চারা
খুশীর আলোকধারার মত রঙ্গিন ফুলেল সব জবাব দিত আর সে স্বপ্নে ভাসত।
দিব্য খুব চাইত
ইঞ্জিনিয়ার হবে কিন্তু কলেজ পেরিয়েই মত বদলে গেল। একেক সময় মিলি ভাবে সে আসলে কি
ভাবে জীবন নিয়ে, তার মত পাল্টাতে এক জীবন পেরিয়ে যায় কেন
আর কেনই বা সে এমন নিঃস্পৃহতায় দিন কাটায়। উত্তর খুঁজে ক্লান্ত হয়েও পাওয়া যায়নি।
সকাল থেকেই বাড়ীটাতে
খুব ঝিমধরা পরিবেশ যার শুরু কাল রাতের খাবার টেবিলে। যদিও এর ব্যতিক্রম অন্যদিন
তেমন প্রকট নয় তবুও আজ একটু আলাদা রঙের মেঘের ঘনঘটা। রোজই মেঘলা থাকে আজ একটু বেশি
ঘন ঘোর কাল বোশেখি।
কাজের বুয়ার সাথে
নাস্তার টেবিলে সব গুছাতে গুছাতে এই সব ছাই পাশ ভাবতে ভাবতে খেয়ালও করেনি মিলি যে
বেলা অনেক হয়ে গেছে কিন্তু কেউ আজ নাস্তার টেবিলেই আসেনি এখনও।
হুট করে মনে মনে ঠিক
করে নিল সে আজ আর সবার ঘরে ঘরে গিয়ে ডেকে ডেকে নিয়ে এসে টেবিলে বসাবে না। বেশ
খানিকটা সময় অপেক্ষা করে নিজে নাস্তা করে নিল মিলি। তারপর সবাইকে চমকে দিয়ে খবরের
কাগজ পড়তে বসে গেল টিভি না ছেড়ে।
বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে
এলে আজাহার মোল্লা বারান্দা ছেড়ে ঘরে এলেন। চারিদিকে তাকালেন। সব ঠিক আছে অথচ কিছুই ঠিক নেই।
মাথার ভেতরে কাল
রাতের সেই শব্দ ঘুণ পোকা কুরে কুরে খাচ্ছে অস্তিত্বের সব টুকু। দিব্য যে শব্দটা
উগলে দিয়েছে প্রবল ঘৃণা ভরে। সেই শব্দের অন্তর্নিহিত মানেটা তাঁর অজানা নয়।
তিনি জানতেন। মানতেন কিনা সেটা আলাদা
প্রশ্ন।
কিন্তু তিনি তো
কোনদিন ঐ ভাবে ঘৃণা ছুঁড়ে দিতে পারেন নি। তবে কি তাঁর নিজের ভেতরেও কোন গোলমাল
আছে!
মনে হচ্ছে ভাবনার
জোয়ার তাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে দূর কোন বিরানভূমে একেবারে
একা ও একাকী।
মনে হচ্ছে এইভাবে
নির্বিকার থেকে ব্যাপক বিশাল সব সুবিধা নেবার এবং ভোগ করবার প্রায়শ্চিত্ত করবার
দিন বুঝি আগত। নিজেকে নিজের কাছে এই ভাবে ছোট হয়ে যেতে দেখতে হবে জানা ছিল না
তার। যদিও জানা ছিল বাইরের লোকজনের গুঞ্জন
গর্জন সুনামি হয়ত কোনদিন পৌঁছে যাবে তাঁর বাড়ীর অন্তরমহলে প্রকাশ্যে।
শক্ত পোক্ত ভাবে বন্ধ
করে রাখা সমস্ত দরজা জানালার শেকল ছিঁড়ে
তছনছ করে দেবে লোক দেখানো শান্তির ঘর। কিন্তু সেটা যে নিজের আপন সন্তানের কাছ
থেকেই আসবে তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি।
এই প্রজন্ম কি তবে
সত্যিই সত্যের বাহক এবং প্রতিবাদী প্রতীক। তাঁদের সময়ে কেন তাঁরা হয়ে উঠতে পারেন নি এই ভাবে প্রত্যয় দীপ্ত। কিসের
অভাবে জানা নেই। নাকি সব যুগেই এরা ছিল আছে এবং থাকবে শুধু তিনি বা তাঁর মত যারা
এই নষ্ট ভ্রষ্ট সমাজের কিছু জঘন্য মানুষ নামী পশুর কুকর্মে বা কুটিল আচরণে লাভবান
হয়েছেন তাঁরাই এদের সম্পর্কে অবগত নন বা চোখ বুজে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টায় মেতে
থাকেন থেকেছেন বা থেকেই যাবেন কেউ কেউ এই ভাবেই।
মাথায় কিলবিল করে লাল
পিঁপড়ের দল। জ্বলে ওঠে জ্বালা ধরা দংশন।
তাই বলে নিজের
জন্মদাতাকে কি করে আজাহার মোল্লা সেই দলের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। কি করে
অস্বীকার করতে পারেন তাঁর সেই অবদানের পলিমাটি যা আজহারের অচেনা হলদে ভুমিতে
সাফল্যের সবুজ ফুল ফুটিয়েছে। অস্থির দুহাতে মাথা চেপে ধরে খাবার টেবিলে বসে পড়েন
তিনি।
চোখের সামনে খুব ধীরে
ধীরে একের পর এক সেলুলয়েডের ফিতে পেঁচিয়ে পেঁচিয়েও খুলে যেতে থাকে। ঝাপসা হয়ে হয়েও
বেরিয়ে আসতে থাকে কত কত অজানা রহস্যের রহস্য।
বুঝতে বা মানতে কষ্ট
হয় আজ এত্ত গুলো দিন পরে বাবার সেই সে দিনের অনৈতিক কাজের ইতিহাস। অথবা তার আরো আগের ইতিহাস।
কেন তিনি ঐ পথে পা
বাড়িয়েছিলেন। কিসের অভাব ছিল। এমন তো না যে অনেক সন্তানের হাহাকার ছিল ঘরে। শুধু
মাত্র একটি পুত্রের মুখে নির্ভেজাল আর ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের আহার না দিয়ে কেন তিনি
কেড়ে নিয়েছেন জোর করে অন্যদের থেকে।
বুঝে উঠতে পারেন না
একেবারে সোজা তাঁর সামনে গিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে প্রশ্নের জবাব চাইবেন কিনা। সেই
সাহস কি আছে আজহারের!
তারপর কেটে গেছে আজ
অনেক অনেক বছর। আশফাক মোল্লা সইতে পারেননি একমাত্র সন্তান এবং দৌহিত্রের ঘৃণার
তীক্ষ্ণ বাণ। তিনি নিজের জীবন নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। যে মসজিদে ঢেলেছিলেন
অগাধ উজাড় টাকার জোয়ার মসজিদের মিনার
বানাতে,
সেখানে তাঁর জানাজা পড়ানো হয়নি। ইমাম সাহেব কঠোর এবং কড়া ফতোয়া
দিয়েছিলেন আত্মহত্যার লাশের জানাজা এই মসজিদে হবে না।
আজহার মোল্লা এখনও
মানসিক হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আর পাইপ টানবার অভিনয় করে দিন
কাটাচ্ছেন।
পুন্য কানাডায়
ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে চাকরী করছে। মিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে অনেক চেষ্টার
পর। এখন সে আবার স্বপ্ন আঁকে চোখের তারায়। জীবনের হলদে মাঠে আবার সবুজের চাষাবাদ
দেখে নিশ্চিন্তে মন দিয়ে পড়াশুনা করে সে। ঘুমায় নির্ভার নির্ভরতায়।
দিব্য জাগরণ মঞ্চের
একনিষ্ঠ কর্মী আজকাল। তার মুখ নিঃসৃত একটা
শব্দ যা তাদের লোক দেখানো সুন্দর সংসারকে
ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে সেই ‘রাজাকার’ নিধনে দিন রাত গলা ফাটিয়ে বিচার চাইছে তাদের। যুদ্ধ অপরাধীদের এবং
স্বাধীনতার শত্রু নির্বংশ করার শপথে উত্তাল তার উদ্ধত বজ্র মুষ্টি ।
আরুনা তার ছেলে
মেয়েদের আশ্চর্য সুন্দর জীবন বোধ এবং সুনীতির শিক্ষা পাঠ দিয়ে যাচ্ছে নিজের জীবনের
সবরকম উদ্ধতপনা আচরণ জলাঞ্জলি দিয়ে।
===========
নিশানা ][ তুষার আবদুল্লাহ

কতো টাকা হাতে নিয়ে ঘরে আসলো তাতে
সালেহা খুশি-অখুশি কোনটাই হয়না। সালেহার চাওয়া পাওয়া বলে কিছু আছে, তেমনটাও মনে হয়না রউফ মিঞার কাছে। নিজে থেকে শাড়ি, চুড়ি, স্নো এনে দিলে হাসি মুখেই নেয়। একবার মেক্সি এনে দেয়ার পর তো আনন্দে
কেঁদে ফেলেছিল সালেহা। কিন্তু এই সালেহাই যখন দেখে বাড়ি ফিরেও রউফ মিঞা বন্দুক
হাতে নিয়ে আছে, হয়তো পরিস্কারের জন্যই হাতে নিয়েছে, তাতেই অগ্নি রূপ নেয় ও। কোন ভাবেই ঘরে এসে আর বন্দুক স্পর্শ করা যাবেনা।
পরিস্কার করতে হলে সেটা বাইরেই করতে হবে। রউফ মিঞা সালেহার কাছে জানতে চায় প্রায়ই-
আচ্ছা তুমি বন্দুকরে এতো ডরাও কেনো? সালেহা চোখ কঠিন করেই
উত্তর দেয়-
তোমা্র হাতে যখন বন্দুক থাকে, তখন তোমারে আমি আর বিশ্বাস করতে পারিনা। তোমার বন্দুকরেও বিশ্বাস নাই। তোমারেও
না।
সালেহার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে রউফ
মিঞা বলে- ঐটাতো খেলনা।মা নুষ নিশানা ঠিক করে। পুরোটাই মজা। কেউ পারে, কেউ পারেনা।
সালেহা হাত সরিয়ে দেয়-তোমার কাছে
খেলনা। মজা, তাইনা? নিশানা ভুল হলে একটা
জীবন শেষ।
রউফ মিঞা হেসে উঠে- ধুর। কিযে কও
তুমি। মানুষ মরবে কেনো। বড় জোর আহত-টাহত হতে পারে।
সালেহা কড়া চোখে তাকিয়ে বলে- ঐটাও
বুঝি কম? যদি তোমার পোলার বুকে লাগে, চোখে লাগে, ঐটা কম? তুমিতো যে সীমার হইছো বুঝতে পারো?
রউফ মিঞা আর কথা বাড়ায়না। ও উঠে চলে
যায়। ওর চলে যেতেই ইচ্ছে হয়। কতোদূর যে চলে যাবে, তা হয়তো রউফ মিঞা
নিজেই জানেনা। সালেহা আর ছেলেটাকে কখনো সঙ্গে নিতে ইচ্ছে হয়,
কখনো হয়না। একলা জীবন ভালই ছিলো। গার্মেণ্টেসে কাজ করতো যে সময়, তখন কি খুব মন্দ ছিলো ও? সকাল আটটা থেকে রাত দশটা, ওভার টাইম শেষ করেই বের হতো ও। কোনদিন মেসে ফিরতো, কোন
দিন ফিরতোনা। মাঠে-পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমিয়ে যেতো আকাশ দেখতে দেখতে। মাসে একদিন
নাইট শোতে যেতো ছবি দেখতে। ছবি দেখে এমন হয়েছে সিনামা হলের বারান্দাতেই শুয়ে পড়েছে
রউফ মিঞা। ওর কাছে মনে হতো ও এই শহরে আছে অথচ কিন্তু কোন দিকে ওর নজর নেই।মন চায়
আবার গ্রামে ফিরে যেতে।যেখানে বাবা-মা আর ছোট বোন আছে।কিন্তু সেখানে ফিরে গেলেতো
ওদের খাবারের যোগান বন্ধ হয়ে যাবে। ফেরার জন্য একপা গ্রামের দিকে দিয়ে আবার গুটিয়ে
নেয় রউফ মিঞা। শহরকেই ভালবাসতে চেষ্টা করে। সেই চেষ্টাতেই ভালবেসে ফেললো মেসের
বুয়ার মেয়ে সালেহাকে। বুয়া না এলে রান্না করতে আসতো সালেহা। সালেহার লাজুক চাহনী
আর উদ্ধত ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ করে রউফ মিঞাকে। মেসের অনেকেই সালেহার সঙ্গে খাতির
জমাতে চাইতো কিন্তু ও কাউকে পাত্তা দিতোনা। কাউকে পাত্তা না দেয়ার বিষয়টাই মুগ্ধ
করেছে সালেহাকে। সালেহাও যেনো রউফ মিঞাকে আধটু পছন্দই করতো। না হলে রউফ মিঞার
বিছানাটা গুছিয়ে দেয়া, ওর জন্য খাবারটা আলাদা করে রাখার তো
কোন কারণ দেখেনা রউফ মিঞা। রউফ মিঞাও কেমন যেনো আচ্ছন্ন হয়ে যেতে থাকে সালেহাকে
ঘিরে। বউ না আসার খবর পেলেই রউফ মিঞা বুঝে নিতো, সালেহা
তাহলে আসছে প্রক্সি দিতে। সেদিন আর ওভারটাইমে মন বসতোনা। চলে আসতে মেসে। সঙ্গে
হয়তো থাকতো বুট ভাজা বা বাদাম। সংকোচ ভেঙ্গে বাদাম, বুট ভাজা
গুঁজেও দিয়েছে কয়েকদিন। সেই মূহুর্তে সালেহার করতলের যে স্পর্শ পেয়েছে রউফ মিঞা,
তাতে যেনো ভূমিকম্প নেমে এসেছিল ওর শরীর জুড়ে। রউফ মিঞা বুঝতে পারে আবহাওয়ার দূরবর্তী পূর্বাভাস। বিপর্যয়, সংকোচের ভাঙন যে কোন মূহুর্তে। তাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল রউফ মিঞা।
চেষ্টা করতো সালেহার সামনে না পড়তে। সালেহা যখন থেকে আলাদা যত্ন নিতে শুরু করে, তখন থেকে বুয়াও রউফ মিঞার দিকে একটু আদুরে নজর দিতো। দুই নজরের টানেই রউফ
মিঞা সালেহাকে ঘরে তুলে নেয়। আর সংকোচের ভাঙ্গনের শংকাতো ছিলোই। সালেহাকে ঘরে তুলে
নেয়ার খবরটা এখনো বাড়িতে জানাতে পারেনি। এ নিয়ে সালেহার অভিমান আছে। ও প্রায়ই বলে-
আমিতো তোমার বউ হইনাই এখনো।
রউফ মিঞা একটু কেঁপে যায় এই কথায়। জানতে
চায়-কেনো?
ভেংচি কেটে, অভিমানটাকে আরো গাঢ় করে সালেহা বলে- তোমার বাড়ি এখনো জানেনা আমি তোমার
বউ। তাহলে কেমনে তোমার বউ আমি?
রউফ মিঞা কোন উত্তর দিতে পারেনা। যখন
কোন উত্তর খুঁজে পায়না। তখনই বন্দুকটা কাছে নেয়। হাত বুলায় বন্দুকের শরীরে।
বিয়ের পর খরচ বাড়ে রউফের সংসারে। বাড়তি
রোজগারের টোপটা সালেহার মা এনে দেয়। নিয়ে যায় বস্তির মহাজানের কাছে। মহাজনের অনেক
ফেরিওয়ালা আছে। তারা এই বস্তিতেই থাকে। কেউ ঝালমুড়ি, কেউ লেইসফিতা, কেউ পপকর্ণ, আবার কেউ খেলনা বিক্রি করে। ব্যবসার
টাকা দেয় মহাজন। রিকশার রোজের মতোই দৈনিক জমা আছে। রউফ মিঞা মহাজনের সামনে গিয়ে
দাঁড়ালে জিজ্ঞাসা করে- গুলাইল খেলছো?
রউফ মিঞা মেঝের দিকে তাকিয়ে বলে- হুম।
মহাজন বলে- চড়ুই মারছো নাকি মাইনষের
চালে সই করছো?
রউফমিঞা এবার মহাজনের চোখে চোখ রেখে
বলে- সব কিছউ সই করতে পারি।
মহাজন মাথা দুলিয়ে বলে- চলবো তোমারে
দিয়া। তুমি বেলুন আর বন্দুক নিয়া নাইম্যা পড়।
সেই থেকে পথে রউফমিঞা। গার্মেণ্টসে
আর যাওয়া হয়নি। সকাল-সন্ধ্যা পার্কে ফুটপাতে বেলুন–বন্দুক নিয়ে বসে
থাকে। প্রথম নিজেরই বন্দুক হাতে তুলে নিতে হয়। পথচারী টানতে নিজের পারফরমেন্সটা
ভাল দেখাতে হয়। দশটায় দশটা বেলুনেই নিশানা পাক্কা। তাই দেখে লোকজন দাঁড়িয়ে পড়ে। ভাবে
তারাও দশটায় দশটা না হোক পাচঁটায় তো নিশানা ঠিক হবে। ফাঁদে পা দিয়ে কেউ দশটায় দশটা
নিশানা করতে পেরেছে এমন মানুষ কমই পায়। সমস্যা আসলে রউফ মিঞা নিজেরই। হাতটা খালি
নিশপিশ করে। বন্দুক হাতে নিলেই কাউকে না কাউকে নিশানা করতে মন চায়। মানুষ না পেলে
গাছের দিকে বন্দুক তাক করে। মন খারাপ হলে দশটা-বিশটা গুলি বের হয় রউফ মিঞার বন্দুক
থেকে। কখনো কখনো মানুষের দিকেও চলে যায় বন্দুকের নল। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে যখন
যেতো তখন শুনে ছিলো, গাছেরও নাকি প্রাণ আছে।তাই রউফ মিঞা
ভাবে গাছের শরীরে গুলি করা মানেতো মানুষের বুকেই গুলি করা। তাই যে মানুষটারে পছন্দ
হয়না, যার উপরে জিদ আছে। গাছের শরীরটা বদলে ঐ মানুষটাকেই
চোখে দেখে রউফ মিঞা। বন্দুক তাক করে গুলি ছোঁড়ে। দিনে দুপুরে না। যখন পার্ক বা
নির্জণ রাস্তায় অন্ধকার নামে তখনই রউফ মিঞার চোখ দিয়ে হিংসা, রাগ ঝলসে পড়ে। ওর বন্দুক দিয়ে বেরিয়ে আসে গুলি। একবারই শুধু মানুষের দিকে
বন্দুক তাক করেছিল রউফ মিঞা। পার্কের দারোয়ান।ও রউফ মিঞার কাছে মেয়ে মানুষ ঘুষ
চেয়েছিল। তখন বেলুন থেকে বন্দুক চলে গিয়েছিল ঐ দারোয়ানের দিকে। কিন্তু সেদিন
সালেহা, তার অবুঝ ছেলে, নাকি বাবা,
মা’র দোয়ায় প্রথমবারের মতো নিশানা ঠিক হয়নি
রউফ মিঞার। হলে আজ রউফ মিঞা যে কোথায় থাকতো। ঘটনাটা অনেকদিন বুকে পুষে রেখেছিল রউফ
মিঞা। পুষে রাখা ঐ গোপন কথা, বুকে ব্যাথা ধরিয়ে দেয় রউফ
মিঞার। ব্যথা সইতে না পেরে একদিন সালেহার কাছে চুপিচুপি বলেদিয়েছিল। নিশানা ভুল
হবার কথা। সালেহা খানিকক্ষণ চুপ হয়ে থাকে। তারপর বলে-
তুমি ঘরে আর বন্দুক ধরবানা। ঠিক নাই।
কবে নিজের পোলারেও যে নিশানা করো।
রউফ মিঞা নিজেও বন্দুক আর বেলুনের এই
খেলা থেকে মুক্তি চায়। ফিরে যেতে চায় গার্মেন্টসের সেই কর্মমুখর ফ্লোরে। কিন্তু
গার্মেন্টস আর ওকে নিতে চায়না। সুপারভাইজার বলে- তোর অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। তুই
কবে কাকে নিশানা করবি ঠিক নাই। তোকে বিশ্বাস করা যায়না।
রউফ মিঞাকে এখন কেউ বিশ্বাস করেনা। এই
যে সামনে বসে আছে যে তার নিজের সন্তান। অবুঝ এইছেলেটাও কি আড়চোখে ওকে দেখছে? কখন তার বাবা বন্দুক হাতে নিয়ে, তাকেই নিশানায় মেপে
নেবে, তারপর? ঊফ, ভাবতে পারেনা রউফ
মিঞা। চারপাশে এখন অবিশ্বাসের দেয়াল নেমে এসেছে। মহাজনও বলেঃ
-তোর হাতে যতোক্ষন বন্দুক, ততোক্ষণ তোরে দিয়া বিশ্বাস নাই। তুই তোর
রিজিকের মালিকরেও নিশানা করতে পারোস।
রউফ মিঞা বন্দুকের দিকে তাকায়। হাত
বুলিয়ে নেয়। নলটা চোখের কাছে আনে। ঘরের চারপাশটা দেখে নেয় ভাল করে। ছেলেটে তখনো
গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত এক শব্দ করে। সেই শব্দ হারিয়ে যায় অন্য এক শব্দে। রউফ
মিঞা’র নিশানা ভুল হলো আরো একবার।
==================
সোনিয়া সিনোরিটা
রাস্তার পাশেই তাজুদ্দিন সর্দারের বাড়ি। রাস্তাটা গ্রামের বুকের উপর দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে হাটখোলার দিকে। হাট খোলা থেকে তাজুদ্দিন সর্দারের বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি নয়। বর্ষাকালে হাঁটু কাঁদা থাকে এ রাস্তায়।তাজুদ্দিন সর্দারের ঘরের ভিতরে পা না দেওয়া পর্যন্ত কাঁদা ভাঙতে হয়। রাস্তার ও পাশে দিগন্ত জোড়া ধানক্ষেত। এ সময় ধানের গাছগুলো অর্ধেকের বেশি পানির তলায় থাকে। রাস্তা থেকে ধানখেত সাত আট হাত দূরে, রাস্তার পাশে এই জায়গায় কচুরিপনা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে। আর কচুরিপনার নিচে থাকে মাছ। চারদিকে কাদা মাটি, মাছ কচুরিপনা আর ধানক্ষেতের স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। তিন চারটা কলা গাছ কেটে ভ্যালা বানায় সর্দার, মাঠের মধ্যেদিয়ে ভ্যালা বেয়ে হাটে যায়,কাজে যায় । এমনই এক বর্ষায় মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে তাজুদ্দিন সর্দারের ঘরে এসেছিল আলেকজান বিবি। মাটি কাটার কাজ করত তাজুদ্দিন সর্দার। বর্ষা কালে গ্রামের লোকেরা বের পুকুর কাটায় না; সরকারি রাস্তায় মাটি পড়ে না। এ সময় তাজুদ্দিন সর্দার বিলে ঝিলে মাছ ধরে হাটে নিয়ে যেত, ঘাস কেটে গঞ্জের খামারে পৌঁছে দিতো। সেখান থেকে দু চার পয়সা আসত কিন্তু সে পয়সায় তিন বেলা খাওয়া হতোনা। ফি বছর তো দূরের কথা তিন চার বছরেও ঘরের খড়কুটার ছাউনি পালটাতে পারেনি সর্দার। বর্ষায় মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিলোনা ঘরের মধ্যে। আলেকজান বিবির মনে হয় এইতো সেদিনের কথা সব। ছবির মত স্পষ্ট সবকিছু মনে আছে তার। অভাবের সংসারে সর্দারের কাছে কোন দিন কোনো আভিযোগ বা আবদার করেনি আলেকজান বিবি। বিয়ের পর মাস না ঘুরতেই সংসারের হাল ধরতে বড় মিয়াদের বাড়িতে ঝি এর কাম শুরু করেছিল সে। ফজরের আযানের আগে উইঠা বড় বাড়ি চইলা যেত,আজো যায়। চুলার ছাই তুলে,চাল ধুয়ে কাঠ এনে রান্না বসায়,রাতের জমা হাড়ি পাতিল ধুতে ঘাটে যায়, হাড়ি কলসি ভরে জল আনে্, ঘরদোর, উঠান পাটে ঝাড় দেয়। এমনি কইরাই প্রতিটা দিন শুরু হয় আলেকজান বিবির। কামে ফাঁকি দেয়ার মেয়ে না আলেকজান; তবে বর্ষা বাদলার দিনে ভিজেপুড়ে কাম করতে কষ্ট হয়। কিন্তু সে জানতো কষ্টরে কষ্ট মনে করলে চলবেনা, আল্লাহ সেই কপাল তারে দেয় নাই। বিবি সাইজ্জা,নতুন শাড়ি পইড়া চুলে সুগন্ধি তেল দিয়া, সোনা রুপার গয়না পইড়া পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে খাওয়ার কপাল তার না। অন্যের ঘরের কাম কইরা তবু নিজের সংসার চলেনা তার। এ নিয়ে আফসোস তার হয় না;আর যদি কোনো দিন হয়েও থাকে সে তো যৌবনে ।যখন রাগি জোয়ান সর্দারের লগে বিয়া হয় তখন বয়স কতো ছিলো আলেকজানের মনে নাই, মুরুব্বীদের কাছে শুনেছে আলেকজান যখন সর্দারের ঘরে আইছিল বয়স তার বারো বৈ তেরো তো নয়। তাজুদ্দিন সর্দারের ঘরে এসে শুধু অভাবই পায়নি আলেকজান বিবি, পেয়েছিলো সর্দারের রোগা মাকে আর পেয়েছিল সর্দারের মেজাজ। সর্দার যে মাঝে মধ্যে সোহাগও করে নাই তা নয়। ঘোমটা খুলে ভয়ে ভয়ে রাগি সর্দারের লগে সংসার শুরু করেছিলো সে। তিন তিনটা ছেলে মেয়ে দিয়েছিলো খোদাতায়ালা তার সংসারে।কিন্তু সেই সুখ আলেকজান বিবির কপালে বেশিদিন সয় নাই। চৈত্র মাসের রোদে মাঠে যেমন বড় ফাটল ধরে তেমনি কইরা তার কাপালে বার বার ফাটল ধরেছে।আলেকজান বিবির জীবনের দুইকাল গিয়ে যখন এক কালে ঠেকেছে, তখন কি তার মনে এসব কথা ভেসে উঠেনা? ওঠে বৈকি। শীতের সকালে খালি পায়ে শিশির মাড়িয়ে গিয়ে যে শেফালি গাছটার তলায় বসে সেই সাদা আর কমলা রঙের খোয়াব দেখেছিল, একা একা বসে সর্দারের জন্য মালা গেঁথেছিল, যদিও ভয় আর লজ্জায় আলেকজান বিবির মুখ লাল হয়ে গেছে কিন্তু সে মালা কোনো দিন দিতে পারেনি সর্দারেকে। সেই শেফালি গাছটার তলায় নিজের পেটের সন্তানকে কবর দিতে হয়েছে তাকে। সেই গাছটার পাশ দিয়েই প্রতিদিন আলেকজান বিবি যখন বড় বাড়িতে যাওয়া আসা করে তখন বুঝি সে সব কথা তার মনে না এসে পারেনা। বহু বছর পেরিয়ে গেছে, আলেকজান বিবির মনে হয় এইতো সে দিনের কথা! বিয়ের পর বছর ঘুরতেই তার কোল জুড়ে দুধের মতন ফর্সা যে মেয়েটা হইল, চাঁদের মতন সুন্দর তাই নাম রাখলো চাঁদনী। দুপায়ের উপরে শোয়াইয়া মাসি পিসির গান শুনাইয়া মাইয়ারে ঘুম পারাইলো। পানের বোঁটায় তেল লাগিয়ে কুপির উপর ধরে কাজল বানাইয়া সেই ছোট্ট ফর্সা কপালের বাম পাশে বড় কইরা টিপ দিল যাতে বদ নজর না লাগতে পারে। কিন্তু লোকের নজর না লাগলে কি হইব ,যার মাল সে যে নিজের কাছে লইয়া গেল আলেকজানের কোল খালি কইরা! অমন ডাগর ডাগর কইরা যে মেয়ে তাকাইলো, আঁচল ধইরা আলেকজান বিবির পিছন পিছন মা মা করতে করতে চার পাঁচ বছর বয়স হইলো,সারা উঠানের কাঁদা মাটি গায়ে মেখে খিট খিট করে হাসল। সেই মেয়ে এক বর্ষার দুপুরে সবার চোখের আড়ালে টুপ করে পুকুরের জলে পড়ে মরে গেলো ! আলেকজান বিবি জানেনা তাজুদ্দিন সর্দার তাদের আদরের মেয়ের মৃত্যুতে কেঁদেছিলো কিনা ।মরার খবর পাইয়া লোকজন লইয়া আইসা মাইয়ার দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেছিলো ।অমন সোনার চান মাইয়ারে নিজের হাতে কবরে রাখল সর্দার অথচ একটুও কাঁদল না! হ্যাঁ, কাঁদে নাই সত্য কিন্তু আলেকজান বিবির মনে আছে মাইয়া কবরে রাইখা বহুদিন কারো লগে কথা কয়নাই সর্দার,কাজে কামেও যায় নাই ।আলেকজানের নাওন খাওন বন্ধ হইয়া গেছিলো। চিৎকার করে বিলাপ করেছে, মূর্ছা গেছে, আবার উঠেছে, আবার কেঁদেছে। মনে আছে তার। সব মনে আছে। মাইয়া মরে যাওয়ার তিনদিন পর বড় বাড়ির বড় মিয়ার ছোটবউ আলেকজানের ঘরে আসছিলো। এসে সান্ত্বনা দিয়েছিলো এমন কি বয়স তাদের, আরো ছাওয়াল হইব। ছোট বউ কইছিল– “কাইন্দা আর কি হইবরে আলেকজান? আল্লার মাল আল্লায় নিছে। এমন কইরা কাম কাইজ বন্ধ কইরা থাকলে তোরা ও তো শেষে না খাইয়া মরবি।’’ এমন দরদভরা কথা শুনে আলেকজানের কান্নার স্বর আরো বেড়ে গেছিলো। জবাই করা মুরগির মতো ছটফট করছিলো সে। ছোট বউ বিরক্ত হইয়া কইছিলো– “তিন দিন কামে যাইস না। এমন করলে তো অন্য ঝি দেখতে হয়। সকালে আমার মাইয়া- জামাই আইছে,লগে ছোট নাতি আছে।ঘরে মেলা কাম।তুই না পারলে বল,রহমানের বউরে ডাকি।” আলেকজান বুকে পাথর বাইন্ধা সেদিন কামে গেছিলো। সর্দার কামে যায় না কয়দিন ধইরা। সেদিন আলম মাঝি আইসা সাত সকালে ডেকে নিয়া গেলো। আলেকজান বিবি জানতো সেই পুরানো দলে ভিরে সর্দার আবার জুয়া খেলবে,তামাক টানবে,মাইয়ার কথা, সংসারের কথা ভুইলা থাকবে। ঘরে বুড়ো শাশুরির এই আছে এই নাই অবস্থা, তারেই বা কি খেতে দেবে সে? তাই মেয়ের শোক বুকে চেপে যন্ত্রের মতো আলেকজান বড় বাড়ির সব কাজ করে গেছে। কখোনো শোকে ডুকরে উঠেছে, নীরবে আঁচলে চোখ মুছেচে। ছোট বউয়ের নাতির গুট গুটি পায়ে হাটা দেখে আলেকজান বিবি সেদিন নিজের মেয়ের জন্য হাউমাউ কইরা বিলোপ করে নাই সত্য,কিন্তু তার কইলজায় কে যেন ছুড়ি বসাইয়া দিছে, কোরবাণীর গরুর গলায় কসাই যেমন কইরা ছুড়ি চালায়, ঠিক তেমন কইরা। না, আলেকজানের আর বেশিদিন বুড়ো শাশুড়ির সেবা –যত্ন করতে হয়নি।বাড়ির ছোট্ট আঙিনা পেরিয়ে,বিশাল পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে শিউলি তলায় শিশু মেয়েটার পাশে আজ শুয়ে পড়লো সর্দারের মা। আলেকজান আচলে মুখ ডেকে শিউলি গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। নিজের বাপ মায়ের মুখ তার মনে নেই। তাকে সাত আট বছরের রেখে দুনিয়া ছেড়েছে যে মা বাপ, সেই অস্পষ্ট মুখ দুটিও বুঝি আলেকজান বিবির চোখের সামনে উকি মেরেছিলো সেদিন! দুই বছর পর আলেকজান বিবির পোলা হইলো। পোলা জন্মের আগেই সে জৈনপুরী হুজুরের কাছ থাইকা এগারো টাকা দিয়া একটা মাদুলি এনে রেখেছলো। আঁতুড়ঘরে সেতারা দাইয়ের সেদিনের সেই কথা আজও যেন কানে বাজে আলেকজান বিবির- “তোর পোলা হইছেরে আলেকজান,মরা পোলা হইছে। ”পোলা হওয়ার খবর শুইনা খুশি হওয়ার আগেই মৃত পুত্রের কথা শুনে অজ্ঞান হয়ে পরেছিলো সে। দুই দিন বাদে বড় বাড়িতে কাজে গিয়া শুনেছিলো সে অপয়া ।তারে বিয়া কইরা তাজুদ্দিন সর্দারের ও বুঝি সন্তানের সুখ পাওয়া হইলনা। শুধু বড় বাড়িতেই নয়, রাস্তা ঘাঁটে কেউ যেন তার অপয়াত্ত্বর কথা জানাতে ভুলতো না।তখন সর্দারের মেজাজ যেন আগুন ।একটু উনিশ থেকে কুড়ি হইলো কি, তরকারীতে নুন একটু বেশি হইলো অমনি খাবারের বাসন আলেকজানের গায়ে ছুঁড়ে মারল! আলেকজানের মনে আছে আজও সর্দারের সেই রাগের কথা। “অপয়া তুই, মাইয়া পোলা হইয়া বাঁচেনা তোর...কোন গুণের কামডা পারিস তুই? আলম মাঝি, রত্তন নাপিত, গগন শেখ সবাইর তিন চাইরডা মাইয়া পোলা। আর তোর একটাও বাঁচে না। তোরে তালাক না দিলে বাপ দাদার ভিটায় বাতি জ্বলবে না।” আলম মাঝি এসে সর্দাররে আর একটা বিয়া করার কথাও বলছিলো সেদিন। অনেক কিছুর মতো তালাকও আলেকজানকে দেয়নি তাজুদ্দিন সর্দার। বছরে একটা নতুন শাড়ি দেয়নি সর্দার তাকে, দিতে পারেনি; তেমনি তালাকও দেয়নি,দিতে পারেনি,দিতে হয়নি!বছর না ঘুরতে আলেকজানের কোলজুড়ে রাজপুত্তুরের ন্যায় যে ছেলের জন্ম হইল আলেকজান তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে ভয়ই পেলো বুঝি! শখ করে সে আর পোলার নাম রাখলো না।সাহসও হলো না তার, অপয়া সে... যদি কিছু হয়? না,ভয়ে তার বুক কেপে ওঠে। সে যে বাঁচতে পারবেনা এই ছেলেটার ও যদি কিছু হয়।মনে আছে তার সেদিন আলম মাঝির বেটেখাটো গোমড়ামুখো বউটা এসে ছেলের নাম রেখেছিলো সত্তার। নামটা আলেকজানের ভালো লাগেনি। অতটুকন পুতুলের মতন মুখ, ছোট ছোট হাত পা সেই ছেলের কেমন বুড়োদের মতন নাম। বড় বাড়ির ছেলে, মেয়ে, নাতিদের কেমন সুন্দর সুন্দর নাম। অমন যদি নবীন, মিঠু, রণি, অপু কিছু একটা রাখতে পারতো আলেকজান তার ছেলেটার নাম। কিন্তু সেই দুঃসাহস আর করেনি সে। নিজের মনকে বুঝিয়েছে– অপয়া সে, কিছুতেই ছেলের নাম নিজে রাখবেনাশখ করতে গিয়া এই ছেলেডারেও যদি... ... না, না করিমন সে কথা ভাবতেও পারে না, ভাবতে চায়ও না। আল্লাহ্ তার সত্তাররে বাঁচায় রাখুক। দেখতে না দেখতে সত্তারের বয়স সাত আট বছর হইয়া গেলো যেন কেমন কইরা। সর্দারও বড় আহ্লাদ করে সত্তারকে। বড় বাড়ির পুরানো কাপড় সত্তারকে পড়াতে চায়না সর্দার। হাটের দিন সঙ্গে কইরা বাজারে নিয়া যায়। কাঠি লজেন্স, বাদাম, বাঁশি এটা সেটা কিনে দেয়, একটা খাতা কলম কিনে দিতে ও ভুল করেনা সর্দার। তাজুদ্দিন সর্দার কেমন সংসারী হইয়া উঠলো! দক্ষিণের ওপদার রাস্তায় মাটির কাম শুরু হইছে। দল বল লইয়া সর্দারের সেকি ত্যাজ, সেকি আগ্রহ নিয়া কাজ করা। না, ছেলে পাইয়া এইবার সর্দার একেবারে বদলাইয়া গেলো। আলেকজানের জীবনে সত্যিই বুঝি সুদিন ফিরে আইলো। সর্দার আর জুয়া খেলতে যায়না। ছেলেরে স্কুলে পাঠাইছে। আলেকজানের স্বপ্ন তার সত্তারও বড় বাড়ির ছেলের মতন অনেক পাশ দিবো, বিরাট চাকরি করবো। আলেকজান বিবির মনে আছে, সর্দার একদিন তারে কাছে ডাইকা বলল– “তুই বড় বাড়ির কাম ছাইড়া দে বউ, পোলাডার দ্যাখভাল কর।একলা যা পামু তাতে তিন জনের দিন চইলা যাইব। ”আলেকজান বড় বাড়ির ঝির কাজ ছাড়ে নাই কিন্তু চোখ দিয়া সেদিন জল পড়ছিল, আনন্দ জল । সেদিনের চোখের জলের স্বাদটা বুঝি নোনা ছিলনা! আলেকজান বিবির সেই দিনটার কথা ছবির মতন স্পষ্ট মনে আছে আজও। এরপর চার পাঁচটা বছর কেমন স্বপ্নের মতন কাইটা গেলো । অমন পোড়া কপালী আলেকজানের কপালে নাকি এত সুখ সয়? অপদার রাস্তায় কাজ করতে গিয়ে নিজের খোন্তার এক কোপ পড়ল সর্দারের বাম পায়ে এসে। মাটির কাজে এত দক্ষতা যে তাজুদ্দিন সর্দারের, সেই সর্দারের পায়ের তিন তিনটা আঙুল কখনো নিজের কোপে ছিটকে যেতে পারে! এতো আলেকজান বিবির কপালেরই দোষ। সর্দারের পায়ের ঘাটা শুকাইতে বছর পারাইয়া গেল।কেরামত ফকিরের ওষুধে কিছুতেই ধরলো না। শেষমেশ তাকে গঞ্জের হাসপাতালে নিয়া গিয়েছিলো আলেকজান। তখন কি কইরা যে সংসার চালাইছিলো আলেকজান ...তবু পোলাডারে স্কুল ছাড়তে দেয় নাই। মনেরে সে সান্ত্বনা দিছে কয়টা আর মাস তারপরতো সর্দার আবার কাম কাইজ শুরু করবো তখন আর কষ্ট কি? কিন্তু সর্দার যখন হাসপাতাল ছাইড়া বাড়ি ফিরলো তখন আর আগের সেই লম্বা চওড়া ত্যাজী সর্দার নাই। সর্দারের দেহটাই শুধু কঙ্কালসার হয় নাই, খোঁড়া পা টা নিয়া এমন ভাবে কুজো হয়ে হাঁটে দেখলে মনে হয় যেন এই এক দের বছরে সর্দারের বয়স যেন একযুগ বেড়ে গ্যাছে।শুধু সর্দারই বদলায় নাই গ্রামটাও যেন চোখের পলক ফেলার আগে কেমন বদলাইয়া গেলো! গ্রামে আর মাটির কাম নাই বললেই চলে। ছয় মাসের মধ্যে ঘরের পাশের চিরচেনা রাস্তাটাও পাকা হইয়া গঞ্জ ছাড়াইয়া গেছে। সংসারের সব ভাঁড় কাঁধে নিয়ে তবু যেন নুয়ে পড়ে না আলেকজান বিবি।শুধু শীর্ণ দেহটা আরও শীর্ণ হয়, মুখের সাদা রংটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যায়। এই বিশ্ব সংসার বুঝি সমস্ত চেষ্টা করে এই মেয়ে মানুষটির যাত্রা ভঙ্গ করাতে ব্যাস্ত! সর্দারের শরীরটা আরও খারাপের দিকে যায়।বিছনাই যেন আর ছারতে পারেনা দিনে দিনে।নিজের একটা ছগল ছিলো আলেকজানের,সন্তানের থেকে কম কিছু ভালোবাসতোনা সেটাকে।সেই দুর্দিনে সেটা কেও বিক্রি কইরা দেয়। শুধু ছগলনা, হাস মুরগি যা ছিল সব বিক্রি করে দেয়। এত কিছুর মধ্যেও সত্তাররে স্কুল ছাড়তে দেয়নাই সে। এমন কইরা দেড় দুইটা বছর কাটলেও আর যেন পারেনা আলেকজান বিবি। নিজে অর্ধাহারে, অনাহারে থেকে দুইটা মানুষরে তিন বেলা খাওন দিতে এত সংগ্রাম তার । তখন আলেকজান বিবির চারিদিকে শুধু হাহাকার, শুধু অন্ধকার । বড় বাড়ির মেজোগিন্নি ছাড়া বাদবাকি সব শহরে চইলা গেছে।বড় বাড়ির ছেলেগুলান নাকি মেলা পাশ দিছে,বিরাট বড় দালান কোঠায় থাকে, গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে। মেজো গিন্নী স্বামীর ভিটা ছাড়তে রাজি হয় নাই, তাই একলা থেকে গ্যাছে। ছোট একটা ঝি রাখছে সারা দিন রাইত মেজো গিন্নীর লগে থাকার লাইগা। সেই ঝিই এক জনের কাজকাম সব করতে পারে। আলেকজানরে আর দরকার নাই বড় বাড়িতে। সে মেজো গিন্নির হাত পা ধইরা কান্না কাটি করে। না খাইয়া যে মরতে হইবো, পালাডারেই বা খাইতে দেবে কি, সর্দারের ও যে কাম কাইজ নাই। মেজোগিন্নি দয়া কইরা ঘরদোর ঝাড়া মোছা করা আর হাঁড়ি পাতিল ধোঁয়া,পানি আনার কাজে রাখছে আলেকজানরে। তবে স্পষ্ট কইরা বলে দিছে এইটুকুন কামের লইগা কোন টাকা পয়সা পাইবেনা সে।কাজ কইরা দুবেলা খাওন দাওন কইরা যাইবে।আলেকজান গিন্নিরে রাজি করাইছে খাবারটা সে নিজের ঘর নিয়া গিয়া খাইবো। আলেকজান বিবি জানত তাইলে সে খাবারটা তার সত্তাররে আর সর্দারে খাওয়াইতে পারবো। গ্রামে আর কোনো লোকের বাড়িতে কাজও পাওন যাইবনা। গেল সনে বিরাট বন্যা হইচে।মাঠে ভুয়ে ফসল নাই। কি করবে সে?বরাবর আলেকজান বিবি বাড়ির এক চিলতে উঠানটায় পুঁই গাছটা,উচ্ছে গাছটা;ঘরের চালে লাউ গাছটা এটা সেটা লাগায়।রাস্তার পাশ থাইকা কচু শাকটা, হেলেঞ্ঝা শাকটা তুলে আনে। ছাবিতে দুই চারটা মাছ পায়। তা দিয়া কতদিন আর চলে? চাল কেনারই বা পয়সা কোথায়? পোলাডা ও স্কুল যাওয়া ছাইড়া দিছে। আলেকজানই বা কেমনে যাইতে কইবো? জামা জুতা না হয় নাই, বই খাতাই তো কিনা দিতে পারেনা, পরীক্ষার ফি দিতে পারেনা। ক্লাসের ছেলে পুলে হাসাহাসি করে। মাস্টার একদিন কইছে পরা বাদ দিয়া কাম কাইজ কর।না, সেই থাইকা পোলা আর স্কুলে যায় নাই।আলেকজানেরর মনটা বড় পোড়ায়। চোখ দিয়া দরদর কইরা পানি পড়ে। দুই চাইর বেলা না খাইয়া থাহনের অভ্যাস আলেকজান বিবির আছে,সে জন্য তার চোখে জল আসেনা। ছেলেডারে আর বড় পাশ দেওয়ান হইলনা, সেই দুঃখে তার কান্না। আমতলী গ্রামের রাস্তায় আর কাঁদা নাই। ঘরের পাশের রাস্তাটা দিয়ে কত বড় গাড়ি যায়।রিকশা ভ্যানের সারাক্ষণ আনাগোনা।আলেকজান বিবি লম্বা ঘোমটা টানে, ঘোমটার ফাঁক দিয়ে তাকায়। দু’চোখ ভরা তার বিস্ময় এত লোক সেই দূর দেশে যায়! আবার কত লোক গাঁয়ে ফিরে আসে! আলেকজান বিবি বারবার ভাবে সর্দার যদি একটা রিকশা চালাইতে পারতো তবে তার পোলাডার ইস্কুলে যাইতে পারত আবার।সর্দারের শরীরডাতো একটু ভালোর দিকে মাসদুই হইলো।তাজুদ্দিন সর্দারের খোঁড়া পা নিয়া তা যে কতটা কঠিন সে চিন্তাটাও যে তার মাথায় আসে নাই এমন নয়। একদিন আলেকজান সাহস কইরা তাজুদ্দিন সর্দাররে কইল “আপনে মহাজনের কাছে হাত পা ধইরা একটা রিকশা ভাড়া চান, এক বেলা চালাইলেও কিছু পয়সা পাওয়া যাইত।’’ নির্লিপ্ত সর্দারের ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে আলেকজানের মনে হয়েছে সর্দার যেন কিছুই শুনতে পায় নাই।সে আবারও সাহস কইরা সর্দারের আর একটু কাছে গিয়ে কইলো- “ যান না ।পোলাডারে খাইতে দিতে পারিনা,বই খাতা কিছু কিনা দিবার পারিনা। রিকশা চালাইলে যদি কিছু পয়সা কড়ি পাওন যাইত। পোলাডা বড় পাশ দেবার পারতো।’’ জীবনে বুঝিবা প্রথম তাজুদ্দিন সর্দার আলেকজান বিবির কথা শুনলো। রোগা শরীর আর খোঁড়া পা নিয়ে সর্দার রিক্সা চালাতে শুরু করলো। আলেকজানের ক্লান্ত চোখ স্বপ্নের নেশায় কেমন চকচক করে উঠলো! সেদিন আলেকজান বিবির নামাজ শেষে মোনাজাতটা আরও লম্বা হয়। সর্দার এত বছর বাদে কামে গেছে....আল্লাহ মুখ তুইলা চাও।সেদিন সৃষ্টিকর্তা বুঝি এই মূর্খ মেয়ে মানুষটার স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস দেখে হেসে উঠেছিলেন কিংবা আলেকজানের প্রতিদিনের মোনাজাতে কান্নাকাটির সময় তিনি যেমন উদাস থাকেন তেমনই ছিলেন অথবা যথারীতি বিত্তশালীর প্রার্থনা পূরণেই ব্যাস্ত ছিলেন। তাইতো রিকসা চালাতে যাওয়ার তিন দিনের মাথায় ভর দুপুরে লাশ হয়ে ঘরে ফিরল তাজুদ্দিন সর্দার। পাড়া প্রতিবেশীরা এসে সর্দারকে যত্ন করে নতুন ধবধবে সাদা কাপড় পড়িয়ে শিউলি গাছটার তলায় শুইয়ে দিলো।কেউ একজন আলেকজানের নাক ফুলটা খুলে নিলো, হাতের প্লাস্টিকের চুরি দুটাও খুলে নিতে ভুল হলো না। আলেকজান বিবি বার বার মূর্ছা গেল,সত্তার ক্যামন চিৎকার করে করে সারা উঠানে খাবি খেতে লাগলো। তাতে এ বিশ্ব সংসারের নিয়মের কোন ব্যত্যয় হলনা। জীবন সংসারের সমস্ত আয়োজন চল্লিশ বছরের আলেকজান বিবিকে আশি বছরের বার্ধক্য এনে দিয়েছে। এই নিরীহ পল্লীবধূটিকে টিকে থাকার লড়াই এ হারিয়ে, শেষ জীবনতৃষ্ণাটুকুও কেড়ে নিয়ে ভাগ্য দেবতা বুঝিবা সেদিন আড়ালে বসে পৈশাচিক অট্টহাসি হেসেছিলেন! সর্দার মারা যাওয়ার পনের কি ষোল দিনের মাথায় উত্তরকান্দার হোসনার পোলা জামাইল্লার লগে সত্তার শহরে চইল্লা গেলো কাজকামের লাইগা। সত্তার যাওয়ার দুইদিন পর জানতে পারলো আলেকজান গ্রামের লোকের মুখ থাইকা।চোখে ছানি পড়ার বয়স হয়নি আলেকজানের কিন্তু চোখেরজলে চোখদুটো ঝাপসাই থাকে। ও দুচোখে আজ আর স্বপ্নের নিঃশেষটুকুও থাকেনা।এই ক্ষুধা, এই অভাব, এই বঞ্চনা, এই ভাগ্যের পরিহাস এসবের বিরুদ্ধে কার কাছে নালিশ করবে আলেকজান বিবি? সত্তার চলে যাওয়ার মাস তিনেক পর একখান চিঠি আসছিলো, সাথে একশ টাকা। সত্তার গার্মেন্টস এ চাকরি নিয়েছে, ভালো আছে সত্তার! এরপর বারো তের বছর কেটে গেছে। সত্তারের আর কোন চিঠি আসেনি, খোঁজ মেলেনি। সত্তার কি বিয়ে করে সংসার শুরু করল? তাই মায়ের কথা ভুলে গেলো? কত লোকই তো প্রতিদিন দুর্ঘটনায় মারা যায়, সত্তারেরও তেমন কিছু হয় নাই তো? সত্তারের চিঠি আসার মাস দুয়েক পরে শহরে বড় এক গার্মেন্টসে আগুন লেগে যে শত শত লোক মারা গেলো সত্তার তার মধ্যে ছিলনাতো? এসব প্রশ্ন হয়ত জীবনযুদ্ধে পরাজিত আলেকজান বিবির মনে আসেনা! অভ্যাস মতো আজো সে বড় বাড়িতে কাজে যায়, নামাজ শেষে মোনাজাতে আল্লার কাছে একই ফরিয়াদ জানায়- আল্লাহ তার সত্তাররে ভালো রাখুক, বাঁচায় রাখুক! সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার বিশ্বাসের ভিতটা আজো একবারের জন্যও কেঁপে ওঠে না ।আজো সে ভাবে আল্লাহ্ যা করে বান্দার মঙ্গলের জন্যই করে। পৃথিবীতে যারা সুখ পেলনা, সেই প্রিয় মৃতদের শান্তির জন্য তাই সৃষ্টিকর্তার কাছেই প্রার্থনা জানায়। আজো এই ভাঙা ঘরটার গা ঘেঁষা রাস্তাটা দিয়ে গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ শুনলে আলেকজান বিবির মনে হয় এই বুঝি তার সত্তার ফিরে আইসা মা বলে ডাক দিবে...। বয়সের ভারে নত আলেকজান বড় বাড়িতে কাজে যাওয়ার সময় কোনো কোনো সকালে এখনো শিউলি গাছটার তলায় না দাঁড়িয়ে পারেনা। যে শিউলি ফুলের মালা যৌবনে আলেকজান বিবি সর্দারকে দিতে পারে নাই। শীতের কুয়াশামাখা ভোরে তারই হয়ে শিউলিগাছটা যেন অজস্র মালা গেঁথে সাদা আর কমলা চাদরে ঢেকে রেখেছে সর্দারের কবরটা! ভালবাসার এমন কোমল আদর থেকে বাদ যায়নি এখানে ঘুমানো তার প্রথম জীবনের ছেলে মেয়ে দুটাও! এখন আলেকজান বিবির এই শিউলিগাছটার তলায় আপনজনদের কাছে সাড়ে তিনহাত জায়গা নিয়ে পরম স্নিগ্ধতায় চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ার একমাত্র অপেক্ষা।
-----------------------------
-----------------------------
মুজিব ইরম-এর গল্প : বিছালমাইর
নজুর মনে ব্যাপারটি আবার দানা বাঁধতে
থাকে।
হুরমত উল্লার মারিয়ল বিছাল মেম্বারের
ষাড়কে আজ হারিয়ে দিয়েছে। এতে তার খুশি হবারই কথা, হুরমত উল্লার খুশিতে
তারও যোগ দেওয়া উচিত, কিন্তু তাকে বড়ো চুপচাপ দেখায়। হেরে
যাওয়া ষাড়ের হাহাকার নিয়ে জয়ী ষাড়ের সাথে নীরবে সে বাড়িমুখো হয়। হুরমত উল্লার
উচ্ছ্বসিত থাপ্পড় তার পিঠে জ্বালা ধরা- নজু মিয়া, ডেখাটার যত্নআত্মি ভালা করি নিও, হেভি মাইরল অইবো, পয়লা রাইতওই বিলাই মারছে, দেখছোনি?
নজুর নীরবতা তবু ভাঙ্গে না।
এটা তার স্বভাব নীরবতা ভেবে হুরমত
উল্লা উত্তরের তোয়াক্কাও করে না। গুঁজে আদর করে দিলে এতো মারিয়ল ষাঁড়ও ঘাইঘুই
না-করে হেলেদুলে হাঁটতে থাকে। তার কালো মিজমিজা শরীরে বিকালের শেষ সূর্যের আলো
ঝকমকায়। হাঁটার গতি কমিয়ে দিতে, না কি নিজের রাগ কমাতে গলার দড়িতে
নজু হঠাৎ টান দেয়- হুরমত উল্লা বুঝতে না-পারলেও ষাঁড়টি ঠিকই
ঘাঢ় উঁচিয়ে তাকায়। এতে করে বিছালমাইর দেখতে-যাওয়া বাড়ন্তির লোকেরা ভয়ে পিছু হটে।
আ-রে, আ-রে বলে হুরমত উল্লা ষাঁড়ের পিঠে নরম হাত রাখলে আবার
সে সোজা হাঁটা দেয়। নজু ভেতরে ভেতরে ফোঁসে কাইল দেখমু নে তোর ফুটানি, হারমির হারামি!
গালিটি সে ষাঁড়কে না হুরমত উল্লাকে
দেয় নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তার আগেই তারা বাড়ি পৌঁছে যায়।
হুরমত উল্লা ষাঁড়ের গলা, গুঁজ, শিং থেকে রঙিন মালা খুলে শিঙ্গের ধার পরীক্ষা
করে- নজু মিয়া, ডেখার হিং আরো ভালা করি
চুকাইতাম অইবো, কাইল চেয়ারমেনর ডেখার লগে মাইর, ব্যাপারটা বুঝতায় পারছোনি?
নজু মাথা নাড়ে।
হালার হালা লন্ডনি ডেখা কিনছে ইবার নজু
গজগজ করতে-করতে ষাঁড়ের সারা শরীর খুঁটিয়ে দেখে। কোথাও তেমন ছেঁড়াফাড়া চোখে পড়ে না।
মেম্বার কিতা বালর ডেখা কিনলো, মাথা দিয়া দুই ঠেলা দিবার আগেই
দৌঁড় দেয়, বিড়বিড় করে শিঙ্গের ধার সে বুঝতে চেষ্টা করে।
শিঙ্গের আগায় মেম্বারের ষাঁড়ের রক্ত শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে। হালার ডেখা, পারতে নায়তে আগে দৌড় দে, মাথা দিলে কেনে? আর দিলেতে একটা ফাড় দিয়া যা! না, ভাগলে তো ভাগলে
পেটর মাঝে দাগ নিয়া ভাগলে- পালিয়ে-যাওয়া মেম্বারের ষাঁড়ের
পেটে শিং ঢুকিয়ে রক্তের যে-দাগ হুরমত উল্লার ষাঁড় শিঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, তা সাফ করতে করতে নজুর রাগ বাড়ে। বিছালকে তখনই ঘরে না-ঢুকিয়ে আমড়া গাছের
নিচে বেঁধে হাওয়ালের তেল আনতে ঘরে যায়। হুরমত উল্লা দূরের পাহাড় থেকে টিপরা
কবিরাজকে দিয়ে বাজপাখির তেল পড়িয়ে এনেছে। নজু এখন তা দুই শিঙ্গে মাখিয়ে রাখবে। নরম
হয়ে এলে ধারালো দা দিয়ে লড়াইয়ের আগে শিং দুটিকে আরো ধারালো করে নিতে হবে। ঘরে
ঢুকতেই হুরমত উল্লার ডাকে তার রাগ আরো দ্বিগুণ হয়-ও নজু মিয়া,
কিতা টের পাইলায়? কাইল কিলান বাইছ অইবো?
চেয়ারমেনরে ইবার দেখাই দিমু! ভালা করি হিং চুকাইমু নে, তেল বেশি করি মালিশ কইরো, বুঝছোনি?
নজু মাথা নাড়ে। তেলের বোতল নিয়ে
চুপচাপ বেরিয়ে আসতে চাইলে হুরমত উল্লা আবার ডাক দেয়-ও নজু মিয়া, তোমার মাইনা চাইছলায় বুলে? মনে থাকতে নিও গি,
নাইলে আরবার ভুলি যাইমু!
-রাইতকু নিমুনে, হুরু চাচির গেছে রাখি লাইন যানু।
নজু দাঁড়ায় না। তেল নিয়ে বেরিয়ে আসে।
হুরমত উল্লার লাখ টাকার ষাঁড়ের
শিঙ্গে টিপরা কবিরাজের পড়া হাওয়ালের তেল দু’হাত দিয়ে মাখাতে মাখাতে নিজের
রাগ কমায়। তার হাতের নরম আদর পেয়ে ষাঁড়টি তেমন ঘাইঘুই করে না। করবেই বা কেনো?
ভাটির বড় বাজার আজমিরিগঞ্জ থেকে হুরমত উল্লাই না-হয় তাকে কিনে এনেছে,
মানা গেলো; মালিকও সে, তাও
মানা গেলো, কিন্তু এ ক’দিনে যে-মায়া
পেয়েছে, তাতে কি তার আপন হয়ে যায়নি? হোক
না হুরমত উল্লা মালিক, যত্ন-আত্মি করেটা কে হুনি? ষাঁড়টির রক্তলাল চোখে চোখ রেখে নিজেকেই যেন সে কথাগুলো শুনিয়ে যায়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, আর বাইরে রাখা ঠিক হবে না; নজু তাই তেল মাখানো শেষ করে ষাঁড়কে ঘরে তুলতে যায়! হালার মশার জ্বালায় আর
থাকা যাইতো নায়, গরুঘরে ঢুকে মশার ওপর সে রাগ ঝাড়ে। সুপারির শুকনা পাতায় মশা বের
হয়, তারপরও শাউয়ার মশা কমে না: গোলামর পুয়ার মশায় খাবি বানাই
লাইছে মনে হয়, ধোয়া দেওয়ার আয়োজন করতে-করতে তার বিরক্তি বাড়ে। গর্তে রাখা শুকনা
খড়ে আগুন দিয়ে পঁচা-ভিজা খড়ে ঢেকে দিলে ধুয়ায় তার চোখে জ্বালা ধরায়। তড়িগড়ি করে সে
বেরিয়ে আসে। এবার হেটামারাউনির পুয়ার মশা যাইবায় কই? কয়েলে
তোমরার পুতায় না, এন্ডিন মাইরাও খাউজ মিটে না, ইবার ধুমায় তোমরার খাউজ মিটাইবো নে, এতসব গালি দিয়েও মন তার হালকা হয় না,
চুপচাপ দাঁড়িয়ে মশাদের পালানো দেখে। তারপর একসময় ষাঁড়কে অন্ধকার ঘরে
ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
রাতের খাবার খেয়ে বছরের মাইনা নিয়ে
বাড়ি ফিরতে-ফিরতে মাথার ভিতর আবার তার জেদ আসে। বুড়িকে দেখে জেদ আরো দ্বিগুণ হয়।
দাওয়ায় বসে কুপি বাতির আলোয় নিজের চুলে নিজেই বিলি কেটে উঁকুন খোঁজার কেনো যে
ব্যর্থ চেষ্টা করে বুড়ি! তার উপস্থিতি টের পেয়ে বুড়ি সরব হয়ে ওঠেÑনজুরে, ও নজু, তুই আইছস নি?
কথা কছনা কিওর লাগি রে পুত?
দাওয়ায় উঠে চোখে ছানি-পড়া মায়ের পাশে
বসতে-বসতে উদাস হয়ে যায় সে! ছেলের মাথায় হাত বুলায় বুড়ি, কুন্তা করছসনি রে পুত?
নজু কিছুই বলে না। এ নিয়ে আর কথা
বলতে ইচ্ছা করে না তার। কেনোই বা করবে? হুরমত উল্লাকে তো প্রতিবারই বলে
আসছে, চাচা, কুন্তা করইন, কুন্তা করইন!
কে হুনে কার কথা! এই বার আসার পরেও যে বার কয়েক বলেনি, তাতো
নয়। হুরমত উল্লা বরাবরের মতোই বলেছে, অইবো নে নজু মিয়া, অইবো
নে; ভাটি থাকি ডেখা লইয়া আইদে আগে; এতো
বেসবুর অছ কিওর লাগি?
প্রতিবারই তাই হয়। সারা শীত
বিছালমাইর নিয়ে ব্যস্ত থাকে, শীত শেষ, ষাঁড়
বেঁচে হুরমত উল্লাও বিলাত উধাও; কে পায় কার নাগাল! বাঁধা
কামলা হিসাবে অবশ্য তাকেই হুরমত উল্লার বাড়ি-ঘর দেখভাল করতে হয়, কিন্তু তার নিজের বাড়ির কিছুই হয় না। কেনো যে শাউয়ার সৌদি গেছলাম- নজুর রাগ নিজের ওপর বাড়ে। বাপের রেখে-যাওয়া বসতভিটা কেনো যে হুরমত উল্লার
কাছে বিক্রি করে সৌদি গেলো, আর গেলোই যদি, পুলিশও কেনো বছর ঘুরতে না ঘুরতে তাকেই ধরলো! চুতমারাউনির পুয়ার ভাগ্য, নজুর
নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তে ইচ্ছা করে। হুরমত উল্লার গলার স্বর শুনেই সে বুঝেছে এবারও
কিছু হবে না। হুরমত উল্লার কিনা বাড়িতে রিফুউজিই থাকতে হবে। সারা জীবন কামলা খেটেও
এ-বাড়ি আর তার হবে না। মায়ের কাঁপা-গলার প্রশ্নেও নজু তাই চুপ মেরে থাকে।
হুরমত উল্লার বাড়িতে ভোরবেলায় পাড়ার
লোকজন এসে জড়ো হয়েছে। বড় খাশি জবাই দিয়ে পোলাও রান্না করছে আইজু বাবুর্চি। আইজু
বাবুর্চির নাম করা আখনির ঘ্রাণ দাওয়াতে-আসা লোকজনের পেটের ভোখ বাড়িয়ে তুলছে। হুরমত
উল্লার গলায় বড়ো খুশির ঢেউ, আপনারা হকলে হুনউকা, চেয়ারমেনর ডেখা ইবার
পালাইতে না দিশ পাইবো। মেম্বারর ডেখার অবস্থা-তো কাইল আপনারা দেখছইন, দেখছইন না নি? সকলে সম্মতি জানায়। উত্তর পাড়ার কানা
সয়ফুর বাগড়া দেয়, হুনছি চেয়ারমেন বুলে জৈন্তা থাকি তাবিজ আনছে, থলাত গাইড়া রাখবো?
-বাল ছিঁড়বো! আমরার লন্ডনিসাবও টিপরা
দিয়া তেল পড়াইয়া আনছইন। ঠেলা এবার বুঝবো নে!
পুবপাড়ার আব্বাসের কথায় কানা সয়ফুর
মিইয়ে যায়।
-তেসলাবার হোনাকোনার বন্ধ কিতা অইছিল, মনো নাইনি? লন্ডনিসাবর ডেখায় খালিশপুরর বশিরর ডেখারে
এক ফাড় দিয়া পেট ফারি লাইছিল!
আলফুর কথায় মনু আরো গলা ছড়ায়।
-গেলোবার কামালপুরর মাইরো খাসিটা
জিতলো কে? আমরার লন্ডনিসাব! ডেখাও আছিল, গাত তিল ফালাইয়া তিল
তুলা যাইতো, এমলান মিজমিজা লোম! আর গলার লতি গিয়া লাগতো
মাটিত, হাঁটতো সময় গুজ এমলান নড়তো, দেইখ্যাও
বড়ো আরাম আছিল রেবা!
-আর ওউ কথা ভুলি লাইলায়নি?
দক্ষিণ পাড়ার বুড়া আলীম আলীর কথায়
সবাই তার দিকে তাকায়, ঠিক মনে করতে পারে না কোন কথা তারা ভুলে গেছে। বুড়া
পান চিবাতে-চিবাতে আয়েস করে বসে- কী তাগড়া ডেখা আছিল! লতুর
বাপর ডেখি-গাইরে এক্কেবারে ফিট করি লাইছিলো! মাশুআল্লা, লতুর
বাপর ডেখি-গাইও আছিল দেখার মতো!
-বাদ দেও রেবা খালি পুরান কথা! ইবারর
ডেখা কিতা কমনি? কোনো মাইর পুত আছেনি তার লগে বেটাগিরি দেখায়?
কালুর কথায় সকলেই এবার নয়া-বিছালে
ফিরে আসতে চায়। হুরমত উল্লা খুশি হয়ে বিলাত থেকে নিয়ে-আসা সিগারেট সবাইকে বাড়িয়ে
দেয়, ইলেকশন লইয়াও সিরিয়াসলি আমরার এখন থাকিই শুরু করতে অইবো। কিতা কইন আপনারা? লোকজন এবারও মাথা নাড়ে। একমাত্র ফজলই আগ বাড়িয়ে বলে, অবশ্যই লন্ডনিসাব,
চিন্তাভাবনা আইজ থাকিই শুরু করতে অইবো। আপনে খালি ওর্ডার দেইন,
দেখবানে ইবার কিতা করি!
ফজল তার ফিরা-গাই নিয়া সকাল থেকে বড়ো
পেরেশানিতে আছে। সারা মাইজ-বাড়ন্তি, উত্তর-বাড়ন্তি, পশ্চিম-বাড়ন্তি ওরফে নন্দিপুর ঘুরেও ডেখা পাওয়া যাচ্ছে না, উরানোও যাচ্ছে না; ডেখিটা ডেকে-ডেকে বাড়ি মাথায়
তুলছে। হুরমত উল্লার সাথে আগ বাড়িয়ে খাতির জমাতে চেষ্টা করে সে। হুরমত উল্লাকে কি
তাতে খুশি দেখায়? কথা-বলা শেষ করেও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না
সে। যদি হুরমত উল্লা রাজি হয়, তাহলে গাইটা নিয়ে আসবে,
তা না-হলে চেয়রম্যান-মেম্বারের কাছে ধর্ণা দিতে হবে। ওই শালারা আবার
খচ্চর! মেম্বার তো সরাসরি টাকা চায়, গাই প্রতি ১০০ টাকা।
চেয়ারম্যান অবশ্য সরাসরি চায় না, তবে তার কামলাকে তো আর খুশি
না-করে পার পাওয়া যাবে না। ফজলকে তাই চিন্তিত দেখায়।
কিন্তু এতো কিছুর পরও হুরমত উল্লা
রাজি হয় না। বিছাল যদি ফিরাগাই উরাইতে দেয় তাইলে কিতা বিছাল আর বিছাল থাকবো নি? মর্দানী হারাইয়া মেউয়া দামার লাখান পুতাই যাইবো নানি? আর একবার যদি ডেখির স্বাদ পাইলায় তারে কিতা আর আন্ধাইর ঘরো আটকাইয়া রাখা
যাইবোনি?
ফজল আর কিছু বলতে পারে না। শুধু
বিছালমাইর দেখার আগ্রহ তার ভাটা পড়ে যায়।
নজু অন্ধকার ঘর থেকে বিছালটিকে বাইরে
নিয়ে আসে। আলো দেখে ষাঁঢ়টি হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে। গুঁজে, লতিতে সে হাত বুলায়।
নজুর আদর পেয়ে ষাঁঢ়টি চুপ মেরে যায়। হুরমত উল্লা এবার ধারালো দা দিয়ে নজুর
আদর-পাওয়া ষাঁঢ়ের শিং চোখা করতে থাকে। বাজপাখির তেলে নরম-হওয়া শিং দেখতে-না-দেখতে
ধারালো হয়ে ওঠে। হুরমত উল্লা শিঙ্গের আগা হাত দিয়ে পরখ করে-র মাইর;
চেয়রমেন ঠেলা ইবার শোয়ারবো কেমলান? হুরমতর লগে
ঠেলাঠেলি! ইবার মাথা বাইন্ধা আইছি, আমার ডেখা কেউ কোনো দিন
ভাগাইছে নি, না ভাগাইতো পারবো?
বাড়ন্তির বন্দে আউশ ধানের ক্ষেতে
গেলো মৌসুমের নাড়া সোনালি থেকে ধূসর হতে শুরু করেছে। কোনো কোনো ক্ষেতে যদিও
দাঁড়িয়ে-থাকা নাড়াকে দূর থেকে সোনালিই দেখায়, তবে পাশে আসলে বুঝ যায় বেশির
ভাগ ক্ষেতেই রাতের কুয়াশা আর দিনের কড়া রোদ পড়ে ছাই বর্ণ ধারন করেছে। এই উঠতি
বিকাল তাদের গায়ে পড়ে ঝলকায় না বটে, তবে পড়ন্ত সূর্যের আলো
পিছলে আরো উজ্জলতা ছড়ায়। মানুষের পদভারে তারাও আজ মাটিতে মিশে যাবে, এরকম মানুষের ঢল নেমেছে মাঠে। বাড়ন্তির আউশ ধানের বন্দে বিছালমাইর হবে, এ
খবর স্থানীয় হাটে ঢোল পিটিয়ে আগেই জানানো হয়েছিলো। মানুষজন তাই দুপুরের পর থেকে
আসতে শুরু করেছে। বন্দের চারপাশের বাড়িগুলো থেকে বউ-ঝিরা মুখ বাড়িয়ে আছে। তারা
বিছাল মাইরে যোগ দিতে পারছে না, কিন্তু দূর থেকে উত্তেজনার
তাপ নিতে-তো বাঁধা নাই। বাড়িগুলোর কলাঝাড়, ঝোপঝাড়, গাছগাছালি, যেদিকেই চোখ যাক নানা বয়সি মেয়ে-মানুষের
মুখ চোখে পড়বেই পড়বে। হুরমত উল্লার বিছাল কাল মেম্বারের বিছালকে হারিয়ে নাম করে
ফেলেছে। আজ যে কী হয়, আল্লা মালুম!
লড়াইয়ের ষাঁড়গুলো এখনো মাঠে আসেনি।
লড়াই দেখতে-আসা লোকজন দুই ভাগ হয়ে তাদের অপেক্ষায় আছে। হুরমত উল্লার লোকজন কম নয়, যদিও চেয়ারম্যানের দিকে শোরগোল হচ্ছে বেশি।
অন্ধকার ঘরে পুনরায় আটকে রাখা
ষাঁড়টিকে নজু সাজাতে ব্যস্ত হয়। কিন্তু বারবার তাল কেটে যায়। হুরমত উল্লা বাড়িতে
জড়ো-হওয়া লোকজনের তদারকি করলেও নজর তার মাঠের দিকে। দলের সাপোর্টার যেন এখনই সে
অনুমান করে নিতে চায়। বাদক দলও এসে গেছে, তবে হুরমত উল্লার মানা তাকায়
তারা মন খুলে বাজাতে পারছে না। ষাঁড়টা আবার আগেভাগেই না রেগে ওঠে! এমনিতেই সে
অন্ধকার ঘরে সারাদিন আটকা থাকতে-থাকতে ফুঁসছে। তাকে আর ছাড়া হবে ঠিক লড়াইয়ের আগে, যাতে
করে ঢোলের শব্দে অন্ধকার ঘর থেকে বের হয়েই লড়াইয়ের মাঠে ছুটতে পারে। চেয়ারমেনর
তাকত ইবার দেখা যাইবো, হুরমত উল্লা আনন্দে দাড়িতে হাত বুলায়।
নজু ষাঁঢ়ের গলায় পাগা বাঁধতে-বাঁধতে
গর্জায়, আইজ দেখমুনে তোর তেজ, শুয়রর বাচ্চার ডেখা!
চেয়ারম্যানের ষাঁড় উত্তর দিক থেকে
মাঠের দিকে রওনা দিয়েছে, দক্ষিণ দিক থেকে হুরমত উল্লার বিছাল। দু’পক্ষের বাদকদল উচ্চস্বরে বাজনা বাজিয়ে আপন আপন ষাঁড়ের পিছু ধরে, ষাঁড়গুলো যেন হাটছে না, উড়াল দিতে চাচ্ছে। হুরমত
উল্লার হাতে দড়ির একদিক অন্যদিক নজুর হাতে। দু’জনের হাতেই
লাঠি। ষাঁড়কে তারা বাগে রাখতে চেষ্টা করছে। চেয়ারম্যানের ষাঁড় কী মনে করে লড়াইয়ের
জায়গায় এসে চুপ মেরে দাঁড়িয়ে পড়ে, তাদের দলে গুঞ্জন ওঠে- হুরমত উল্লা থলায় আবার তাবিজ-কবজ পুঁতে রাখেনি-তো! গুনিন এনে বাণ মেরেছে
কি না, কে জানে! গেলোবার-তো তাই করেছিলো। চেয়ারম্যান ও
মেম্বার, যার বিছাল গতকাল পরাজিত হয়েছে, হাতের লাঠি ক্রস করে
মাটিতে ঠেস দিয়ে ষাঁড়ের গলায় ঠেকিয়ে রাখে। দু’জনের হাতে
পাগার দড়ি আলগোছে ধরা। হুরমত উল্লার বিছাল এলেই খুলে দিতে হবে। তাদের চোখও আউশ
ধানের নাড়ায় গুনিনের তাবিজ-কবজ খোঁজে। কিন্তু না আর সময় নাই। হুরমত উল্লার ষাঁড়
এসে গেছে। লোকজন নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়ায়। হুরমত উল্লা ও নজু তাদের ষাঁড়কে
কিছুতেই আটকে রাখতে পারছে না। চেয়ারম্যানের চিত্রাফাকড়া ষাঁড়কে দেখতে পেয়ে হুরমত
উল্লার কালো ষাঁড় ফুসতে-ফুসতে পা দিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকে। বাজনা বন্ধ হয়ে যায়।
চারপাশে নীরবতা নেমে আসে। চেয়ারম্যানের বিছাল চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। যেন শক্র পক্ষকে
একপলক দেখে-নেওয়া দরকার। দু’পক্ষেই উত্তেজনা। ষাঁড়দের গলা
থেকে দড়ি খুলে দেওয়া হচ্ছে। হুরমত উল্লার ষাঁঢ়ের তড়পানিতে চেয়ারম্যানের ষাঁড় হঠাৎ
ক্ষেপে ওঠে। দর্শকদের মার মার চিৎকারে ষাঁঢ় দু’টি কী মনে করে
হঠাৎ থেমে যায়। চেয়ারম্যান লাঠি তুলে খোঁচা দিতে চাইলে হুরমত উল্লা খবরদার বলে
তেড়ে আসে। চেয়ারম্যান পিছিয়ে যায়। ষাঁড়গুলো শিঙ্গে শিং লাগিয়ে ধীরে ধীরে চক্কর
দিতে থাকলে মানুষের কৌতূহল বাড়ে। নজু উত্তেজনায় চেচায়- মার,
মার, মার কুত্তার বাচ্চা! নজু নিজের ষাঁড়কে
বলে বটে কিন্তু চোখ তার চেয়ারম্যানের ষাঁড়ের দিকেই বিদ্ধ থাকে। বালর চেয়ারমেনর
বিছালও মনের অয় পুতাই গেছে, নজু মনে মনে গর্জায়। তার মনের কথা শুনেই কি না কে জানে,
চেয়ারম্যানের ষাঁড় হঠাৎ শিং তুলে, পেছনের পা
দু’টি মাটিতে গেঁথে এমন আক্রমণ করে বসে, হুরমত উল্লার লাখ টাকার বিছাল সামলাতে না-পেরে ক’হাত
পিছিয়ে যায়; কানের লতি ছিঁড়ে রক্ত গড়াতে থাকে। চেয়ারম্যানের
উজ্জ্বল মুখের দিকে চেয়ে হুরমত উল্লার মুখ ধপ করে নিভে যায়। মেম্বার উচ্চস্বরে
আনন্দ ছড়ায়, নজুও বাঘের বাচ্চা বলে বটে, তবে তা মুখ দিয়ে বের হয় না। হুরমত উল্লার ষাঁড় অবশ্য প্রতিপক্ষের আক্রমণ
ঠেকিয়ে ফেলেছে। এবার সে কৌশল পাল্টায়, ধীরে ধীরে শুধু পিছু
হঠতে থাকে; মানুষজনও তাদেরকে অনুসরণ করে। লড়াই শেষ হতে চললো,
যে কোনো ফাঁকে সুযোগ বুঝে হুরমত উল্লার ষাঁড় দৌঁড় দেবে- নজুও তা বুঝে লাঠি গুটিয়ে নিতে থাকে। হঠাৎ কী থেকে কী হয় হুরমত উল্লার বিছাল
পেছনের পা মাটিতে গেঁথে এমন আক্রমণ করে বসেÑচেয়ারম্যানের
ষাঁড় ঘাড় শক্ত করতে না-পেরে যেই মাথা বাকিয়েছে, হুরমত উল্লার
নিজ হাতে ধারালো তীক্ষ্ণ শিং চেয়ারম্যানের বিছালের ঘাড় রক্তে ভাসিয়ে দেয়।
চেয়ারম্যানের ষাঁড় প্রতি আক্রমণ করবে তো দূরের কথা, আত্মরক্ষার
তাগিদে এমন দৌঁড় দেয়, চারপাশের দর্শকও প্রাণপনে নিরাপদ
স্থানে দৌঁড়াতে থাকে।
চেয়ারম্যান-মেম্বারের মুখ কালো করে
হুরমত উল্লার জয়ী বিছাল আবারও বাড়িমুখো হয়।
==================
অপরাহ্ণ সুসমিতোর মিনি গল্পঃ এ ট্রেন টু ঢাকা
এই সময়ে গরম পড়ে সবাই জানে । চিনিচিন করে ঘামের বাহার । বাসে চড়লে আজকাল আর ঘামের গন্ধে কিছু যায় আসে না । গরমে পিচ গলে এক ধরনের ঝিম মারা গন্ধ চারপাশ ভরে যায় । রাতে কখনো কখনো কারেন্ট থাকে না । তীব্র গরমে আর সবাই যখন ঝড়ে পড়া নৌকার মতো এপাশ ওপাশ করে আমি তখন বেসুমার ঘুমাই । আমার এই বেহেশতি ঘুমে সবার ঈর্ষা । এমনকি আমার মা পর্যন্ত তালপাখার হাতা দিয়ে আমার পিঠে খোঁচা দেয় ।
: এই অলম্বুসটার দেখি কোনো হুঁশবুশ নাই ।
আমি বোয়াল মাছের মতো একটু ঘোঁত শব্দ করে আবার অন্য পাশ ফিরে ঘুমাই ।
আমার বাবা দুশ্চরিত্র গোছের মানুষ । এক মুদী দোকানে কাজ করতো । ওখান থেকে টাকা চুরি করে দালাল ধরে কুয়েত গিয়েছিল । ওখানে এক শেখের বাড়িতে চাকরের কাজ । একদিন শেখ বাবাকে আচ্ছা মতো পিটায় কি কারনে যেন । বাবা ফিরে আসে প্রায় শুন্য হাতে । সে থেকে ঘরে বসে থাকে । ডান হাত তার প্রায় অকেজো । মাঝে মাঝে গরমে সিদ্ধ হতে হতে আমাকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গালি দেয় । আমি প্রথম প্রথম সহ্য করতাম । এখন ডাঙ্গর হইসি,আমারে গালি দিলে আমিও গালি দেই ;
: এই নুলা ।
এর পর বাপজান আরো বিশ্রী করে আমার মা নিয়ে গালি দেন । আমি ঠান্ডা মাথায় বলি;
: টাকা চোর ।
তিনি বাম হাতে এটা সেটা আমাকে ছুঁড়ে মারেন । সংসার জীবনে ব্যর্থ মানুষের মতো,আমাকে তাক করতে পারেন না । এরকম ছোঁড়াছুড়ি বেশিক্ষণ চলতে পারে না । ঘরের জিনিষপত্র মা’র কেনা বলে-মা এসে বাবাকে তীব্র খিস্তি করেন,বাবা পরাজিত পাকিস্তানের মতো নুইয়ে আফগানিস্তানের দিকে যাত্রা করেন । তখন বাবাকে একদম তালেবানদের মতো লাগে ।
মা আমার মাঝারি টাইপ ভালো। সেলাই করে সংসার চালান। সেলাই করে কি আর সংসার চলে ? টের পাই যে তার দুই নম্বর সাইড বিজনেস আছে । চরিত্রে খলবল দোষ আছে ।
আমার কি ?
গরম নামে । গরম ছাপিয়ে কোনো দিন বৃষ্টি নামে । বৃষ্টির সাথে আমার কেমন যেন যৌন সম্পর্ক আছে টের পাই । গতরে মাকড়সার মতো কি যেন মাতম কিলবিল করে । আমি বাইরে এসে একটা জলচৌকি নিয়ে বসে থাকি । হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁই,মনে হয় কাকে যেন নরোম আদর করছি । আমার কী যে ভালো লাগে । কোনো রাজনীতি নাই,ভোট নাই,মিথ্যা কথা নাই,দল পাকানী নাই । ইচ্ছা করে বৃষ্টিতে সব খুলে হেঁটে হেঁটে আগারগাঁও থেকে তেতুলিয়া চলে যাই ।
লু্ঙ্গির গিঁটে হাত দিতে গেলে আচানক সামনের বাড়িতে বসন্ত খালা । খালার নাম জানি না । মুখ ভর্তি বসন্তের দাগ বলে সবাই বসন্ত খালা ডাকে । আমারে দেখে খিলখিল করে হাসে ।
: কী রে হারামজাদা কি করস ?
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো বৃষ্টি এসে চারপাশ ভাসিয়ে নেয়, আমি টের পাই ভেতরের এক চিলতে ঘরে বাবা মা আদর করছে । আমি মুগ্ধ হয়ে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টিতে ডুবতে থাকি । মা’র আর্দ্র কন্ঠ ভেসে আসে;
: ও লেবুর বাপ এত মনোযোগ দিয়া কি করো ? (আমার নাম লেবু )
বাবার কোন শব্দ নাই । নুলো বাপজান জীবনে সবখানে মার খেতে খেতে এই খানে এসে গভীর মমতায় আদিম সাম্যবাদের গান করে যায় ।
টের পাই আমার চোখ ভিজে আসছে । কান্না ? না না বৃষ্টির ছাট,তুমুল । চোখ বন্ধ করে থাকি । এত প্রবল বৃষ্টি নূহ ধ্বনি যে কান জুড়ে কদম পাপড়িতে বিস্তার করে থাকে ।
সৈয়দপুর থেকে আমার বাবা মা কে বাড়ি থেকে পিটিয়ে বের করে দিচ্ছে । মা হাউমাউ করে কাঁদছে । বড়বোন মহররমের ‘হায় হোসেন,হায় হোসেন’ এর মতো বুক চাপড়ে মাতম করছে । আমার চোখে কুয়াশার মতো অষ্পষ্ট ছবি । আমরা উদ্বাস্তু হচ্ছি ।
আমাদের কেউ নেই । বাবা ট্রেনে চড়ে বসেন, তছনছ সংসার নিয়ে । আমি ভয়ে বাবার বুড়ো আঙ্গুল ধরে ট্রেনে বসে থাকি । ঘুম পেলে বাবার নাভীর সাথে মুখ গুঁজে থাকি,তবু ভয় যায় না ।
ট্রেন চলে । ট্রেন কে পরাজিত করে দৌঁড়ে যায় বাইরের ল্যাম্প পোস্ট, গাছপালা, বিহারী বস্তি ।
আরো নামুক বৃষ্টি কিয়ামত । ভেসে যাক । না থামুক এই বিভব তান । বাবাটা ডুবে থাক না মা এর অভাবের মম জমিনে ।
এই এই দেখো, আমি কিন্তু একদম কাঁদছি না।
স্কেচ: জয়নুল আবেদিন, টরন্টো মিউজিয়াম, কানাডা।
অপার মমতায় চোখ ভিজে আসে, আর মমতাই শত তাচ্ছিল্যের মাঝেও আনন্দের সাথে বাঁচিয়ে রাখে।
উত্তরমুছুনমানুষ বেঁচে থাকে আশা আর ভালোবাসায়
উত্তরমুছুন